দুর্বৃত্তদের হামলা, লুটপাট, অগি্নসংযোগসহ নানা নৃশংসতায় সর্বস্বহারা সংখ্যালঘুরা চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। আত্দরক্ষার্থে কেউ কেউ দূরবর্তী স্বজনদের বাড়ি পালিয়ে গেলেও অসহায় অনেকেই শিশু ও নারীদের নিয়ে শূন্য ভিটায় অমানবিক জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের মাথার ওপর চাল নেই, ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীতে জবুথবু অবস্থায় কাটাতে হচ্ছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া শূন্য ভিটায় অর্ধাহারে-অনাহারে চলছে মানবেতর জীবনযাপন। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে পরনের বস্ত্র ছাড়া অতিরিক্ত লুঙ্গি-গামছা, কাপড় পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই।
অমানবিক এ দৃশ্য যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ, তালা, দেবহাটা উপজেলার টাইনশ্রীপুর, গাজিরহাট, পারুলিয়া ও আশাশুনি উপজেলার বুধহাটাসহ জ্বালিয়ে- পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া দেড় শতাধিক হিন্দু পল্লীর। সর্বত্রই প্রায় অভিন্ন চিত্র, বেঁচে থাকার করুণ আকুতি।
নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার পর মহাজোট সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন নেতারা ছাড়াও প্রশাসনের নানা টিম দফায় দফায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করছেন, বার বার প্রণয়ন হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা। কিন্তু এ মুহূর্তে ভিটেমাটি ধরে অাঁকড়ে থাকা সর্বস্বহারা নারী-পুরুষ-শিশুদের ভাগ্যে খাদ্য, আশ্রয় আর শীতবস্ত্র পর্যন্ত জুটছে না। কবে তালিকা চূড়ান্ত হবে, কবে মিলবে ছিটেফোঁটা সাহায্য-সে আশায় অনাহারে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে চান না ক্ষতিগ্রস্তরা। এক বস্ত্র পরিধানরত অবস্থায় ৬-৭ দিন পার করে দেওয়া হতভাগ্য মানুষজন ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠছে। জেলাপর্যায়ের দু-একটি সংগঠন কখনো কখনো রান্না ও শুকনো খাবার সরবরাহ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অল্প।
নির্বাচনের দিন যশোরের অভয়নগরের চাপাতলা গ্রামের মালোপাড়ায় অন্তত দেড়শ বাড়ির আসবাবপত্র, ঘরের চালা, ধান-গমের গোলাসহ বিভিন্ন মালামাল ভাঙচুর ও তছনছ করা হয়। পরে ৪-৫টি বাড়িতে আগুন দিয়ে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। ওই সময় ভয়ে মালোপাড়ার নারী-পুরুষ-শিশু গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বাঁচে। সেখানে প্রশাসন ও যৌথবাহিনীর তৎপরতায় বেশ কিছু পরিবার এলাকায় ফিরে এসে রীতিমতো জিম্মিদশায় পড়েছেন। তাদের ভাগ্যে না জুটছে খাবার, না পাচ্ছেন শীতবস্ত্র। পুরুষ সদস্যরা কাজের সন্ধানে এখানে সেখানে যাতায়াতও করতে পারছেন না। এখনো নানারকম শঙ্কা তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের প্রতি পরিবারে ২০ হাজার টাকা এবং কম ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবারকে ১০ হাজার করে টাকা দেবে গণজাগরণ মঞ্চ। ঢাকায় ফিরে দ্রুত এ সহায়তা পেঁৗছে দেওয়া হবে বলেও জানান ইমরান এইচ সরকার। তবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সে টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে পেঁৗছেনি বলে জানা গেছে।
যশোরের হিন্দুদের ওপর নির্বাচনোত্তর হামলার পর একই জেলার মণিরামপুর উপজেলায় হাজরাইল ঋষিপল্লীতে তিন গৃহবধূকে ধর্ষণেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত শুক্রবার এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করার পর বিষয়টি জানাজানি হয়। সেখানেও বেশ কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুর, তছনছ করাসহ নানারকম হুমকির মুখে জিম্মি রাখা হয়েছে সংখ্যালঘু পরিবারগুলোকে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, মাগুরা, জামালপুর, জয়পুরহাট, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
