লড়াই করে জিততে চাই
জোর লড়াই চলছে! একদল লড়ছে সিংহাসন টিকিয়ে রাখতে, আর একদল পুরোনো সাম্রাজ্য পুনোরুদ্ধারে। কিন্তু এখনও ভবিষ্যত শাসক সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না! কে আসবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায়? পুতুল? না কি পুতুলের মা? হয়তো উল্লেখ করা বাতুলতা তারপরও বলা ভালো, খালেদা জিয়ার ছোটবেলার নাম ‘পুতুল’, আর শেখ হাসিনার মেয়ের নাম ‘পুতুল’! আবারও একটি পুতুল সরকার বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের ঘাড়ে চেঁপে বসবে, সেটা নিশ্চিত! কারণ পুতুল সরকারের বাইরে চিন্তা করার মতো রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমান বাংলাদেশে নাই।
পূর্বের কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে আচ করার চেষ্টা করা যেতে পারে ভাগ্যবতী নারীর নাম।
১৯৯১ সালের নির্বাচন থেকে সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচন, এই চারটি জাতীয় নির্বাচনকে আপাতদৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। সে কারণেই আমরা এই চারটি সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের দিকে একটু তাঁকাইঃ
নির্বাচন ১৯৯১:
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ছিলো ৩০.৮১%, আর প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিলো ১৪০টি! সেখানে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ছিলো ৩০.০৮%, আর প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিলো ৮৮টি।
প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিলো মাত্র ০.৭৩%, কিন্তু প্রাপ্ত আসনের সংখ্যায় ছিলো বিশাল ব্যবধান।
নির্বাচন ১৯৯৬:
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ছিলো ৩৩.৬০%, আর প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিলো ১১৬টি! সেখানে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ছিলো ৩৭.৪৪%, আর প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিলো ১৪৬টি। ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুইদলই পুরো তিনশ আসনে দলীয় প্রার্থী দিয়েছিলো। লড়েছিলোও সমানে সমান। প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিলো মাত্র ০৪.১৪% কিন্তু প্রাপ্ত আসনের সংখ্যায় ব্যবধান ছিলো ৩০টি।
নির্বাচন ২০০১:
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ছিলো ৪০.৯৭% আর প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিলো ১৯৩টি! সেখানে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ছিলো ৪০.১৩%, আর প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিলো ৬২টি। প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিলো মাত্র ০.৮৪%, কিন্তু প্রাপ্ত আসনের সংখ্যায় ব্যবধান ছিলো ১৩১টি।
নির্বাচন ২০০৮:
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ছিলো ৩২.৫০%, আর প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিলো ৩০টি! সেখানে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ছিলো ৪৮.০৪%, আর প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিলো ২৩০টি। প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিলো মাত্র ০৫.৫৪% কিন্তু প্রাপ্ত আসনের সংখ্যায় ব্যবধান ছিলো ২০০টি।
বিগত এই চারটি জাতীয় নির্বাচন বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ভোটের ব্যবধান কখনও খুব বেশি ছিলো না।
সামান্য ভোটের ব্যবধানই সব সময় প্রাপ্ত আসনের বড় ব্যবধান তৈরী করেছে। নৌকা বা ধানেরশীষের ভোটের তেমন নড়চড় হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সমর্থকরা তাদের সমর্থন পরিবর্তন করছেন না। আমরা যদি সাম্প্রতিক পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের ফলাফলের দিকে লক্ষ্য করি, সেখানেও দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। যার অর্থ হচ্ছে এখনও এই ২০১৩ সালের শেষ দিকে এসেও দেখা যাচ্ছে নৌকা-ধানেরশীষের ভোটারদের অবস্থান অপরিবর্তীতই আছে।
নিজ নিজ দলের পক্ষেই তারা ভোট দিচ্ছেন। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?? প্রায় সমান সমান ভোট পেয়েও আসন সংখ্যায় কেন এত বিশাল ব্যবধান তৈরী হচ্ছে? কারা এর জন্য দায়ী?
