আ.লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার, যা-ই হোক কিছু করবে আর বিএনপি-নেতৃত্বাধীন আঠারো দলীয় জোট প্রতিবাদী হরতাল ডাকবে না, এমনটা বোধহয় ভাবাও যায় না। গত বৃহস্পতিবার রাতে সরকার কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রল এবং অকটেন ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে কম-বেশি শতকরা প্রায় ১০ ভাগের মতো। তারই প্রতিবাদে সাপ্তাহিক ছুটির দুদিন বাদ দিয়ে রোববার (৬ জানুয়ারি) হরতালের ডাক দিয়েছিল বিএনপিসহ আঠারো দলীয় জোট। সারাদিনের হরতালের পরেই এক ‘প্রেস ব্রিফিং’-এ বিএনপি-সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম বলেছেন, “শত বাধা সত্ত্বেও জনগণ হরতাল করে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা দিয়েছে”। হরতাল ডাকলেন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আর জনগণ ‘সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা’ জানালো?
তরিকুল ইসলাম মানুন বা না-মানুন, বাংলাদেশে হরতাল এখন জনগণকে সফল করতে হয় না, মানুষ হরতাল মানতে বাধ্য।
গাড়িতে-বাসে আগুন আর গ্রেনেড-বোমায় মানুষ মেরেই মানুষকে হরতাল মানতে ‘অভ্যস্ত’ করে তোলা হয়েছে। সাম্প্রতিক হরতালটি কেমন হয়েছে, তার ভাষ্য মিলেছে বিভিন্ন পত্রিকার শিরোনামে এবং উপস্থাপনের কায়দাতেও। জনকণ্ঠের প্রধান খবর “অসংখ্য ককটেল, গাড়ি ভাঙচুর, আগুন//গা ছাড়া হরতাল”; ভোরের কাগজের দ্বিতীয় প্রধান খবর “নিরুত্তাপ হরতালে বাসে আগুন, বোমাবজি”। প্রথম আলোর ডানদিকে এক কলামের শিরোনাম : “নিরুত্তাপ হরতালে গাড়িতে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণ”। যাকগে, এসব কথা না বাড়িয়ে বরং সাম্প্রতিক হরতালের ‘একটি ছবি’ দেখা যাক।
জনকণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় হরতালে গাড়ি ভাঙচুর-পোড়ানোর তিনটি ছবি আছে। প্রথম এবং সবচেয়ে বড় ছবিটির ‘ক্যাপশন’ : “আদালত পাড়ায় (ঢাকার) পুলিশকে লক্ষ্য করে মহিলা আইনজীবীর পাথর নিক্ষেপ”। আইনজীবী মহিলাটির কাজটি ‘আইনসম্মত’ হয়েছে কিনা সে প্রশ্ন নিতান্তই নিরর্থক। কিন্তু আমি ভাবছি, পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত নিজের ছবিটি দেখে মহিলা নিশ্চয়ই বিব্রত বোধ করছেন। তার পিতা-মাতা-ভাইবোন এবং সন্তানের কছে এ ছবিটি যথার্থই শঙ্কা এবং সংকোচের কারণ হবে।
ইতোমধ্যেই নানা মহলে নানা প্রশ্ন উঠছে, হরতালের ডাকটা কি জ্বালানি-মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে দেয়া হয়েছিল? তরিকুল ইসলামের কথা বলুন, কিংবা অন্যকোনো বিচক্ষণ বিএনপি-নেতার, কারোই তো ভুলে যাবার কথা নয় যে, আ.লীগ জোটের বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে পেরিয়ে আসা চার বছরে পাঁচ-দফায় জ্বালানি-মূল্য মোট ৩৮% বাড়িয়েছে অপরদিকে পূর্বতন জামাত-বিএনপি সরকার (২০০১-০৬) ১৩ দফায় মোট বাড়িয়েছিল ১৩৮%। সুতরাং ধারণা করা চলে, তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিএনপি-জামাতের ‘রেকর্ড’ এখনো অটুট। প্রাসঙ্গিক তথ্য হচ্ছে, বিগত ২০০১-০৬ইং বিএনপি সরকারের সময় পাঁচ বছরে “আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বেড়েছিল ৩২ মার্কিন ডলার। কিন্তু বিগত চার বছরে এ মূল্য ৪৫ ডলারেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ৃ.বর্তমান আ.লীগ সরকার যে হারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে, তা বিএনপির শাসনামলের চেয়ে ৯৮ শতাংশ কম” (জনকণ্ঠ, ৮-০১-১৩)।
দুই. ২০০১ইং বিএনপি-জামাত সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের সময় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল পেট্রল, অকটেন ও ডিজেলের মূল্য ছিল যথাক্রমে ২৩.০, ২৫.০ এবং ১৫.৫ মার্কিন ডলার। ২০০৬ ইং বিএনপির ক্ষমতা ত্যাগের সময় স্থানীয় বাজারে পেট্রল-অকটেন-ডিজেলের দাম ছিল যথাক্রমে ৫৬.০, ৫৮.০ এবং ৩৩.০ টাকা প্রতি লিটার। ২০০৮ইং বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় স্থানীয় বাজারে এ মূল্যস্তর ছিল যথাক্রমে ৭৭.০, ৮০.০ ও ৪৮.০ টাকা প্রতি লিটার। বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির পর পেট্রল অকটেন ও ডিজেলের মূল্যস্তর দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯৬.০, ৯৯.০ এবং ৬৮.০ টাকা প্রতি লিটার। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে স্থানীয় বাজারেও মূল্যবৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেইÑ এ সত্য অনস্বীকার্য বটে।
