আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেরালী আট-বছরের শেষ কাতি



প্রশাখার কান্ডে ঝুলে থাকা তেতুল পাতার মত রেল সড়কের দু ধারে সারি সারি নৌকা বাধা। বর্ষার শেষ দিকটা খুব কদাকার। নৌকা পাহারার বেতন, পাতলা মাথায় দুই আনার বুট খেতে খেতে হাত ও ঠোট দুই লাল। বুটকে আকর্ষনীয় করতে তাতে রং মাখা হয়েছে। রতনই প্রথম নৌকায় এলো।

কুয়াশার মত বৃষ্টি পরছে। এ অবস্থা বেশ কদিন ধরেই। বাজারের সব রাস্তা পাকা নয়। খুব কাঁদা। লুঙ্গিটা কাছা দেয়া ছিল আগেই।

পানি অনেক কমে গেছে। সদ্য জলমুক্ত জায়গার মাটি এত নরম যে হাটু পর্যন্তু ডুকে যায়। রতন সেই প্রস্তুতি নেয়েই চালের বস্তা মাথায় তুলেছে। খুব কৌশল করে বস্তাটা নাওয়ের গলুইয়ে রাখল। যেন কোন শিশু কোল থেকে ধরণিতে হামাগুরি দিতে নামিয়ে দেয়া হল।

কত নিল মাওলার পুত? পাশের নৌকায় ব্যার্থ ভাবে খদ্দেরের অপেক্ষায় বসে থাকা মিস্তিরির প্রশ্ন। যদিও আমরা দুজনই মাওলার পুত তবু প্রশ্ন রতনের উদ্দ্যেশ্যেই। মিস্তিরিরা কাঠের কোষা নৌকা বানিয়ে হাটবারে বিক্রি করে। কিন্তু এখন পানি অনেক কমে যাওয়ায় নৌকা খুব একটা বিক্রি হচ্ছে না। রতন বলল; বরিশাইল্লা চাইল, হেই আবার চল্লিশ টেহা দর।

আমরা আমন ধানের চাউল খেয়েই অভ্যস্ত। বরিশালের চাল বোরো ধানের, তাই দাম একটু কম। একে একে সবাই নৌকায় ফিরে এল। মাল পত্র আর মানুষে নৌকা প্রায় ডুবু ডুবু। এতক্ষন সূর্য্যি মামা ছাই রং এর ঘোমটা মাথায় ছিল, এখন রঙ বদলে কাল করে দিল চরাচর।

সবাই হাতে বৈঠা নিল। ঝুপ ঝুপ পানি কেটে নও এগিয়ে চলছে, বৈঠা টানার সাথে সাথে। বাবা বললো দিন দিন সব কেমুন হইয়া যাইতাছে। মুন্সীরা এবার নাও দৌরের ব্যাবস্থা করলনা! রেজেক মিয়া বলল: করবে কি করে! লোকের মনে শান্তি নাই। দেশে কি অইব কেডা জানে? শেক সাবেরে বেবাকে ভোট দিল।

কিন্তু পাকিস্তানীরা গদি ছারে না। মুন্সীরাতো মুসলিম লীগ আছিল। মানইষে একটা ভোটও দেয় নাই। হেগ মোনে বরই কষ্ট। তো নাও দেউরের ব্যাবস্থা করব কেইম্তে? ফানজতালী বলল: বাইজু রাজা জেইলা মনে লয় ইলাই অইক।

অমরার গরীবরার কাম কইরাই খাওন লাগব। ইলিশ মাছের ডিম রোজগেরে বিধায় বাবা আর রতনই পেল। কাঁঠালের বিচি দিয়ে ইলিশের ঝোলও খুব মজা করে খাচ্ছি। তবে আমার প্রিয় হচ্ছে নোনতা ইলিশ। ডিম খাওয়া শেস করে ঝোল দিয়ে এক নলা মূখে দিয়েই বাবার খিস্তি শুরু হল।