এই প্রশ্নের একটাই উত্তর, নির্দলীয় ভোটার! নির্দলীয়, নিরপেক্ষ বা দোদুল্যমান ভোটাররাই বারবার তাদের সমর্থন পরিবর্তন করছেন। নিরদর্লীয় ভোটাররাই মূলত প্রাপ্ত আসনের সংখ্যার পার্থক্যটা গড়ে দিচ্ছেন। নির্দলীয় ভোটারদের সংখ্যাটা যদিও খুব বেশি নয় কিন্তু জয়-পরাজয় নির্ধারণে তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আগামী জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ, বিএনপির ভোটাররা নিজ নিজ দলের পক্ষে ভোট দিবেন, এটা নিশ্চিত।
তাদের অবস্থান পরিবর্তন হবার নয়। কিন্তু সেই ফলাফল নির্ধারণী নির্দলীয়, নিরপেক্ষ বা দোদুল্যমান ভোটারদের অবস্থান কি পরিবর্তন হবে?? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আর একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ! সেটা হচ্ছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন কি বিএনপিকে নিয়ে হবে? না কি বিএনপি ছাড়া?
বিএনপি সহ নির্বাচনঃ
বিএনপিকে জামায়াত ছাড়াই নির্বাচন করতে হবে। তাছাড়া বিএনপির সংস্কারপন্থি, মনোনয়ন বঞ্চিত বড় একটা অংশ সরাসরি বিএনপির বিরোধীতায় চলে যেতে পারে। যাদের কেউ কেউ নৌকার টিকিট পেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এমনকি হেফাজতের ক্ষেত্রেও বিরাট বিভক্তি দেখা যেতে পারে।
হেফাজতের একাধীক শীর্ষনেতাও আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে কাজ করতে পারে, পেতে পারে দু’একটি নৌকার মনোনয়নও। সেক্ষেত্রে বিএনপির ভোটের সাথে দলগতভাবে শুধুমাত্র জামায়াতের ভোট যোগ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। জামায়াত গত জাতীয় নির্বাচনে ভোট পেয়েছিলো ৪.৭০%! অন্যদিকে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ বা দোদুল্যমান ভোটারদের বড় অংশ সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের নানান অপশাসনের বিরুদ্ধে গিয়ে বিরোধী দলকেই ভোট দিয়ে থাকে। বিগত নির্বাচনগুলো সেই স্বাক্ষ্যই দেয়। আওয়ামী লীগের পদ্মাসেতু ব্যর্থতা, তিস্তা চুক্তি ও সিমান্তচুক্তির ব্যর্থতা কিছু এলাকায় নৌকার ভোট কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে।
ফেসবুকার-ব্লগারদের মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারা নামক ব্লাসফেমী আইনও তরুণ প্রজন্মের নৌকায় ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হিসাবে সামনে আসতে পারে। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে না ঝুলানো, হলমার্ক কেলেঙ্কারীর মতো ব্যাংক ডাকাতি, রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র তৈরীতে একরোখা নীতি, মনোনয়ন বঞ্চিতদের বিরুদ্ধাচারণ, এমনকি ভারততোষণ এবং নাস্তিকপালনের অপবাদও আওয়ামী লীগের ভোটে ভাটার টান আনতে সহায়তা করতে পারে।
কঠিন প্রতিকুলতা সত্ত্বেও বিএনপির ক্ষেত্রে তাদের প্রধান সুবিধা তারা বিরোধী দলে। বিএনপির নিজস্ব ভোট, জামাতের ভোট এবং নির্দলীয়, নিরপেক্ষ বা দোদুল্যমান ভোটের বড় অংশটা যুক্ত হলেই বিএনপির জন্য যথেষ্ট। তাই যদি নূন্যতম নিরপেক্ষ ভোটও হয়, এরশাদ বা জিয়ার আমলের মতো যদি ভোট ডাকাতি না হয়, তাহলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির জয় ঠেকানোর কোন উপায় হয়তো নেই।
সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা তিন অংকে না পোঁছালেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বিএনপি ছাড়া নির্বাচনঃ
