দুবলা (দুব্বা ঘাষ) বনের বাঘ
এখন তেমন কাজ কার হাতেই নেই। ক্ষেতে বীজ বোনা শেষ। একটু নিড়ানী দিতে হয় মরিচের ক্ষেতে। এই যা। হিন্দু পাড়ার সব্জী চাষীরা বাজারে মূলা, ফুলকপি, ধনে পাতা, কাঁচা মরিচ, শিম লাউ এসব বিক্রি করছে।
তাদের জমি গুলি বেশ উচু বলে সবার আগে তাদের জমিতেই এসব ফলে। তবে ব্যাবসায়ও তারা বেশ সফল। রং, দুধ, সোনা এমনকি ধোপা নাপিতের কাজ করেও দিব্যি ভাল আছে। পাড়ার সবাই মিলে দুর্গাপুজোয় গ্রামের সব লোককে নিমন্ত্রন করে । সমস্যা একটাই কলাপাতায় খেতে হয়।
আমার কাছে ওদের খাবার খুব ভাল লাগে। তার পর পূজা মন্ডপের সামনে রাত ভর কীর্তন হয়। গ্রামটা মেতে থাকে সে কয়টা দিন। অবশ্য এবছর দূর্গাপূজা আসতে অনেক বাকী। হিন্দু পাড়ায় পালবাড়ীর লোকেরাই খুব শিক্ষিত।
গৌরাঙ্গ সরকার হাই স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলেন গান্ধী পন্ডিত। ছেলেমেয়েরা সবাই বি এ, এম এ পাস। সরকারী চাকরী করে। ছোট মেয়েটি বাবার সেবা করে আর গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে মাষ্টারী করে। খুব অমায়ীক মানুষ।
এক কালে জমিদারী ছিল। তার চিহ্ন এখন রাজ বাড়ীর মত পাকা দালানের আলিশান বাড়ী। অযত্নে অবহেলায় বাগান বাড়িতে আম, জাম, কাঠাল গাছ ছাড়া আর সব আগাছা। বাড়ীর কাচারির দালানের প্রবেশ পথের দারে তুলসীর ঝোপে একা দাড়িয়ে রাজত্ব করছে রক্তজবার গাছটা। মনে হয় রক্তজবা কলার মত বার মাসী ফলের গাছ।
সব সময় টক টকে লাল রক্তজবা ফুটে থাকে। ঠাকুর মশাই কামানো মাথার এক গুচ্ছ চূলে একটা রক্ত জবা ঝুলিয়ে পূজোয় বসেন। আমার দেখে হাসি পায়। কিন্তু প্রসাদের লোভে চেপে যাই। অথচ এ বাড়ীতে নাকি পৃথিবীর সব ফুল পাওয়া যেত! তাদের শেষ চিহ্ন এখন অবহেলায় বেড়ে উঠা দুব্বা ফুলের ঝোপ।
দিন কয়েক হল, আমার ভাগ্যে একটা ছাগল জুটেছে। বাগী ছাগল। লালন পালন করে বাচ্চা দিলে একটা বাচ্চা রেখে মা সহ অন্য বাচ্চা গুলোর সাথে ছাগল মালিককে ফেরৎ দিতে হবে। রোদের তাপ বেশী দেখে পাল বাড়ীতে এসেছি। কলের পানি খেয়ে প্রাণ আর গাছের ছায়ায় বসে শরীর জুড়াব।
কিন্তু ছাগলটা খুটি ছিঁড়ে পাশের চিনা ক্ষেতে মুখ দিয়েছে। জমির মালিক দেখলে সর্বনাষ। দৌড় ছাগলের পিছু পিছু। ধরে আবার খুটায় বাধলাম। রেল সড়কের পাশের নালায় কচুড়ীপানা মানুষ সমান ঊঁচু।
ছাগল সব খায় হয়ত কচূড়ীপানাও খাবে। তাই এখন ছাগল নিয়ে সেদিকটায় যাচ্ছি। ছোঁ মেরে বাজ পাখিটা কাওন ক্ষেতের পতঙ্গ ভক্ষনে ব্যাস্ত শালিকটা ধরে আবার অকাশে ডানা মেলে দিল! আকাশের দিকে চোখ যেতেই উড়ন্ত শকূন গুলো দেখতে পেলাম। ট্রেনের ধাক্কায় মরা কোন কুকুর বা বিড়ালের গোস্ত খেতে এসেছে। বাতাস নেই বলে গন্ধ পাইনি।
কি করে শকূন গুলো মরা পশুর শরীর থেকে মাংস ছিড়ে খাচ্ছে, সে দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে ছিলাম বলে দেখতে পাইনি। রেল সড়কের পাশে পায়ে চলার পথ আছে। নির্ভয়ে সে পথে হাটা যায়। ট্রেন চলাচলের সময়ও। গাঁয়ের ভেতর দিয়ে সংক্ষেপে হাটে যাবার পথ।
সাধারণত গাঁয়ের লোকেরাই ব্যাবহার করে। এ পথে শহরের পোশাক পড়া মানুষ দেখে একটু অবাক হলাম। তাও আবার একজন নয়। এক, দুই, শত নাকি সহস্র! গুনে দেখার উপায় নাই। নিরবে নিঃশব্দে, মিছিলের লোকের মত মৌমাছির ঝাক বেধে নয়, পিপড়ের মত একজনের পেছনে একজন হেঁটে আসছে।
আমার অবাক হবার পালা শেষ না হতেই একজন বলল;
এই খোকা! এখানে কাছে কোথাও কল আছে?
এ নামে আমাকে আজও কেউ ডাকেনি। আরো অবাক হলাম। আমার অবস্থা দেখে আরেক জন বলল: খোকা ভয় পেওনা। আমরা ঢাকা থেকে হেঁটে এসেছিতো খুব পিপাসা লেগেছে। একটু পানি খেয়ে আবার চলতে হবে।
আমার এত ভাল লাগল। এমন আদর করে ভদ্র লোকেরা আমার সাথে কথা বলল! ছাগলকে কচূড়ী পানায় মুক্ত করে সাহেবদের পানি খাওয়াতে নিয়ে গেলাম পালদের বাড়ী। কল চাপার চেষ্টা করে ব্যার্থ হলাম।
তুমি ছোট মানুষ কষ্ট হবে। আমিই চাপছি।
নিজেদের মধ্যে কি বলাবলি করল। কিছু বুঝলামনা। সাহেবদের সব শুদ্ধ কথা ভাল করে বুঝি না। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে একজন বলল; যুদ্ধে যাচ্ছি কবে ফিরব কে জানে! তবে এসব শিশুরা যেন একটা মুক্ত স্বাধীন দেশে বড় হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।