ঘটনাবহুল ২০১৩-তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা রূপ নিয়েছিল রক্তাক্ত সহিংসতায়। এ বছর রাজনীতিতে ইস্যুর পর ইস্যু আসে। কিন্তু জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধাচরণ, বিএনপিসহ বিরোধী দলের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন ও সরকারের সংবিধান মোতাবেক নির্বাচনব্যবস্থার বিষয়ে অনড় অবস্থান দেশের রাজনীতিকে পুরোপুরি সহিংস করে তোলে। পিটিয়ে বা কুপিয়ে বা জবাই করে বর্বরভাবে হত্যার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে জ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা। পোড়া শরীর নিয়ে মৃত্যুর চেয়েও বেশি যন্ত্রণা ভোগ করে দেশের সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ। অসুস্থ রাজনীতির ককটেল-বোমাকে খেলনা ভেবে ঝলসে যায় নির্বোধ শিশু। এ বছরে সবচেয়ে বেশি সহিংস হয় যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ ও কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার পরের পরিস্থিতি। শেষের দিকে বিরোধী দলের আন্দোলনে গাড়িতে পুড়ে যেতে থাকে মানুষ। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় জিরো টলারেন্সে থাকা পুলিশের গুলিতেও প্রাণ হারায় মানুষ।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হয়েছেন ৪৯২ জন। ৮১৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তাতে আহত হয়েছেন আরও ২২ হাজার মানুষ। আর এর মধ্যে ৯৪ জন আগুনে পুড়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাদের মধ্যে ২১ জন মারা গেছেন। রাজনৈতিক সংঘাতে এত প্রাণহানি সর্বশেষ ঘটেছিল ২০০১ সালে। ওই বছর ৫০০ মানুষ রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারান। আর গত ২২ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন অন্তত আড়াই হাজার মানুষ। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যানুসারে, ২০১৩ সালের প্রথম ১০ মাসে সারা দেশে হরতাল ও বিভিন্ন সহিংস কর্মসূচি চলাকালে যানবাহনে অগি্নসংযোগের ঘটনায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা মূল্যের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত আগুনে পুড়েছে মোট ৬৭৪টি যানবাহন।
বছরের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর মধ্যে ছিল গণজাগরণ মঞ্চের আবির্ভাব, এদের বিরুদ্ধে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম নামের নতুন সংগঠন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ড দেওয়া হয়েছে নয়জনকে। যাদের মধ্যে একজনের ফাঁসি কার্যকরও হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্তদের মাঝে জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির নেতারা থাকায় রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও হয়। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ নানা ইস্যুতে বেশ কয়েক দফা হরতাল হয়েছে, হয়েছে অবরোধ। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও গ্রেফতার হয়েছেন একের পর এক। বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশ অভিযান চালায় দুই দফা। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি নিয়ে বিরোধী দলের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল ২০১৩ সাল। কিন্তু মূল সহিংসতার শুরু হয় ২৯ জানুয়ারি জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার কার্যক্রম শেষ হওয়ার দিন থেকে। সেদিন হরতাল দেয় জামায়াত, প্রাণ হারান তিনজন। কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায় প্রতিবাদের ঝড় তোলে। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই তার ফাঁসির দাবি নিয়ে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে মানুষজন জড়ো হতে শুরু করে। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এ আন্দোলন চলে রাত-দিন। অংশগ্রহণ করে লাখ লাখ মানুষ। পরবর্তীতে গণজাগরণ মঞ্চ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এ আন্দোলন বাংলাদেশের বিভাগীয়সহ জেলাশহরেও ছড়িয়ে পড়ে। গণজাগরণ মঞ্চের এই আন্দোলনকে নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে পরবর্তী কয়েক মাস। তবে এরই মাঝে আসে ট্রাইব্যুনালের অপর একটি রায়। ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পরবর্তী কয়েকটি দিন ছিল এ বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে সহিংস একটি সময়। ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হলে দেশের বিভিন্ন জেলায় জামাতিদের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এক সপ্তাহে নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞে দেশের ১৮ জেলায় ৭৭ জন নিহত হন। এর মধ্যে কয়েকজন পুলিশ সদস্যও রয়েছে। এ সময় হিংসার আগুনে পুড়ে কয়লা হয় কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এরই মধ্যে মার্চ থেকেই উত্থান ঘটে একটি নতুন সংগঠনের। মূলত, কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম চলে আসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তারা সুস্পষ্টভাবে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। নাস্তিকদের নেতৃত্বে গণজাগরণ মঞ্চ চলছে, এমন অভিযোগকে সামনে রেখে ইসলাম রক্ষাসহ ১৩ দফা দাবিতে ঢাকা অবরোধের ঘোষণা দেয় হেফাজতে ইসলাম। ৫ মে সকাল থেকে ঢাকায় ঢোকার পথগুলো অবরোধ করে রাখে হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকেরা। সেদিন দুপুর নাগাদ তারা জড়ো হন মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। লক্ষাধিক কর্মী-সমর্থকের উপস্থিতিতে চলতে থাকে হেফাজতের সমাবেশ। আর একইসঙ্গে দিনভর চলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ। পল্টন, দৈনিক বাংলা ও মতিঝিল এলাকায় চলে ধ্বংসজজ্ঞ। সেখানে কয়েক শ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ফুটপাতের দোকানপাটসহ বইপত্র ও কোরআন শরিফ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রাতে হেফাজত নেতারা শাপলা চত্বরে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিলে রাত ১২টার কিছু পরে পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। সারা দিনের এ ঘটনায় বিশজনের বেশি প্রাণহানি ঘটে। পরে বছরজুড়ে বিভিন্ন সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও সাতজনের দণ্ড দেওয়া হয়। এদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির নেতারা। প্রত্যেকটির পরই ঘটতে থাকে সহিংসতা। ৯ মে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৫ জুলাই গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। ১৭ জুলাই আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১ অক্টোবর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ৯ অক্টোবর বিএনপি নেতা আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
নিয়মিত বিরতিতে রাজনৈতিক সহিংসতা চলতে থাকলেও এসব সহিংসতা মৃত্যু হঠাৎ লাগাম ছাড়িয়ে গেছে বছরের শেষে। ২৫ নভেম্বর ঘোষণা করা হয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ৫ জানুয়ারি। এরপর থেকেই শুরু হয় বিরোধী জোটের টানা অবরোধ। কয়েক সপ্তাহ ধরে শুধু সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া অবরোধ চলে প্রতিদিন। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিরোধী জোটের আন্দোলনে এতদিন খুব একটা সহিংসতা দেখা না গেলেও, এই অবরোধকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নাশকতা দেখা যায়। গত দুই মাসেই পেট্রলবোমা, ককটেল বা আগুনে পুড়ে মারা গেছে ৬৬ ব্যক্তি, আহত ব্যক্তির সংখ্যা চার শতাধিক। তাদের প্রায় সবাই নিরীহ পথচারী অথবা শ্রমজীবী। গুলিতে, বোমায়, আগুনে, দুর্ঘটনায় এই দিনগুলোতে মোট ১২০ জন মানুষ সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন। এ সময় ব্যাহত হয় সারা দেশের রেল এবং সড়ক যোগাযোগ। এই অবরোধ অব্যাহত থেকেছে বছরের শেষপর্যন্ত। ১০ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করে, চলে কয়েক দিন ধরে। ফলাফল, স্বজনহারা হয়েছে আরও কয়েকটি পরিবার।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।