বাংলাদেশে মোট জ্বালানি তেল ব্যবহারের মোটামুটি ৬৫% হচ্ছে ডিজেল। প্রসঙ্গত আরো উল্লেখ্য যে, বর্তমানে ভারতে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম “বাংলাদেশী মুদ্রার মূল্যমানে ৭৬.৪৭ টাকা, পাকিস্তানে ৯০.৩৭ টাকা। সুতরাং এ আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার জন্যই বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে যখন যে সরকারই ক্ষমতাসীন থাকুক না কেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্যের সামঞ্জস্য বিধান না করে তেলের মূল্যে ক্রমাগত অধিক পরিমাণে ভর্তুকি দিতে থাকলে দেশের অর্থনীতি সচল রাখা সম্ভব নয় এবং তাতে বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন কার্যক্রমও ক্রমশই সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির আগে প্রতি লিটার ডিজেলে সরকারি ভর্তুকি লাগতো ষোলো-সতের টাকা এখন মূল্যবৃদ্ধির পরে লাগবে দশ টাকার মতো। এতে জ্বালানি-খাতের ভর্তুকি থেকে মোটামুটি ২,৫০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে, যা বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে সংস্থান করা যাবে।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারকারীরা। কৃষি এবং কৃষকের ওপরও কিছুটা চাপ পড়বে, সেচখাতে সরকার-প্রদত্ত সরাসরি ভর্তুকির পরিমাণ কিছুটা বাড়িয়ে দিলেই তা লাঘব করা যাবে। জ্বালানি খাতের ভর্তুকি কমানোর ফলে যে ২৫০০কোটি টাকা সাশ্রয় হবে, সরকার সে টাকাটা অবশ্যই কৃষকদের সেচ-ভর্তুকির সঙ্গে যোগ করতে পারেন। এতে কৃষক এবং দেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে বলেই আশা করা চলে।
উপরোক্ত তথ্যাদির প্রেক্ষিতে বলা চলে, জ্বালানি তেলের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির পরে আহূত বিএনপিসহ আঠারো দলীয় জোটের হরতাল আহ্বানকে যুক্তিসঙ্গত বলা চলে না।
বরং ধারণা হয়, তাদের দিক থেকে হরতাল আহ্বানের জরুরি আগ্রহ ছিল আর সেক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে ‘অজুহাত’ হিসেবেই কাজে লাগানো হয়েছে। ইতোমধ্যে নানাজনের আলোচনায় বিএনপির সর্বসাম্প্রতিক হরতালের দুটি ‘গুরুত্বপূর্ণ কারণ’ সম্পর্কে বলাবলি হচ্ছে। প্রথমত, গত ৬ জানুয়ারি দিনটি ছিল বর্তমান সরকারের চতুর্থ বর্ষপূর্তির দিন। সুতরাং হরতাল ডেকে বিএনপি দিনটিতে নেতিবাচক আবহ তৈরি করতে পেরেছে। দ্বিতীয়ত, ‘জিয়া অরফানেজ তহবিল’ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগের মামলায় বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়ার সেদিন আদালতে হাজিরা দেয়ার কথা ছিল।
কিন্তু তিনি হয়তো হাজিরা এড়াতে চেয়েছেন, তাই হরতাল ডেকে তাকে একটা সহজ সুযোগ করে দেয়া হলো। উল্লেখ্য যে, ইতিমধ্যে তার ‘গরহাজিরা’র কারণে মামলার তারিখ ১৪ বার পেছানো হয়েছে। বিষয়টি ইতোমধ্যে একটা ‘রেকর্ড’ প্রতিষ্ঠা করেছে কিনা জানি না। ৬ জানুয়ারি বেগম জিয়ার অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে তার আইনজীবীরা আদালতে হরতালজনিত ‘নিরাপত্তার অভাব’-এর কথা বলছেন। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগতেই পারে : বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে তার বিশেষ নিরাপত্তা-সুবিধা রয়েছে।
তারপরও তিনি যদি আদালতে হাজিরা দিতে আগ্রহী হতেন এবং নিরাপত্তার অভাববোধ করতেন, তাহলে আদালতের কাছেই অধিকতর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা প্রদানের দাবি জানাতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। তাছাড়া, ইচ্ছাকৃতভাবে হাজিরা এড়িয়ে আদালতের কার্যক্রম বিঘিœত এবং মামলা বিলম্বিত করা কি আইনের চোখে ‘বেআইনি’ নয়? সবারই জানা যে, মামলার তারিখটি আগেই জানা ছিল, অথচ সেই দিনটিতেই তিনি হরতাল ডাকলেন। বাংলাদেশের আদালতগুলো এমনিতেই মামলা জটে হিমশিম খাচ্ছে। এখন দায়িত্বশীল সম্মানিত মানুষরাই যদি এমন কায়দা এস্তেমাল করেন, তাহলে মামলা জট সারানোর উপায় কি?
