আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জনৈক তরুনীর পথ বিড়ম্বনা এবং আমার পা ধরার গল্প

আমি একাই পৃথিবী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম http://www.facebook.com/kalponikvalo কিছুদিন আগে গুলশান এক নাম্বারে গিয়েছিলাম ব্যক্তিগত একটি কাজে। ডিসিসি মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, রাস্তা পার হয়ে নিকেতনের দিকে রিক্সা নিব। এই সময় আমার পাশে গাড়ি থেকে নেমে এসে দাঁড়াল একজন আধুনিক সুন্দরী তরুনী। ফোনে কথা বলতে বলতেই তিনি গাড়ি থেকে নামলেন এবং আমার সাথে রাস্তা পার হবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

গাড়ির চাপ কমার পর রাস্তা পার হতে গেলাম। তিনিও আমার সাথে রাস্তা পার হলেন। আমি কিছুটা আগে, তিনি কিছুটা পিছে। সবে মাত্র মাঝ রাস্তার আইল্যান্ড পার হয়েছি, অমনি সাথে সাথে শুনলাম এক গগন বিদারী চিৎকার। অজানা অমঙ্গলের আশংকায় ভয় পেয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি, সেই তরুনী আইল্যান্ডের উপরে এক পা দিয়ে কেমন অদ্ভুত ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, আর চিৎকার করছেন।

আমি রাস্তা পার হয় ঘটনা কি দেখা জন্য তাকাতেই দেখলাম, তিনি একদলা টাটকা মানববর্জের মোটামুটি বেশ গভীরে পা দিয়েছেন। তার ডান পা এর স্যন্ডেল সেই ভয়ংকর জিনিসের ঠিক মাঝখানে। রাস্তার কোন এক হারামী মনে হয় এই কাজটি করে গিয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীদের বোধহয় সাহসে কুলায়নি এই ‘জিনিস’ পরিষ্কারের কিংবা অপসারনের। আশে পাশে দোকানদার কিংবা সচেতন কেউ নিজ উদ্যোগে ‘জিনিসটার' উপর কিছু ধুলাবালি এবং অল্প কিছু লতাপাতা ছড়িয়ে দিয়েই তারা তাদের দায়িত্বের ইতি টেনেছিলেন।

ফলাফল স্বরুপ মোবাইলে কথোপকথনরত অবস্থায় তরূনীটি বেখেয়ালে এই আজাবে পা দিয়েছেন। তরুনীটি হতভম্ব হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছেন। মানুষজন দূর থেকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছেন। এরমধ্যে কোথা থেকে যেন কয়েকটা টোকাই এসে জড়ো হলো। তারা মেয়েটির সামনে অনেকটা নেচে নেচে দুলে দুলে হাত তালি দিয়ে বলতে লাগল, 'হে হে গু’য়ে পাড়া দিসে, গু’য়ে পাড়া দিসে’।

পাষন্ড এই পৃথিবীর কথা তরুনীটি হয়ত অনেক শুনেছিল, কিন্তু মনে হয় এটাই ছিল তার প্রথম পরিচয়। স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রথম পরিচয় পর্ব তার সুখের হলো না। পরিস্থিতির চাপ সহ্য করতে না পেরে বেচারী একপর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। আমার এমনিতেই দেরী হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম সহৃদয়বান কেউ বুঝি এগিয়ে যাবেন।

কোন একটা ব্যবস্থা নিবেন। আর আমি বাহবা দিতে দিতে ফিরে গিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিব। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম সবাই মজা নেয়া ছাড়া আর কিছুই করছিল না। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশের দোকান থেকে দুই বোতল ফ্রেস পানি কিনলাম। মেয়েটির কাছে গিয়ে বললাম, শান্ত হোন, যা হবার তা হয়েছে।

চলুন পরিষ্কার করে ফেলি। এই বলে আমি মেয়েটার পায়ে পানি ঢালতে লাগলাম। বলা বাহুল্য বিকট গন্ধ বের হলো। আমি কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে পানি ঢালছি, হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই ওয়াক করে মেয়েটা অনেকটা আমার গায়ের উপরই বমি করে দিল। আমার তড়িৎ রিফ্লেকশনের কারনে আমি সময় মত ছিটকে দূরে সরে যেতে পারলাম।

না হলে আমার মাথায় নিজেকেই পানি ঢালতে হত। আমি মনে মনে ব্রুসলীকে ধন্যবাদ দিলাম। তড়িৎ রিফ্লেকশনের গুরু তিনি। মেয়েটা যেভাবে বমি করছিল, আমি বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কি করা উচিত। পানি খাওয়াব নাকি পানি ঢালব? এই সময় পাশ দিয়ে অন্য একজন মেয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।

