আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফুরিয়ে আসছে অর্থনীতির প্রাণ

অর্থনীতিকে যদি হাসপাতালে নেওয়া কোনো মুমূর্ষু রোগীর সঙ্গে তুলনা করা হয়, তবে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে এর প্রাণবায়ু। অর্থনীতি বিশ্লেষণ করে এমন সংগঠন ও ব্যবসায়ীদের অভিমত এটি। তাদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এমন একটি পর্যায়ে অর্থনীতিকে নিয়ে গেছে, এর মূল শক্তি ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন ও বিনিয়োগের সব শাখাতেই বিরাজ করছে চরম স্থবিরতা।

চলমান অচলাবস্থায় ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে সরকারের কাছে চরমপত্র দিয়ে বলেছেন, হয় ব্যবসা করার, নয় দেউলিয়া হওয়ার সুযোগ দিন। ব্যবসা-বাণিজ্য-কারখানা চালু রাখতে না পেরে নিরুপায় হয়ে তারা এখন পথ খুঁজছেন বেরিয়ে যাওয়ার।

বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিএমএর পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা একাট্টা হয়ে কারখানা চালু রাখতে চাইছেন সরকারের কাছে সাময়িক প্রণোদনা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর পরিচালকরা গত সপ্তাহে বৈঠক করে তাদের দাবিদাওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওই বৈঠকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সামনের দিনের চ্যালেঞ্জ নিয়েও আলোচনা করেছেন তারা। সভায় ব্যবসায়ীরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় অর্থনীতি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে কয়েক মাস ধরে চলমান হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি দেশব্যাপী অনাকাঙ্ক্ষিত সহিংসতা সার্বিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে করছে চরমভাবে ব্যাহত।

ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অর্থনীতিতে গভীর সংকটের আশঙ্কা করছে গবেষণা সংস্থাগুলোও। অর্থনীতিবিষয়ক স্বাধীন গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণ সম্প্রতি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে বলা হয়েছে, চলমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি নিম্নগামী হওয়ায় কমে যেতে পারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি। শুধু যে রাজনৈতিক অস্থিরতাই অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরেছে তা নয়, একই সময়ে সরকারের নীতিগত প্রতিবন্ধকতাও বন্ধ করে দিয়েছে সামনে এগিয়ে চলার পথ। উন্নয়ন অন্বেষণ আরও মনে করে, শিল্প উৎপাদন সূচক, শিল্প ঋণ, ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট), বিনিয়োগ চাহিদা সাম্প্রতিক সময়ে তুলনামূলকভাবে সামর্থ্যের নিচে অবস্থান করছে। ফলে উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে পরিলক্ষিত হচ্ছে নিম্ন প্রবৃদ্ধি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিসেম্বর পর্যন্ত যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে কমানো হয়েছে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি। জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৩ এবং জানুয়ারি-জুন ২০১৪ সময়ের জন্য বেসরকারি খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৫ এবং ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ থাকলেও চলতি অর্থবছরের আগস্ট মাসে প্রবৃদ্ধির হার কমে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৩৩ শতাংশে, যা আগের অর্থবছর একই সময়ে ছিল ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। শিল্প ও কৃষিঋণের প্রবৃদ্ধির হারেও প্রভাব ফেলেছে ঋণপ্রবাহের এই নিম্নগতি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ ২০১২-১৩ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (মার্চ-জুন) ছিল ৯ হাজার ৭২০ দশমিক ৩ কোটি টাকা। রাজনৈতিক অস্থিরতা আর নীতিগত প্রতিবন্ধকতার কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এটি কমে ৮ হাজার ৮৮০ দশমিক ৭৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

শুধু তা-ই নয়, কমেছে কৃষিঋণের প্রবৃদ্ধি। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে কৃষিঋণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৪৩ দশমিক ২ শতাংশ, এটি ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঋণাত্দক ৫ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শিল্প ও কৃষি উভয় খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এদিকে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিল্প-উৎপাদনে।

২০১২-১৩ অর্থবছরের তুলনায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ধস নেমেছে চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছর। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০-২০১১ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ২৩৩ কোটি ডলারের। ২০১১-১২ অর্থবছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি ডলারে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এটি আরও কমে অবস্থান নেয় ১৮৩ কোটি ডলারে। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে তা নেমে আসে ১০০ কোটি ডলারেরও নিচে।

রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে সরকারের আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যও নষ্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চলতি অর্থবছর সরকার যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সেটি অর্জন করা সম্ভব হবে না। আমদানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সম্পূরক আবগারি শুল্ক গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় ৫ দশমিক ৬৬ ও ২৪ দশমিক ০৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আমদানি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ের ক্ষেত্রেও গত অর্থবছরের তুলনায় লক্ষ্য করা গেছে ধীরগতি। ওই খাতে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ৪ দশমিক ৫২ ও ১৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, যা বিগত বছরের একই সময়ে ছিল ৭ দশমিক ৬৯ ও ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।

বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে এনবিআরের প্রাক্কলন অনুসারে রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৮১৮ কোটি টাকা কম অর্জিত হবে বলে আশঙ্কা করছে উন্নয়ন অন্বেষণ। এর ফলে বেড়ে যাবে বাজেট-ঘাটতি। প্রত্যাশা অনুযায়ী খরচ করতে পারবে না সরকার। ফলে থেমে যাবে গ্রামগঞ্জে উন্নয়ন প্রকল্প। কর্মসংস্থান ও আয়-উপার্জনে পড়বে নেতিবাচক প্রভাব।

এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আনিসুল হক বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি এখন এমন এক অবস্থায় রয়েছে যে এখন এটিকে খারাপ বললে বাড়িয়ে বলা হবে। এটি আসলে চলে যাচ্ছে চরম মন্দা আর ঝুঁকির দিকে। ফুরিয়ে আসছে এর প্রাণবায়ু।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।