আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেরালী এক- প্রকাশিকার কৈফিয়ৎ



প্রকাশিকার কৈফিয়ৎ চিরকুটটা পরেই বাকি কথা যানার কৌতুহলে কাতর হয়ে পড়লাম। সব মিলিয়ে প্রায় বছর দশেক হল আমি সেবিকা। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন রোগী আমাকে চিঠি লিখেনি। বিভিন্ন হাসপাতালে ভিন্ন ভিন্ন জিয়গায় কাজ করেছি। নান রোগীর নানন রোগের সেবা করেছি।

সরকারী চাকুরী, যখন যেখানে বদলি, সেখানেই যেতে হয়, যাই। ঢাকায় বদলি হয়ে ভালই লাগল। বড় শহরে থাকার কত সুবিধা! অনেকে ঘুষ দিয়ে ঢাকায় বদলি হতে চায়। কোন নতুন যায়গায় যাওয়ার আগে অমি এসব সুবিধাগুলির কথাই বেশী ভাবি। তাতে অনেক অযানা আশংকা নতুন দিগন্তে মেঘ হয়ে দৃষ্টি ঝাপসা করেনা।

জয়েন্ট করার দিন কয়েকের মধ্যেই নতুন কর্মস্থলের একটা ছক আঁকা হয়ে যায়। আমি এভাবেই অভ্যস্থ। আর কাজতো একটাই, সেবা। কত ভাবে কত মানুষ কত মানুষের সেবা করছে এই ভবের বাজারে , তার কি কোন হিসাব আছে কার কাছে! আমার রোগীরা সার্জনের খূর-কেঁচিতে শরীরের নষ্টহয়ে যাওয়া অংশ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছাটিয়ে নেয়। কিছুটা নাপিতকে দিয়ে চূল ছাটিয়ে নেয়ার মত।

মনের নষ্ট চিন্তা তাতে হয়তো কখনো দূর হয়, কখনো হয়না। আমি মনের না পারি কিন্তু শরিরের কাঁটা যায়গা ধুয়ে-মুছে সাফ করি। এইতো। অনেক সময় রোগীর শরীরে আগেই ছুরি ঢোকানো থাকে। আমরা সেটা বের করি, যতটুকু সম্ভব অঙ্গহানি না ঘটিয়েই।

স্কুলের মাষ্টারের মত আমাদের কাউকে কিছু শেখাতে হয়না। পরিক্ষা নিতে হয়না। পরিক্ষার খাতা দেখে পাশ-ফেল করাতে হয়না। বছরের পর বছর কেউ হাসপাতালে রোগী হয়ে থাকেনা। কাজেই তাদের সাথে কোন ব্যাক্তিগত সর্ম্পক যেমন, শত্রু-মিত্রুতা তৈরী হয়না।

অনেক রোগীরই মন-মেজাজ খারাপ থাকে। সেটাই স্বাভাবিক। শরীর সুস্থ্য থাকলেই তো মন সুস্থ্য থাকবে! আমরা তার জন্য প্রস্তুত হয়েই থাকি। রোগীর বাঁচা মরা ভগবানের হাতে। আমাদের যতটুকু করার আমরা করি।

এভাবেই গত দশ বছর এ পেশায় আছি। দিন কতক আগে এক রোগী আমার হাতে এই লেখাটা ধরিয়ে দেয়। এটা যেহেতু ইমার্জেন্সী বিভাগ না, তাই কোন রোগী কি রোগ নিয়ে আসছে তা আগাম যানা থাকে। সরকারী রোগী হলে তো কথাই নেই। কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে এক রোগীর ফাইল এল।

পেঠে বাতাস। এ আর এমন কি! ফুস ফুস ফেটে পেটে বাতাস ঢুকেগেছে। পেট ফুটোকরে বাতাস বেরকরে দিলেই হল। এতে মরার ভয় নেই। কিন্তু মিষ্টার খূনী শেরালীর অপারেশন করানো হচ্ছে তাকে মারার জন্য মিসেস বড়ুয়া।

কথাটা বলে বিজ্ঞের মত মাথা দোলালেন সার্জন। থতমত খেয়ে বললাম মানে? অসুস্থ মানুষকে আইনত ফাঁসি দেয়া যায়না। আর তাই শেরালীকে অপারেশন করে সুস্থ করে তুলতে হবে, যাতে ওর ফাঁসির আদেশ কার্য়করি করা যায়। এমন কথা কেউ প্রতিদিন শোনে! অবাক কান্ড! আমি একজন মানুষকে সুস্থকরে তুলব, যাতে তার মৃত্যু হয়? মিষ্টার শেরালীও এই ক্ষুদ্রজীবনে অনেক মানুষ মেরেছে। সান্তনার সুরে বললেন সার্জন।