আমি বললাম, এই যে আপু, উনাকে একটু ধরবেন প্লীজ? মেয়েটি চোখমুখ কুঁচকে এমন একটি ভাব করল যেন আমি তাকে কোন কুপ্রস্তাব দিয়েছি। অগত্যা কি আর করা। মেয়েটিকে কোন মতে ধরে ফুটপাতে একটা চায়ের দোকানের পাশে বসালাম। আর সাথে সাথে দোকানদারের সে কি ঝাড়ি!, ' ঐ মিয়া আপনি কি পাগল হইয়া গেছেন গা? না কি আমার দোকানরে আপনার মেথরপট্টি বইলা মনে হয়? এইখানে এই সব গু মুত ফালাইলে কেডা বইয়া চা খাইব? আপনেই ত খাইতেন না। যান ভাই দূরে ফুটপাতে গিয়া বসেন।

" আমি দোকানদারকে কঠিন একটা দৃষ্টি দিয়ে মেয়েটিকে ধরে একটু দূরে নিয়ে ফুটপাতে একটা পিলারের পাশে দাঁড় করালাম। দেখি পানিও প্রায় শেষ। আমাদের জাতীয় জীবনে আনন্দের বড়ই অভাব যদিও আমাদের জাতিগত ভাবে রসবোধ ব্যাপক। তারা দূরে দাঁড়িয়ে আমার ছোটাছুটি আর মেয়েটার দূরবস্থা দেখাই বেশি রসময় মনে করল। তাই আমাকে অনেকটা বাধ্য হয়েই মেয়েটিকে একা রেখে এক দৌড়ে রাস্তার ঐ পাশে মার্কেটের নিচে একটা দোকান থেকে পানি, সাবান আর টিস্যু পেপার কিনে আনতে হল।

পানি এনে আমি আবার ঢালা শুরু করলাম। ততক্ষনে, সিগন্যাল পড়েছে। একপাশে গাড়ির লম্বা সারি। বাসের ভিতর থেকে মানুষজন প্রবল আগ্রহে উঁকি দিয়ে দেখছে ঘটনাটা কি? রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে কাঁদছে, আর একটি ছেলে পায়ে পানি ঢালছে। যাই বলেন না কেন, আমাদের দেশের মানুষের জন্য যথেষ্ট কৌতুহল উদ্দীপ্তক একটি দৃশ্য।

মোটামুটি ৩/৪ বোতল পানি ঢালার পর, আমার দৃষ্টিতে মেয়েটার পায়ে তেমন কোন ময়লা দেখলাম না। বেচারী শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলাম। উল্টা আরো বেশি করা কান্না শুরু হলো। আমি বললাম, আপনি কান্না বন্ধ করুন।

সব ময়লা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। আমি সাবান আর টিস্যু পেপার এনেছি। আপনি কষ্ট করে সাবান দিয়ে পা ডলে পরিষ্কার করে নিন। ব্যস! তাহলে আর তেমন সমস্যা নেই। মেয়েটা আমার কথায় চমকে উঠল।

কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল, জীবনেও না। আমি হাতই দিতে পারব না। দিলে আমি হাত কেটেই ফেলব। প্লীজ আমাকে একটু হেল্প করুন। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

আমার দেখে মনে হল, খাইসে, এ তো মনে হয় এক্ষুনি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে। !! কি মুশকিল রে বাবা!। আমি খুব বিনয় এবং দরদ ভরা কণ্ঠ নিয়ে বললাম, ঠিক আছে তাহলে চলুন আপনাকে সিএনজি করে দেই। বাসায় চলে যান, গিয়ে ভালো মত ফ্রেস হোন। নাহহহ, প্লীজ আপনি একটু পরিষ্কার করে দিন, আমি মারা যাচ্ছি।

এই বলে আবার ওয়াক করে উঠল। আমি তো চমকে উঠলাম! বলে কি এই মেয়ে!! এখন হাত দিয়া ওর পাও ধোয়াতে হবে!!! ঐ চা এর দোকানদার আমাদের কাছের ছিল। শালা এত মহা হারামী, সে তখন দূর থেকে ছূটে এসে একটা টুল দিল মেয়েটাকে বসার জন্য। আর আমাকে বলে, 'ভাই আপনে যখন হাত দিসেনই, তখন ভালা কইরা দেন। ' আমি খানিকটা থতমত খেলাম।

ঝাড়ি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঐ বেটা ঐ, হাত দিসি মানে?? পান খাওয়া লাল দাঁত এর বিগলিত হাসি দিয়ে আমাকে বলল, মাইনে হইল, আপনে পরিষ্কার করছেন না, একে বারে ভালো কইরা পরিষ্কার কইরা দেন। আফা মনির লাইগা অনেক খারাপ লাগতাছে। ' এই কথা শুনে মেয়েটা আবার ফোপানো শুরু করল। সেদিনই ছিল মাইনা চিপার সাথে আমার বহুদিন পর আবার পূর্নমিলন। দোকানদারের দিকে শীতল একটা দৃষ্টি দিলাম, আশে পাশে সাহায্যের আশায় তাকালাম।

