বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ের খসড়া কপি ফাঁস হয়েছে বলে স্বীকার করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার দফতর। এ ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বাদী হয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। জিডি নম্বর-৮৫। গতকালই জিডির তদন্তভার আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মারুফ আহমেদ।
সাকা চৌধুরীর রায় নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে তা ষড়যন্ত্রমূলক বলে দাবি করেছেন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম।
এ ছাড়া রায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার আগেই ওয়েবসাইটে প্রকাশ হওয়ার ঘটনাকে 'ষড়যন্ত্র ও দুঃখজনক' বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনে ট্রাইব্যুনালের বক্তব্য : গতকাল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ জানান, রায়ের খসড়ার অংশবিশেষ ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটারে কম্পোজ করার পর তা কোনোভাবে ফাঁস হয়েছে। একই সঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শামীম হাসনাইনকে সাকার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে দেওয়া হয়নি বলে যে অভিযোগ উঠেছে তাও সঠিক নয় বলে জানান তিনি।
নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বলেন, রায়ের খসড়া কপির কিছু অংশ কোনো না-কোনোভাবে ফাঁস হয়েছে। তবে চূড়ান্ত রায়ের সঙ্গে ফাঁস হওয়া রায়ের অনেক জায়গায়ই মিল নেই।
এটা রায় প্রকাশের অনেক আগেই 'লিকড' হয়েছিল। রায় ঘোষণার আগের রাতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি বলেন, চূড়ান্ত রায় প্রকাশের আগে থেকেই সেটা ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটারে খসড়া আকারে প্রস্তুত করা হয়। কয়েক দিন ধরে খসড়া প্রস্তুত করার সময় এটা ফাঁস হয়ে থাকতে পারে। ট্রাইব্যুনালের কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জিডিতে যা উল্লেখ আছে : ১ অক্টোবর মঙ্গলবার 'ট্রাইব্যুনাল-১'-এ বিচারাধীন আইসিটি বিডি মামলা নম্বর ০২/২০১১-চিফ প্রসিকিউটর বনাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় প্রচারের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু রায় ঘোষণার পর পরই আসামি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে জানান যে ওই মামলার রায়ের কপি তারা ইন্টারনেটেরে মাধ্যমে আগেই প্রাপ্ত হয়েছেন। আসামি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে আদালত থেকে রায়ের কপি সরবরাহ করার আগেই একটি ডকুমেন্ট ক্যামেরার সামনে প্রদর্শন করে বলেন, এই সেই ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত রায়ের কপি, যা তারা রায় ঘোষেণার আগেই প্রাপ্ত হয়েছেন এবং সেটি নিয়েই তারা আদালত কক্ষে প্রবেশ করেছেন। তিনি আরও বলেন, আদালত থেকে প্রচারিত রায় এবং ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত রায়ের মধ্যে মিল রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রচারিত সব রায় ট্রাইব্যুনালেই প্রস্তুত করা হয়।
রায় ঘোষণার আগে রায়ের কোনো অংশের কপি অন্য কোনোভাবে প্রকাশের সুযোগ নেই। কিন্তু এর পরও কথিত খসড়া রায়ের অংশ কীভাবে ইন্টারনেটে প্রচারিত হলো বা কীভাবে ট্রাইব্যুনাল থেকে খসড়া রায়ের অংশবিশেষ ফাঁস (লিকড) হলো, তা উদ্বেগের বিষয়। বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার প্রতি হুমকিস্বরূপ। উল্লেখ্য, www.tribunalleaks.be ওয়েবসাইটে কথিত খসড়া রায়ের অংশ আপলোডেড দেখা যায়। এ অবস্থায় বিষয়টি তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হলো।
জিডির তদন্তের ব্যাপারে ডিবির (দক্ষিণ) উপ-কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় জানান, অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এতে অনেক বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া হবে। খুব শীঘ্রই এর রহস্য উন্মোচন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঘটনাটি 'ষড়যন্ত্র' : সাকা চৌধুরীর রায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার আগেই ওয়েবসাইটে প্রকাশ হওয়ার ঘটনাকে 'ষড়যন্ত্র ও দুঃখজনক' বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। গতকাল তিনি এ ঘটনাকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে বিতর্কিত করার হীন চেষ্টা বলেও উল্লেখ করেন।
মঙ্গলবার সাকার রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খোন্দকার মাহবুব হোসেনের 'বিচারের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিচার করা হবে' মর্মে দেওয়া বক্তব্য এবং 'রায় আগের রাতেই প্রকাশিত হয়েছে' মিডিয়ায় প্রচারিত সাকার আইনজীবী ও পরিবারের এমন বক্তব্যের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এসব কথা বলেন। বুধবার সকালে এ দুটি বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের নজরে আনেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু। এ সময় বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এখানে 'মস্তবড় ইনভেস্টমেন্ট ও ষড়যন্ত্র' হয়েছে।
আইন প্রতিমন্ত্রী যা বললেন : গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে তা ষড়যন্ত্রমূলক। শাহবাগ থানায় জিডির পর বিষয়টি ডিবি পুলিশ তদন্ত করছে।
রায়ের পর সুপ্রিম কোর্ট বারে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা খোন্দকার মাহবুব হোসেন বিভ্রান্তিকর নানা কথা বলেছেন।
তিনি অভিযোগ করেন, খোন্দকার মাহবুব হোসেন এ বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচারের কথা বলেছেন। তার এ কথা প্রচ্ছন্নভাবে হুমকির শামিল। তিনি চরমভাবে আদালত অবমাননা করেছেন। ট্রাইব্যুনাল তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তবে খোন্দকার মাহবুব হোসেনের মতো একজন আইনজীবী বিচারব্যবস্থা ও আইনের শাসন নিয়ে এভাবে মন্তব্য করলে আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হয়। এ সময় তিনি অবিলম্বে খোন্দকার মাহবুব হোসেনকে তার এ বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। প্রসঙ্গত, সোমবার রাতে 'সাকা চৌধুরীর রায়ের কপি ভারপ্রাপ্ত আইন সচিবের অফিসের কম্পিউটারে পাওয়া গেছে' এমনই একটি গুজব প্রথমে প্রকাশিত হয় ব্লগসহ বেশ কিছু সামাজিক ওয়েবসাইটে। এরপর বেশ কয়েকটি অনলাইন মাধ্যম এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। মঙ্গলবার রায় ঘোষণার পর দেখা যায় প্রকাশিত রায় ও ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায় মিলে গেছে।
রায় পড়াকালীন সাকা চৌধুরী ট্রাইব্যুনালকে জানান যে রায়ের কপি দুই দিন ধরে অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। রায় ঘোষণার আগে ও পরে সাকা পরিবারের সদস্যরা একই অভিযোগ করেন। তবে আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মোহাম্মদ জহিরুল হক বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।