ও বাবা খূনী! সবাই আতকে উঠলাম। সাজর্ন অভয় দিয়ে বললেনঃ ওনার পাহারায় পুলিশ থাকবে। তাছারা ওনিতো আর ছোরা পিস্তল নিয়ে এখানে গুন্ডামি করতে আসবেননা। পরদিন যথা সময় রোগী এল। এই পুচকে ছোকরাটা খূন করতে পারে, ভেবে অবাক হলাম।

কিন্তু কয়েক দিন পরে ফঁসি ঝুলবে মনে করে মায়াও হল। সবাই কেমন করছে। কেউই রোগীর কাছে যেতে চাইছেনা। অগত্যা আমাকেই যেতে হল। (সত্যি বলতে কি, আমার যেতে ইচ্ছেও করছিল।

ভয় আর কৌতুহলের দোলায় আমি দুলছি)। কেমন আছেন? দরজা বন্ধ করতে করতেই বললাম। ভাল। সংক্ষিপ্ত উত্তর রোগীর। তাপ প্রেসার সব নোটকরে নিলাম।

ছোকরা যথেষ্ট নির্বিকার রইল। বাধা-বিপত্তিও ঘটালনা আবার আগবারিয়ে সহযোগিতাও করলনা। কাল সকালে আপনার অপারেসন। বলেই দরজার দিকে ফিরছিলাম। পিছন থেকে ডাকলঃ সিষ্টার! বাধ্যহয়ে ফিরে তাকাতে হল।

একটু কাগজ আর একটা কলম ... যাহ বাবা বাঁচালে। যা ভয় পেয়েছিলাম। না যানি কি চেয়ে বসে। রোগীদের অভিযোগের শেষ নেই। ময়লা বিছানা থেকে শুরু করে পাশের রোগীর নাকডাকা পর্যন্ত হাজারো অভিযোগ।

যেন নিজের ড্রয়িংরুম। অনেক প্রমিনেন্ট রোগী এখানে যৌনকর্মীর সহচর্য্য কামনা করেন বলেও শুনেছি। এ তো সামান্য কাগজ। কত ওষুধ কোম্পানী বান্ডিল করে নিযের নাম ছাপানো কাগজ কলম এথানে রেখে যায়! এ আর এমনকি, দেব কয়েকটা এনে। তবুও, প্রথমেই আস্কারা দিলে মাথায় উঠবে।

তাই মনের ভাব চেপেরেখে বললামঃ এটা কোন কাগজ কলমের দোকান নয়। আমি যানি। তাহলে চাইছেন কেন? অন্য উপায় নেই বলে। পরিস্থিতি অনুকূল দেখে, বললামঃ ঠিক আছে ভেবে দেখব। খুব স্বাভাবিক এবং সাধারণ ভাবেই এখানে ওর দিন ফুড়াল।

পুড়োণো রোগীর বিছানা ঘুটিয়ে নতুন রোগীর জন্য বিছানা পাততে হবে। বালিশটা সরাতেই প্রথমে এই চিরকূটটা চোখে পড়ল। সিষ্টার কিরণময়ী, দয়াময়ী হয়ে সেবা করার জন্য ধন্যবাদ। বকসিষ না হউক, হাতে কোন অর্থকড়ি থাকলে অন্ততঃ কিছু উপহার দিতাম। জীবনের শুরু না হতেই শেষে পৌঁছে গেলাম।

এ আর এমন কি। কত ভ্রুন মায়ের পেটেই জীবনের শেষ ঘটায়! দুনিয়ার আলো বাতাস না দেখেই। সেতো আপনি নিজেই যানেন। মরতেতো একদিন হতোই। এ নিয়ে আক্ষেপ নেই।

বরং একরকমের মুক্তির হাতছানি। অনিশ্চিৎ নশ্বর জগতে আমার মৃত্যু অন্ততঃ একটা নিশ্চিৎ ব্যাপার। খুব কম মানুষই জীবিতাবস্থায় মৃত্যুর দিন-ক্ষন যানতে পারে। আমি সে বিড়ল সৌভাগ্যবানদের একজন। শেষ ইচ্ছের মত, কিছু কথা কাউকে বলতে ইচ্ছে করল।

আপনার এত কাজের ফাঁকে, আমার অর্থহীন প্রলাপ শোনার সময় কৈ। তাই লিখে রেখেগেলাম। আপনার যা ইচ্ছে, করুণ। বহুজন্মে বিশ্বাষ করলে, পরের জনমে কিরণময়ী হয়ে জন্মাতাম। আর মানুষের সেবা করতাম।

সুভেচ্ছান্তেঃ মোঃ শেরালী মাওলা। অনেকদিন অনেকবার পড়েছি। ভাল-মন্দ বুঝিনি। কিন্তু দায়ীত্ব নিয়ে কাগজগুলো ফেলেও দিতে পারিনি। তাই আপনাদের হাতে তুলে দিচ্ছি।

বিণীতা কিরণময়ী বড়ুয়া।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.