আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চলমান সংকট, গ্রেফতার এবং তারপর?

দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। শুরু হয়েছে পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা। বিরোধী দলের ৭২ ঘণ্টার হরতাল আহ্বানের জবাবে সরকার বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করার পদক্ষেপ নিয়েছে। মনে হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়াও যে কোনো সময় সরকারের অতিথি হতে পারেন। ক'দিন আগে বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, কাশিমবাজার কারাগারের মহিলা ওয়ার্ড ঘষে মেজে পরিষ্কার করা হচ্ছে। তার পর থেকে এমন আশঙ্কা অনেকের মনেই উঁকি দিতে শুরু করেছে। সবারই জানা, প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন করে বিদ্যমান সংকটের সমাধানে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আশা করা হয়েছিল দুইপক্ষ আলোচনায় বসে দশম সংসদ নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে সে বিষয়ে সমঝোতায় উপনীত হবে। কিন্তু দুই পক্ষের অনড় ভূমিকায় তারা আদৌ সংলাপে বসবেন কিনা সে সংশয় দানা বেঁধে উঠেছে। একপক্ষ চাইছে যেভাবেই হোক ক্ষমতায় অাঁকড়ে থাকতে। আরেকপক্ষ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এতই মরিয়া যে, কোনো নীতি আদর্শকেই পাত্তা দিতে চাচ্ছে না।

সন্দেহ নেই বিদ্যমান সংকটের শুরু তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের কারণে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এ পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়। সাংবিধানিক চেতনার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবস্থান সাংঘর্ষিক হওয়ায় সর্বোচ্চ আদালত এ পদ্ধতিকে বাতিল করেন। সর্বোচ্চ আদালত সংঘাত এড়াতে আরও দুই মেয়াদে শর্তসাপেক্ষে এ পদ্ধতি চালু রাখা যেতে পারে এমন দিকনির্দেশনাও দেন তাদের রায়ে। আশা করা হয়েছিল সরকার ও বিরোধী দল সংসদে বসে অন্ততপক্ষে আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো পদ্ধতির নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা যাচাই করে দেখবে। কিন্তু জাতি অবাক হয়ে দেখল সংবিধান সংশোধনে কমিটি গঠন করা হলেও বিরোধী দল তাতে অংশ নেয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করলে বিরোধী দল সেটিকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে তা জেনেও ক্ষমতাসীনরা বাঁকা পথের আশ্রয় নিল। একতরফাভাবে সংবিধানে যে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হলো, তাতে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হলো।

এ কথা ঠিক, দুনিয়ার সব গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। নির্বাচনের মূল দায়িত্বে থাকে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু বাংলাদেশে দুটি কারণে অন্যসব গণতান্ত্রিক দেশের মতো দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকতে নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব। প্রথমত, আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন নামে স্বাধীন হলেও কার্যক্ষেত্রে ঠুঁটো জগন্নাথ জাতীয় একটি সংস্থা। সব ক্ষেত্রেই তারা সরকারের মুখাপেক্ষী। নির্বাচন কমিশন তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আমাদের দেশে যেভাবে দলীয়করণের শিকার হচ্ছেন তাতে তারা দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবেন এমন আশা দুরাশার শামিল।

বিরোধী দল নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে দাবি জানাচ্ছে তা এখন তার দলীয় দাবি নয়। এটি বিএনপির একার দাবি যেমন নয়, তেমন ১৮ দলের দাবিও নয়। বরং এটি এখন গণদাবি। যারা বিএনপির নাম শুনতে প্রস্তুত নন, যারা জামায়াত-বিএনপির নাম শুনলেই সমালোচনায় মুখর হন তাদের এক বড় অংশও মনে করেন নিরপেক্ষ নির্বাচন চাইলে আমাদের দেশের বাস্তবতায় নির্দলীয় সরকারের বিকল্প নেই। দলীয় সরকারের অধীনে অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু এ জন্য যেসব পূর্বশর্ত রয়েছে তা পূরণের আগে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা আম গাছে কাঁঠালের আশা করার মতোই অবান্তর। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এ দেশেও দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। '৫৪ সালের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ কোনো পক্ষই করেনি। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে মাত্র ৪-৫টি আসনের ফলাফল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও নির্বাচনের রায় নিয়ে বড় কোনো প্রশ্ন উঠেনি।

কিন্তু নব্বইয়ের পর থেকে প্রশাসনকে ক্ষমতাসীনদের হুকুমদাস বানানোর যে চেষ্টা চলেছে তার পরিণতিতে এখন কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।

প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন করার ক্ষেত্রে যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, সরকারের মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে, তারা একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিরোধী দল আন্দোলন করে সরকারকে কাবু করার যে কৌশল অবলম্বন করছে তা নস্যাৎ করতে তারা কড়া পথ অবলম্বন করছে। ইতোমধ্যে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ধরা শুরু হয়েছে। প্রশ্ন হলো, সরকারের পক্ষে যেনতেন প্রকারের একটা নির্বাচন করা হয়তো সম্ভব হবে কিন্তু সে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়াবে? সরকারের জনসমর্থন এতটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে যে, এই জনসমর্থন নিয়ে তারা কি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে?