তিন. তেলের মূল্য সংক্রান্ত বিষয়টিকে যদি বেশ কয়েক দশক পিছিয়ে নিয়ে যাই, তাহলে দেখবো, বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে প্রতি সের (প্রায় এক লিটার) কেরোসিনের দাম ছিল ৩৭ পয়সা আর পেট্রলের গ্যালন (চার লিটার) ছিল প্রায় তিন টাকা। তখন পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা ছিল সাড়ে চার বা পাঁচ কোটি আর বার্ষিক খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩০ লাখ টনের মতো।
তুল্য-মূল্য উপলব্ধির জন্যই উল্লেখ করছি, প্রতিমণ ধানের দাম ছিল ৮-১০ টাকা, সেরপ্রতি শিম-বেগুন দুচার আনা আর আলু বিক্রি হতো চার আনা থেকে আট আনায়। ১৯৭১ইং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বছর জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি আর খাদ্য-ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৫ লাখ টন। এখন জ্বালানি তেলের দাম কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার উল্লেখ উপরে করা হয়েছে। এখানে গুরুত্বের সঙ্গেই উল্লেখ করা দরকার, এখন ১৬ কোটি মানুষের দেশে খাদ্য-ঘাটতি নেই বরং প্রকট কোনো প্রকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে অদূর ভবিষ্যতে খাদ্যশস্য রপ্তানি করা যাবে। সুতরাং জ্বালানি-মূল্য বৃদ্ধির কারণে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাবার কোনো আশঙ্কা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না।
অনেকেই বলছেন, জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির কারণে কৃষি ও শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে এবং বাড়বে পরিবহনসহ বিভিন্ন আনুষঙ্গিক ব্যয়। আর তাই দেশে সামগ্রিকভাবেই মূল্যস্ফীতি ঘটতে পারে। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বলা চলে, আশঙ্কাটি সত্য নয়। বর্তমান সরকারের চারবারের জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় মূল্যস্ফীতি ঘটেনি। বরং “২০১২ সালে গড় মূল্যস্ফীতি কমেছে” (ভো.কা, ৯-০১-১৩)।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে, ২০১১ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.৪৩ শতাংশ যা ২০১২ হয়েছে ৬.২২ শতাংশ। বাংলাদেশে কৃষি খাতই হচ্ছে শ্রম-নিয়োজন আর অর্থনৈতিক উৎপাদনের প্রধানতম উৎস। সুতরাং কৃষি উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি অব্যাহত রাখতে পারলে নতুন করে মূল্যস্ফীতি এবং মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কার কোনো কারণ নেই বলেই বিশ্বাস করা চলে। সবাই স্মরণ করতে পারবেন, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে গড় মুদ্রাস্ফীতি ১০% বা অধিক হবে বলেই বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন। বাস্তব ক্ষেত্রে তা ৬.৭%-এ সীমিত থেকেছে।
কৃষিখাতে সুদক্ষ পরিকল্পনা এবং ক্রমবর্ধমান উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারলে, ভবিষ্যতে মুদ্রাস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলেই আশা করা যায়।
সামগ্রিকভাবে কৃষির ফলন এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সরকারের সুপরিকল্পিত উদ্যোগ এবং ব্যবস্থাপনার সাফল্যের ওপরই নির্ভরশীল। দেখা যাচ্ছে বর্তমান সরকার চার বছরে জ্বালানি মূল্য ৩৮% বাড়িয়েও কৃষি উৎপাদন ক্রমবর্ধনশীল রাখতে পেরেছে বলেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকেও। পূর্ববর্তী বিএনপি-জামাত সরকারের সময় জ্বালানি তেলের মূল্য ১৩৬% বাড়িয়েও এমন সফলতা তো মেলেনি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।