কিন্তু কোন লাভ নেই। বরং সবাই একটা সাসপেন্স মুহূর্তে এসে আমার এই রকম সময়ক্ষেপনে কিছুটা বিরক্ত। তাই বাধ্য হয়ে আমি মেয়েটির পা হাত দিয়ে পরিষ্কার শুরু করলাম। তরুনীর পা দেখেই বুঝা যাচ্ছে, তিনি তার পদ যুগলের অনেক যত্ন নেন। পায়ে এখন মেয়েরা আবার আংটিও পড়ে।

ইনার পায়েও দেখলাম বেশ কয়েকটি। আমি নিবিষ্ট মনে পানি দিয়ে পা পরিষ্কারের কাজ করছি, এমন সময় দোকানের সামনে একটা গাড়ী এসে দাঁড়াল। একজন সুদর্শন তরুন গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেন। ভীড় ঠেলে তিনি কাছে আসলেন। আমি একপাশে সরে দাঁড়ালাম।

মেয়েটি তাকে দেখে আবারও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বুঝতে পারলাম, ছেলেটি তরুণীর বিশেষ কেউ হন। ছেলেটা আমার দিকে খানিকতা কঠোর দৃষ্টি দিয়ে তরুনীকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিলেন। ইতিমধ্যে ঘটনা দেখার জন্য আসেপাশে বেশ মানুষ জড় হয়েছিল। তিনি সবাইকে অগ্রাজ্য করে মেয়েটিকে পাঁজাকোলে করে নিয়ে গাড়িতে তুললেন এবং চলে গেলেন।

আমি কিছুটা বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। মনটা কিছুটা খারাপ হলো। মনে মনে ভাবলাম, নিদেনপক্ষে মেয়েটা কি বলে যেতে পারত না? মানুষজনও দেখলাম কেমন যেন হতাশ। তাদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে 'পিকচার আভি বাকি হ্যায়'। কিন্তু পিকচার আসলেই শেষ।

আমাকে দুই একজন জিজ্ঞেস করল, মেয়েটার আমার কি হয়? আমি বললাম কিছু না রে ভাই। রাস্তায় বিপদে পড়ছিল। তাই সাহায্য করছিলাম। এইবার দেখি মানুষজন খুশি। ধন্যবাদ দিল।

আমিও হাসি দিলাম। বেটা দোকানদার এখন ভালো মানুষের ভুমিকা নিয়েছে। আমাকে হাত মুখ ধোয়ার জন্য পানি আর সাথে নতুন আর একটা সাবান এনে দিল। আমি সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিলাম। তারপর একটা চা খেয়ে সিগারেট ধরিয়ে বাসার ফিরার পথ ধরলাম।

আবারও মনে পড়ল মেয়েটার কথা। আহারে! বেচারী। বড় খারাপ একটা দিন গিয়েছে তার। ঘটনার আকস্মিকতায় মেয়েটি স্বাভাবিক অনেক কিছুই ভূলে গিয়েছে। গল্পের পিছনের গল্পঃ বাসায় ফিরে আম্মুর সাথে ঘটনাটা শেয়ার করলাম।

সবশুনে আম্মু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বর্জ্য সাফ করেও কোন সিস্টেম করতে পারলা না? আফসোস, বড়ই আফসোস। আমি মুখ কালো করে চলে আসলাম। কিছুক্ষন আমি বারান্দায় যাচ্ছিলাম। শুনি, আম্মু আব্বুর সাথে ঘটনাটা শেয়ার করছে। আব্বু হাসতে হাসতে বলছে, সাবাস, দেখতে হবে না কার ছেলে।

আম্মু বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি সারা জীবনই স্বার্থপর, ছেলে মেয়েরা ভালো কাজ করলে, শুধুই তোমার ছেলে মেয়ে, আমার কিছু না ? আর খারাপ করলে শুধু আমার, তাই না? তারপর আমার বাবা তার স্ত্রীকে নানা রকম অর্থহীন নামে ডেকে অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করতে থাকেন আর আমি নিঃশব্দ হাসি হেসে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। প্রিয় পাঠক, এই গল্পটা শেয়ার করলাম কারন রাস্তায় এমনটা আমাদের অনেকের সাথেই হতে পারে। বিশেষ করে হয় আমার প্রিয়জনদের সাথেই হতে পারে। ধন্যবাদ পাওয়া বড় কথা না, কাউকে সাহায্য করাই বড় কথা। আমি চাই তখন অন্তত কেউ যেন তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.