গত পাঁচ বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য নিঃসন্দেহে গর্ব করার মতো। উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তারা কৃতিত্ব দেখিয়েছে। তারপরও সরকারের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, তা তাদের সমর্থকদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি সরকারের সব অর্জনকে গিলে ফেলেছে। প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তিকে তারা প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। সবাইকে ক্ষেপিয়ে তোলার যে অপরিণামদর্শিতা তারা দেখিয়েছে তার ফল সুখকর হওয়ার কথা নয়।

গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিশাল জয়ের প্রধান কারণ- তারা বিএনপি-জামায়াতবিরোধী সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তিকে পক্ষে আনতে পেরেছিল। জামায়াতের বিরুদ্ধে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলেম সমাজের সিংহভাগ ছিল তাদের পক্ষে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে নিজেদের ভুল নীতির কারণে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলেমদের বিরোধিতার মুখে পড়তে হচ্ছে সরকারকে। যে বৃহত্তর আলেম সমাজ জামায়াতের বিরুদ্ধে তাদের মিত্র হতে পারত, তারা এখন সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জামায়াত এখন হেফাজতকে তাদের বর্ধিত শক্তি হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। যে জাতীয় পার্টি ছিল জাতীয় সংসদে মহাজোটের ৮৮ ভাগ আসনে জয়ী হওয়ার অন্যতম সারথী তারা এখন মানসিকভাবে মহাজোটের সঙ্গে আছে কিনা সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ফলে বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করলে তা হবে একদলীয় নির্বাচন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলের একটি বড়সড়ো জোট থাকলেও জোটের অন্য সব দলের অবস্থান প্রায় জিরো। ফলে নির্বাচন হলে সাধারণ মানুষ সে নির্বাচনকে একদলীয় নির্বাচন বলেই ভাববে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদৌ সে নির্বাচন পাবে কিনা তাও একটি বড়মাপের প্রশ্ন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সরকারের যুদ্ধংদেহী আচরণে যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তুষ্টি এখন আর গোপন নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থানও প্রায় অভিন্ন। জঙ্গিবাদ দমনে বর্তমান সরকারের সাফল্যকে আন্তর্জাতিক সমাজ প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখলেও জনসমর্থনের দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া সরকারকে তারা সমর্থন করতে চাচ্ছে না। বরং মৌলবাদীদের আস্থাভাজন জামায়াত-বিএনপি জোটকে নিজেদের আনুগত্যে রেখে তাদের কীভাবে জঙ্গিবাদবিরোধী যুদ্ধে শামিল করা যায় সেদিকেই এগুতে চাচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। ভারত যাতে এ ব্যাপারে রাজি হয় সে চেষ্টাই করছে তারা। সরকার ঘরে-বাইরে একঘরে অবস্থায় পড়েছে নিজেদের ভুলে। দলের সুযোগ্য রাজনীতিকদের বদলে অনভিজ্ঞ কচিকাঁচাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গড়ার যে কসরৎ তারা করেছিল তা ক্ষমতাসীনদের জন্য সুখকর হয়নি। ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকে সামাল দিতে না পারার ব্যর্থতা তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছে। শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি ৩৫ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সিংহভাগকে তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। পদ্মা সেতু তৈরি না করতে পারার ব্যর্থতা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আওয়ামী লীগের ভিতকে এতটাই দুর্বল করেছে যে, বেশির ভাগ জেলায় সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের হোয়াইটওয়াশ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। ঠিক এ অবস্থায় একদলীয় নির্বাচন হলে তাতে আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও ভোট দিতে যাবে কিনা সন্দেহের বিষয়। সব মিলিয়ে সংকট ক্রমান্বয়ে ঘনীভূত হচ্ছে। নির্বাচন-সংক্রান্ত মতপার্থক্য নিরসন না করে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের পথে যাচ্ছে সরকার। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাত যেভাবে দানা বেঁধে উঠেছে তা আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন হাতছানি দিচ্ছে কিনা সে আশঙ্কা সচেতনদের মনে উঁকি দিচ্ছে। এ বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সমঝোতার পথে চলাই হবে সরকারের জন্য শ্রেষ্ঠ উপায়। সাধু সাবধান।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.