মিডা কইরা ছালন রাছনত তোর কো বাফের লাগি? মা বাটা মরিচের খোরার দিকে বাবার দৃষ্টি আর্কষণ করার চেষ্টা করতে করতে বললেন; আমনে এত ঝাল চান, তয় এত ঝাল দিলে এই লেডা ফেডা গুলান খায় কেম্তে। বাবা: মাগী তুই আলাদা ছালন রানবার হারিছ না? মা; নিশি রাইতে বাজার থন আইয়েন, তয় দুই ছালন রান্দুম কত্কন? কথোপকথন হাতা হাতির পর্যায় পৌঁছে যেতে পারে। এমন আশংকা। কিন্তু বাবার অনাগ্রহে এবার তা হলনা। আজকাল খুব অল্পতেই মন বিদ্রহ করে বসে।

ইচ্ছে করে ভাতের খানকি বাবার মূখে ফেইক্কা মারি। বালি তোলার মৌষম শেষ। রেজগারে জলের মত ভাটা পরেছে। এখন অঘ্রান মাস আসা অব্দি আয়ের জোয়ার আসবেনা। মাছ মারা পরছে মনে মনে।

কিন্তু কেনার লোক নাই। শিশু কিষোর ছেলে বুড়ো এমনকি গৃহবধুরা পর্যন্ত জেলেদের প্রতিযোগী। মাছ সবার ঘরে। তা পয়সা দিয়ে কিবে কে? শুটকি দেয়ার চেষ্টা চলছে, কিন্তু গাদলায় মাছ না শুকিয়ে পচন শুরু হয়েছে। তার দুর্গন্ধে শ্বাস নেয়া মুষকিল।

কাজে লাগছে শুধু ছোট চিংরি। মা সেগুলো পাটায় বেটে রুটির মত খোলায় ভেজে শালুক ঘেচুর সাথে খেতে দিচ্ছে। রুই কাতলা পানি পাঁকার আগেই নদীতে অশ্রয় নিয়েছে। কৈ, শিং, মাগুর দুর্দিনের জন্য কলসীতে জিইয়ে রাখা হচ্ছে। বৈছা বজুরীর দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছেনা।

কার্তিকের ঘোলাজল খুব তাড়া করে সমুদ্রের টানে ফিরে যাচ্ছে। জেগে উঠছে জমি। পিচ্ছিল মসৃণ। কাশ ফুলের মত ধানের ডগা চালে পেট ভরে সবুজ হচ্ছে। খাল-বিলের ধারে মাছ মারার হিরিক।

জৈ লেগেছে মাছের। পুটি, পাবদা, চেদুরী, বাইলা, খইয়া, টেংরা ঝাকি জ্বালে আটকে যাচ্ছে ঝাকে ঝাকে। খুব সাবধানে বন্দুর পিচ্ছিল কর্দমাক্ত পথ ভাংতে হয়। কাঁদা মাটিতে ফেলে দেয়া বজুরি টেংরার কাটা ফুটতে পারে পায়ে। পচা শামুকে পা কাটতে পারে।

আকাশে বাতাস নেই। কুয়াশা শুকোতেই রোদের ত্যাজ শেষ। ঘন নীল গগনে শিমুল তুলার মত সাদা মেঘের দল, পাল তুলছে অজানায়। নীচু জমির আটকেপরা জলের কচূরী পানার ফাঁকে একঠায় দাড়িয়ে আছে ধলিবক। চিলের অভ্রন্ত চোখে ফাঁকি দিয়ে, ধানের নীচে আশ্রয় নিয়েছে ডাহুকের ছানা।

কাঁচা মাটিতে ইঁদুরের গর্তে খুঁজছে খোরাক, দুএকটা সাপ। গৃহস্তের পাতি হাঁস খালের ঘোলা জলে ডুব দিয়েছে শুমুকের লোভে। পেট থেকে বের করে খাওচ্ছে মাছ, বুড়ি বক ছানাদের, অতি উচু বট গাছের ডালে। ঘন সবুজ পাতার মোড়ক থেকে উঁকি দিচ্ছে রক্তের মত লাল কৃষ্ণচূড়ার কলি। উচূ জমির সবুজ ধনে পাতা ধানের সোনালী রং ম্লান করতে পারেনি এতটুকু।

স্যাঁত স্যাঁতে মাটিতে হাত-পা ঘুটিয়ে বুড়ির মত বসেছে ধানের লতা। সে থেকে সোনার চূলের মত ছড়াটি কেটে নিচ্ছে কৃষকের কাঁচি। অবহেলায় অথবা ভুলে ফেলে যাওয়া ধানের শিষ কোড়াচ্ছি মুন্সীদের ক্ষেতে। রতন আর বাবার পিছে। বাবা মাঝে মাঝে সবার অলখ্যে লুঙ্গির খুটি থেকে কিছু ধানের ছরা রেখে দিচ্ছে আমার ওরায়।