অন্যদিকে সাতক্ষীরা এলাকায় যৌথবাহিনীর অভিযানের পর জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব স্তিমিত হতেই পলায়নপর সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা নিজ নিজ বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হুমকি সেখানে এখনো চলছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, গত ১৩ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি কার্যকরের পরেই সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার টাইনশ্রীপুর, গাজিরহাট, পারুলিয়া ও আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা এলাকায় জামায়াত-শিবির বেপরোয়া তাণ্ডব শুরু করে। এতে সংখ্যালঘু পল্লীগুলো প্রায় নিশ্চি?হ্ন হয়ে যায় এবং এসব পল্লীর কয়েকশ বাসিন্দা রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
যৌথবাহিনীর অভিযান ও প্রশাসনের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘু পরিবারের কিছু কিছু সদস্য নিজ নিজ গ্রামে ফিরে এলেও বাড়িঘরে কোনোকিছু অবশিষ্ট পাননি তারা। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, বেড়ার টিন, কোদাল-কাস্তে থেকে শুরু করে টয়লেটে ব্যবহারের বদনা পর্যন্ত লুটে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। সর্বস্বহারা লোকজন স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সংঘবদ্ধ হামলাকারীদের সঙ্গে গ্রামের চি?িহ্নত অপরাধীরাও জড়িত ছিল। এসব দুর্বৃত্তদের বাড়িতে লুটপাটের নানা জিনিসপত্রও দেখা যাচ্ছে- অথচ মুখ ফুটে বলার কোনো উপায় নেই।
নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার জের ধরে ঠাকুরগাঁওয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলায় গড়েয়া গোপালপুরসহ ৮টি গ্রামের দেড় শতাধিক পরিবার প্রাণভয়ে পালিয়ে গেছেন। সন্ত্রাসীরা তাদের ৫০টি দোকান ভাঙচুর করে মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। ওই বাজারে অবস্থিত কালিমন্দির ও বিগ্রহও ভাঙচুর করে তারা। যৌথবাহিনীসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা গ্রাম পরিদর্শন করে আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও পালিয়ে যাওয়া হিন্দু পরিবারের সদস্যদের ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। যে কয়জন নারী-পুরুষ-শিশু উপায়ন্তরহীন অবস্থায় শূন্য ভিটা অাঁকড়ে পড়ে আছেন তারা সাহায্য-সহযোগিতার অভাবে অর্ধাহারে অনাহারে জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন।
এদিকে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন দিনাজপুরের কর্ণাই গ্রামের সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারগুলো। ঘরহারা, কর্মহারা এসব মানুষ তীব্র শীতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। সেখানে পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হলেও অসহায় মানুষজনের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসেনি। এখনো দুর্বৃত্তদের হুমকি-ধমকি চলছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হামলার শিকার সংখ্যালঘু পরিবারগুলোতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু খাবার সরবরাহ করা হলেও তাদের জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়া যায়নি এখনো। শীতবস্ত্রের অভাবে অনেককেই এক পোশাকে রাতভর লাকড়ি জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করতে দেখা যায়। দিনাজপুর হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পরিমল চক্রবর্তী বলেন, দুই বেলা না খেয়েও বেঁচে থাকা যাবে- তাই মানবিক সহায়তার বদলে হামলার দ্রুত বিচার হওয়া দরকার। অসহায় হিন্দু পল্লীগুলোতে স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাই এখন প্রধান আকুতি আমাদের। নির্বাচনী সহিংসতার শিকার কর্ণাই গ্রামে রোটারি ক্লাব অব দিনাজপুরের সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘু সদস্যদের মাঝে শীতবস্ত্র কম্বল বিতরণ করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেবল তালিকা নেওয়া হয়েছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।