জামায়াতে ইসলামীর মগবাজারের কেন্দ্রীয় ও পল্টনের মহানগর কার্যালয় দীর্ঘ দুই বছর ধরে অবরুদ্ধ। ঝুলছে তালা। আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর এ অবস্থার দুই বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। দলটির ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরেরও একই অবস্থা। এ ছাড়া সারা দেশের অন্য কার্যালয়গুলোরও চিত্রও একই। মামলার জালে আটক নেতা-কর্মীরা। সরাসরি এখনো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা না হলেও অঘোষিতভাবে তাদের সব কাজকর্মই এখন নিষিদ্ধ। দলীয় কার্যালয়ে যেতে না পেরে নিজেদের বাসাবাড়িতে বা কোনো অফিসে ঘরোয়াভাবে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশ ধরে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তবে কার্যালয় বন্ধ থাকলেও থেমে নেই দলটির কার্যক্রম। ফলে সঙ্গত কারণেই জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কে চালাচ্ছে জামায়াত? কীভাবে চলছে দলটির কার্যক্রম। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দলটির ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমদ একাধিক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ারা নিয়েই নেতা-কর্মীদের বাসা-বাড়ি, ব্যক্তিগত অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মিলিত হচ্ছেন অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে। মোবাইলের এসএমএস এবং ফেসবুকের মাধ্যমে নেতা-কর্মীরা তৃণমূলে যোগাযোগ রাখছেন। নিত্যনতুন সিমকার্ড ব্যবহার করেন তারা। অজ্ঞাত স্থান থেকে নিয়মিত সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি বিবৃতিও পাঠাচ্ছেন। দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের মতে_ সরকার যত জেল, জুলুম নির্যাতনই করুক না কেন- জামায়াতে ইসলামীকে কখনোই ধ্বংস করতে পারবে না ইনশাল্লাহ। আর জামায়াতে ইসলামীর দলীয় শৃঙ্খলা এতটাই শক্তিশালী যে, সর্বশেষ একজন কর্মী অবশিষ্ট থাকা পর্যন্তও এই দলে নেতৃত্বের অভাব হবে না। দুই বছর ধরে কার্যালয় বন্ধ কেন জানতে চাইলে দলটির কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ এমপি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বেআইনিভাবে জামায়াতের কার্যালয় বন্ধ করে রেখেছে সরকার। জামায়াতে ইসলামী একটি নিবন্ধিত দল। প্রতিটি জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। সরকার যে আচরণ করছে তা সংবিধান ও গণতন্ত্রের পরিপন্থী। জামায়াতের পক্ষ থেকে দাবি করে বলা হয়েছে_ 'তাদের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সারা দেশে ২৬ হাজার মামলা দায়ের করেছে সরকার। এতে আসামি পাঁচ লক্ষাধিক। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করা হয়েছে ৪৩ হাজার নেতা-কর্মীকে। যার অধিকাংশ বর্তমানে জামিনে আছেন। তাছাড়া জামায়াত-শিবিরের ২৪৩ জন নেতা-কর্মী রাজপথের আন্দোলনে নিহত হয়েছেন।'
এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বিচারের কাঠগড়ায়। এসব মামলার রায় প্রকাশকালে সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই এখন কারাগারে, বাকিরা পলাতক। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত ছয়টি মামলার রায়ের মধ্যে পাঁচটিতেই পুরো দলটিকেই অপরাধী সংগঠন হিসেবে অভিযুক্ত করেন আদালত। এমনকি দলটির নিবন্ধনকেও অবৈধ আখ্যায়িত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে যে, আগামী নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণের বিষয়টি অনিশ্চিত। তবে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে আদালতের চূড়ান্ত রায়ের ওপর। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন এখন ঝুঁকিতে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দলের শীর্ষ নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড এবং অপর দুই নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমকে ৯০ বছর ও আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। দলের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলার কার্যক্রমও শেষ পর্যায়ে। অপর চার নেতা এ কে এম ইউসুফ, আবদুস সুবহান, এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও মীর কাসেম আলীর প্রাক-বিচার কার্যক্রম চলছে। এ অবস্থায় জামায়াত তার অস্তিত্বের সঙ্গেই লড়াই করছে। দলের ২১ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের ১২ জন কারাগারে, সাতজন বিভিন্ন মামলায় আত্দগোপনে। বাকি দুজনের একজন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতাদের পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। তিনি আইনি বিষয়াদি ছাড়া দলের সাংগঠনিক কিংবা অন্য কোনো কর্মকাণ্ডে সক্রিয় নন। অপরজন ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাছের মো. আবদুজ জাহের, তিনিও দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে আছেন। দলের ঢাকা মহানগর কমিটির সবাই আত্দগোপনে। পলাতক থেকেই দল চালাচ্ছেন মধ্যম সারির নেতারা। ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাকরাইলে পুলিশের সঙ্গে সহিংস সংঘর্ষের পর থেকে দলের মগবাজারের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কার্যালয় বন্ধ রয়েছে। এমনকি তারপর থেকেই তাদেরকে রাস্তাঘাটেও নামতে দেয় না পুলিশ। কোথাও কোনো মিছিল করতে গেলে হঠাৎ করেই কোনো গলি থেকে খণ্ড খণ্ডভাবে জঙ্গি মিছিল বের করেই আবারও সেই গলিতে ঢুকে যেতে হয় তাদের। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে নীরবতা বিরাজ করছে জামায়াত-শিবিরের কার্যালয় দুটিতে। ২৪ ঘণ্টাই কড়া পুলিশ প্রহরায় ঘেরা কার্যালয়গুলো। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মূল ফটক বন্ধ। ফটকের সামনে পর্যাপ্ত পুলিশ অবস্থান করছে। পকেট গেট দিয়ে প্রবেশ করে দেখা গেছে_ অফিস দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন দুজন সিকিউরিটি গার্ড। মূল ভবনে প্রবেশের দরজা বন্ধ। এ প্রসঙ্গে হামিদুর রহমান আযাদ এমপি বলেন, নেতা-কর্মীরা রাস্তায় চলতে পারছে না, অফিস করতে পারছে না, মিথ্যা মামলায় হয়রানি, গ্রেফতার ও নির্যাতন করছে সরকার। এ অবস্থায় কীভাবে কার্যালয়ে যাবে? তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় অফিসে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান ডবি্লউ মোজেনা আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার তাও ষড়যন্ত্র করে বানচাল করে দিয়েছে। সূত্রটি আরও জানায়, চলতি বছর ২১ মার্চ অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান ৫ মিনিটের জন্য পুরানা পল্টনের মহানগর কার্যালয়টিতে প্রবেশ করেছিলেন কিছু নথিপত্র সংগ্রহের জন্য। মহানগর কার্যালয়ের পাশে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের যৎসামান্য তৎপরতা দেখা যায় মাঝে মধ্যে। জানা যায়, ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কাকরাইলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর থেকেই দলটির কেন্দ্রীয়সহ সারা দেশের কার্যালয়গুলো বন্ধ হতে শুরু করে। মাঝে মধ্যে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশ কিংবা ডিবি পুলিশের সদস্যরা চক্কর দিয়ে যান। খবর নেন নেতা-কর্মীরা আসেন কি না, সভা হয় কি না। কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পেতে প্রথম দিকে কোনো অসুবিধা না হলেও যতই দিন যাচ্ছে অসুবিধা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ঢাকা মহানগরসহ অন্যান্য কার্যালয়গুলোরও একই অবস্থা। কার্যালয়ের সামনে সব সময়ই পুলিশ সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা যায়।
সাংগঠনিক তৎপরতা : জামায়াতে ইসলামীর কার্যালয়গুলো বন্ধ থাকলেও থেমে নেই তাদের কার্যক্রম। জামায়াত নেতাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আর বাসাবাড়ি থেকে পরিচালিত হয় তাদের কার্যক্রম। এসব জায়গা থেকেই তারা দিনের পর দিন সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। অজ্ঞাত স্থান থেকে সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। গত দেড় যুগে জামায়াত কেন্দ্রীয় ও মহানগর কার্যালয় এ রকম নেতা-কর্মী শূন্য থাকেনি। কীভাবে দলের কার্যক্রম চলছে জানতে চাইলে হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জামায়াত গণতান্ত্রিক দল। জনগণকে নিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম অব্যাহত আছে। প্রমাণ হয়েছে অফিস বন্ধ করে, নির্যাতন চালিয়ে কোনো গণতান্ত্রিক দলকে ও তার কার্যক্রমকে বন্ধ রাখা যায় না। জানা যায়, জামায়াত আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে দলটির সমঝোতা হচ্ছে এমন খবরও শোনা যাচ্ছে। সমঝোতার ক্ষেত্রে দলের শীর্ষ নেতা শফিকুল ইসলাম মাসুদ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলেও সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়। এ বিষয়ে শফিকুল ইসলাম মাসুদের একাধিক মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক নেতা সরকারের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি আপাতত অস্বীকার করে বলেন, এখনো পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তের কথা আমাদের জানা নেই। তারমতে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের কোনো রকমের সমঝোতার আর প্রশ্নই ওঠে না।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।