বিএনপি ছাড়া নির্বাচনের হিসাব খুবই সহজ। কারণ বিএনপির নিজস্ব ভোটারদের অবস্থান বদলাবে তখন। ধানেরশীষের সমর্থকদের বড় একটা অংশ ভোট কেন্দ্রে না গেলেও বাকীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্য থেকেই প্রার্থী বাছাই করে ভোট দিবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নিজস্ব ভোটারদের ভোটের নড়চড় হওয়ার সম্ভাবনা নেই এবং নির্দলীয়, নিরপেক্ষ বা দোদুল্যমান ভোটের বড় অংশও মহাজোটের দিকেই আসবে।
বিধায় ভোটে মহাজোটের বিশাল জয় অবশ্যম্ভাবী।
বাংলাদেশের বাস্তবতা এখন এমন যে, বিএনপি বা আওয়ামী লীগের যে কোন এক দল যদি নির্বাচনে না যায় তাহলে সেই নির্বাচন একদলীয় নির্বাচন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং দেশে বিদেশে সে নির্বাচন হবে প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি যদি অন্য সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তবুও। তাই এই নির্বাচনে বিএনপিকে বাদ দিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার সুযোগ নেই।
কিন্তু কথা হচ্ছে আওয়ামী লীগ কি বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাচ্ছে? অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে গড়াচ্ছে।
২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরেই আওয়ামী লীগ ‘উন্নয়ন পরিকল্পনা ২০২১’ প্রণয়ন করে। এখনও শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের নেতারা বার বার যে কোন উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই ২০২১ সালের টার্গেট তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে, ২০২১ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান সম্পর্কীত যাবতীয় ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হবে। অর্থাত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়তে হলে আওয়ামী লীগকে ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতেই হবে। মনে হচ্ছে সেই ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার টার্গেট নিয়েই এগুচ্ছে বর্তমান মহাজোট সরকার।
তবে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকার সমূহ সম্ভাবনাও আছে।
রাজপথের আন্দোলনে বিএনপি খুবই দুর্বল, সেটা প্রমাণিত। বিএনপির আন্দোলনের মুল শক্তি জামায়াত দল হিসাবে নিষিদ্ধ হওয়ার পথে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেই শীর্ষ রাজাকারদের যেমন ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে পারে তেমনি দল হিসাবে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতেও পারে। আদালতই সে রায় দিতে পারে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াত-শিবির স্রোতের বিপরীতে গোপন রাজনীতিতে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সামর্থ্ হলেও বিএনপিকে আন্দোলনে সহায়তা দেয়ার শক্তি তাদের আর হয়তো থাকবে না।
বিএনপিতেও এর মধ্যে আরো বিভক্তি দেখা দিতে পারে। আর সেক্ষেত্রে মহাজোট সরকারকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার মতো রাজনৈতিক শক্তির ঘাটতি দেখা দেবে বলেই মনে হয়।
তাই আওয়ামী লীগ ২০২১-এর স্বপ্ন দেখতেই পারে। এর মধ্যে বাংলাদেশের জনগণ অনেক কিছু পেয়েও যেতে পারে। এই যেমন, পদ্মা সেতু, দুর্মূল্য হলেও পর্যাপ্ত বিদ্যুত, ফোর জি, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
ফলাফল আবারও পুতুলের মায়ের সরকার! মহাজোটের সরকার! আরো কতো দিন মহাজোট ক্ষমতায় থাকবে তা সময়ই বলে দেবে!!
পাঠক লাল গোলদার
০৫ অক্টোবর ২০১৩
মেলবোর্ন, অষ্ট্রেলিয়া
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।