মেয়েদের মাথার চূলের বেনীর মত, খরের বেনা, জ্বালিয়ে আনার ছুতোয়, আনন্দে সোনার ধান রেখে আসি আমাদের শূন্য গোলায়। ধূসর নাড়ার কোথাও সবুজের ছানি। কলাই, সর্ষে মটরশুটি এরই মধ্য মেলে দিয়েছে সবুজ কঁচি পাতা। মটরশুটির ক্ষেতে নাড়া পোড়ানো হলে কুড়িয়ে খাব ভাজা মটর। অবশ্য কলাই শাক এর মধ্যে খাওয়া হয়েছে দুএক বার।

আমনের মার দিয়ে রান্না, তেতুলের টক। সকালে খীরের মত ঠান্ডা হয়ে জমে থাকে পাতিলে। সাথে দুটো পুটি মাছ। এই নাস্তায় পেট ভরে, কুয়াশায় পা ধুয়ে মায়ের সাথে বেড়িয়েছি। ক্ষেতের নাড়া তুলে ঝড়েপড়া ধান ঝাড়ু দিয়ে তুলে আনতে।

বিনিময়ে নাড়ার বোঝা পৌঁছে দিতে হবে জমির মালিকের ঘরে। অবশ্য আমি বইতে পারি এমন দুএকটা বোঝা বাড়ি নিয়ে আসি। কিন্তু মূল লক্ষ হচ্চে ধান। পুড়ো ক্ষেত ঝাট দিয়ে জড় করা খড় কুটোর ভাজে ভাজে লুকিয়ে থাকা ধান, কুলোয় নিয়ে ঝেরে আলাদা করতে হয়। দিনের শেষে মা এখন তাই করছেন।

খরের গাদায় হাড়িয়ে যাওয়া সূই খোজার চেয়ে কাজটা অনেক সহজ। ধান যা পাওয়া যাবে কুলা আর ঝাড়ু সহ তা একাই বইতে পারবেন মা। তাই গোল্লা খেলার লোভে নাড়ার বোঝাটি নিয়ে দিলাম বাড়ির দিকে ছুট। নবান্নের দিন বিদায় নিয়েছে অনেক দিন আগে। আজকাল নতুন ধানের চিড়ে আর খেজুরের গুর, এতেই নবান্ন।

তাও বাবা খেজুর গাছে ঘটি দিতে পারেন বলে কিছু রস থেকে মা গুর করেন। কিন্তু তা তরকারীর ঝোলের চেয়ে ঘন কখনোই হয়না। জ্বাল দেয়ার খড়ি এবং সময় দুই এখন সমান মূল্যবান। বাবা আর রতন প্রায় দিন রাত মুন্ষীদের বাড়িতে ধানের মাড়াই নিয়ে ব্যাস্ত। মা এ বাড়ী ও বাড়ীতে মুড়ি ভাজা দান বানা করে কিছু উপরি আয় করছেন।

মা যখন যে বাড়িতে কাজ করেন আমি দুপুরে সেখানেই দাওয়াত পাই। কার্তিকের অনাহার অর্ধাহারের দিন শেষ। তাতে আছে বাত্তি তেতুলের ভর্তা সাথে ধনে পাতা, একটু গুড়া মরিচ। সাক সব্জীর মৌষুম। ফলের আয়োজন একটু পরে হবে।

আমের মুকুল খাওয়ার উপযোগী হতে হপ্তা দুই। মুড়ি লুঙ্গির খোটায় ভরে সর্ষে ক্ষেতে মৌমাছির বাসার খোঁজ। এবার এত সর্ষে ক্ষেত হয়েছে! সর্ষের হলুদ ফুলে ঢাকা পড়েছে আর সব। খুব খোঁজা খুঁজি করতে হয় মৌঁচাক পেতে। অনেক ক্ষেত্রে বাজ পাখি আমার আগেই তার সন্ধান পেয়েগেলে আমার কপালে থাকে মৌমাছিদের ক্ষিপ্ত হুল।

বিকালে দাড়িয়া বাধা খেলা পাল বাড়ীর মাঠে। এ ছাড়া তেমন কাজ নেই শেরালীর হাতে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.