জগৎ বাসী একবার আসিয়া
সোনার বাংলা যাও দেখিয়া রে। ।
ওরে পাকিস্তানের বর্বর ইয়াহিয়া
মেশিন গান আর বেনেট বুলেট দিয়া
সোনার বাংলা করল শ্বশান রে। ।
ভাদ্র মাসের জল ডালিমের রসের মতন।
দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সে জলে সাধু সওদাগর পানসীতে ভেসে চলে। এমন পানির বহর অনেক বছর হয়নি। না ডুব না সাঁতার। নৌচলাচলের বিশেষ উপযোগী।
সে টা শত্রু-মিত্র সবার জন্যই। চাল কুমড়া আর মিষ্টি কুমড়া ছাড়া আছে ঝিঙ্গা, কইঠা, চিচিঙ্গা। বারমাসি ফলের মধ্যে নাড়িকেল, কলা। শেরালীর খাদ্য তালিকায় শুধু শষা। রতনের কবরে গাথা বরই গাছের ডালটা অনুকূল আবহাওয়ায় নতুন কঁচি পাতা মেলছে।
কবরের চার কোনায় গুজে রাখা রসুনের কোয়া এখন গাছ হয়েগেছে। করস্থানটা গ্রামের মাঝখানে। একটা অলাদা বাড়ীর মতন। কড়ই, তাল আর কয়েকটা বেন্না গাছ ছায়া দিচ্ছে ঘুমন্ত মানুষ গুলির অদৃশ্য শরীরে। পানির এক হাত উঁচুতে মটকুরার ঝোপের মাথায় চুলের মত বিছিয়ে আছে সর্ণলতা।
দু'একটা ঘুঘুর ডাক কবরস্থানের মৌনতায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। আমি দুপুরের দিকে প্রায় প্রতিদিন এখানে আসি। কোন কারণ ছাড়াই। মনে মনে বলি রতন তুই বড় হলি কেন! আমার মত ছোট থেকে গেলে তোর এত ঝামেলা হত না। টুপ করে একটা তাল পড়ল পানিতে।
রতন ফেললনাতো! আমি সেখানে যেতে যেতে তালটা জল থেকে ভেসে উঠেছে। তালটাকে বুকের নীচে রেখে ক্ষেতের আইলের উপর দিয়ে সাতরে বাড়ি গিয়ে দেখি, হুলুস্থুল কান্ড। ডিঙ্গি নৌকায় সাত আট জন পান্জাবী আর লোকমান রাজাকার। এখন ওরা গ্রামেও টহল দিচ্ছে। এতদিন বাজার আর রাস্তার টহলেই ব্যাস্ত থাকতো।
রতনের মৃত্যুর পর এক সপ্তাহ পার হওয়ার আগেই পান্জাবীরা লঞ্চ নিয়ে গ্রামে আসে, মুক্তি ফৌজের খোঁজে। কিন্তু দিনের বেলায় মুক্তি বাহিনী ঘরে বসে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করবে! গাছের ফল, গোয়ালের গরু, এমনকি হাঁস মুরগীও বাদ গেলনা। গোলার ধান সহ সব লঞ্চে তুলে ঘরে আগুন ধরিয়ে দিল। নজরুলের (ছাত্রলীগের ডাকশুর সদস্য) বাপকে চোরের মত পেছনে হাত বেঁধে সঙ্গে নিয়ে গেল। এপাড়ায় জ্বলছে পাঁচটা বাড়ি।
টিনের ঘর আগুনে জ্বলার মত শুধু কাঠ। তাই তেমন বেশী আগুন দেখা যাচ্ছেনা। কালো ধোঁয়া নীল আকাশে কাজল পড়াচ্ছে। ধাউ ধাউ করে জ্বলছে এখন ঋষি পাড়া। সবই সনের ঘর।
লাল লেলিহান শিখা সূর্যকে হার মানাচ্ছে। হিন্দুদের টিনের ঘর রাজাকারেরা ভাগ বাটোয়ারা করে যে যার বাড়ি নিয়ে গেছে। মায়ের প্রবল আপত্তিতে আমরা টিনের ঘর থেকে বঞ্চিত। তাই হিন্দুদের সনের ঘর গুলিই শুধু জ্বলছে। নজরুলের বাপের লাশ তার পরের দিন বৈশার চরে পাওয়া গেছে।
গ্রামের মানুষ ভেবেছিল এই শেষ। পানজাবীরা আর গ্রামে আসবেনা। কিন্তু এখন দেখি এরা আমাদের বাড়ী। বাবাকে ডিওটিতে রেখে রতনের মৃত্যুতে মাকে সমবেদনা জানাতে এসেছে। আমাকে আদর করে একজন কাছে ডাকল।
ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম। লোকমান রাজাকার অভয় দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে ওরা বিদেয় হল। রতনের মৃত্যুর পর বাবা শুধু দিনেই ডিউটি করে। ঘরের পরিবেশ খুব সান্ত।
মনের ভুলে মা আজও রতনের থালায় ভাত দিল। বাবা দেখি তেমন কিছু বলল না। খাওয়ার মাঝখানে মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। এ কান্না কি কোন দিন থামবে! কারই ভাল করে খাওয়া হলনা।
মায়ের গো গো ফুস ফুসানীতে আর দস্তা দস্তিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
কি হল, কি না হল, কিছু বুঝতে পারলাম না। বেশ কয়েক জন ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবার মায়ের চিৎকার কানে এল।
আফনেগ হাতে ধরি, পায়ে পরি আমারে রারী কইরেন না। আমার পোলাডা গেছে, আমার জামাইডারে ছাইরা দেন।
খোদার দোয়াই।
বলতে বলতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন ওদের পেছনে।
কিন্তু এতক্ষনে দ্রুত বৈঠা চালিয়ে ওরা অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। পরসীরা ওদের চলে যাওয়ার পর, নিরাপদ বোধ হাওয়ায় ঘটনা জানতে এসেছে। মুক্তি বাহিনী কেরাম রাজাকারকে ধরে নিয়ে গেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।