সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে বাংলাদেশের আইনি কাঠামো আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে। চলতি সপ্তাহেই ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন রিভিউ গ্রুপ (আইসিআরজি) বাংলাদেশকে এ স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। এর ফলে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে সংস্থাটির ধূসর তালিকা (গ্রে লিস্ট) থেকে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ।
এ 'প্রমোশনে' ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোয় দেশীয় কোম্পানির গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণের ক্ষেত্রেও এটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ জানিয়েছে, ১৪ ফেব্রুয়ারি আইসিআরজির বোর্ডসভা হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সভাতেই গ্রে লিস্ট থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার ঘোষণা আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বিরোধী কার্যক্রম এমন শক্তিশালী করা হয়েছে যে এ ধরনের অপরাধে অপরাধীকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এঙ্টাডিশনাল আইনে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এঙ্টাডিশনাল আইনে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রসঙ্গত, মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখছে দুদক।
আইসিআরজি হচ্ছে ফিন্যানশিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (মানি লন্ডারিং) ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংস্থার (এফএটিএফ) গ্রুপ; যারা বিভিন্ন দেশে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ-সংক্রান্ত আইনি দুর্বলতা ও ঝুঁকি মোকাবিলায় বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি সেগুলো বাস্তবায়নে সহায়তা করে। ১৯৮৯ সালে ফিন্যানশিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এটি মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করে আসছে। সংশ্লিষ্ট দুটো আইনে দুর্বলতা থাকায় শুরু থেকেই বাংলাদেশ গ্রে লিস্টে অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধের আইনি কাঠামো আন্তর্জাতিক মানের করার উদ্যোগ নেয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০১২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ-২০১২, সন্ত্রাসবিরোধী আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০১২ এবং অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা অধ্যাদেশ-২০১২ নামে তিনটি অধ্যাদেশ জারি করে। তবে এগুলোয় অস্পষ্টতা রয়েছে অভিযোগ তুলে এফএটিএফের আঞ্চলিক সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (এপিজি) বাংলাদেশকে ধূসর থেকে কালো তালিকাভুক্তির হুমকি দেয়। এর পরই নড়েচড়ে বসে সরকার। নতুন করে আবারও আইনি কাঠামো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এপিজির পরামর্শে আইনগুলোকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিগুলো দীর্ঘ দুই বছর কাজ করে এবং ১০০টিরও বেশি বৈঠক শেষে আইসিআরজির কাছে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে নিজেদের সক্ষমতা তুলে ধরতে সমর্থ হয়।
যা করতে হয়েছে : ধূসর তালিকা থেকে বের হয়ে আসার জন্য মানি লন্ডারিং আইন-২০১২ ও সন্ত্রাসবিরোধী আইন (২০০৯) সংশোধন করে শক্তিশালী করা ছাড়াও মিউচুয়াল এসিটেন্স অ্যাক্ট বা পারস্পরিক সহযোগিতা আইন পাস করেছে সরকার। আইসিআরজির কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ন, পালেরমো কনভেনশন রেটিফাই এবং এঙ্টাডিশন আইন সংশোধন করা হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ফিন্যানশিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলে সদস্য রাষ্ট্রগুলো থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য আনা-নেওয়া করতে পারবে সরকার। এগমন্ড গ্রুপের বাইরে বিভিন্ন দেশের মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত তথ্য পেতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফিন্যানশিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট স্থাপন এবং এটিকে শক্তিশালী করা হয়েছে। আইনে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের সংজ্ঞা বিস্তৃত করা হয়েছে। ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট আইনগুলো। অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পেশাজীবীদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এনজিও, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থা ও অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আনা হয়েছে আইনের আওতায়।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অমলেন্দু মুখার্জি বলেন, 'জঙ্গি ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে সরকারের সর্বাত্দক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে আইনের আওতায় আনা উচিত তাদের সবাইকে আনা হয়েছে।' বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, 'মানি লন্ডারিং ও জঙ্গি অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় কঠোর নজরদারি রাখে। প্রতিটি ব্যাংকের মাসিক ভিত্তিতে হিসাবের তথ্য নেওয়া হয়। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ হলেও তা তদারকি করা হয়। এ ছাড়া বৈদেশিক অর্থের উৎস জানাতে বাধ্যবাধকতা রয়েছে সব প্রতিষ্ঠানের। ব্যাংকিং চ্যালেনের বাইরে লেনদেনে কঠোর নজরদারি রয়েছে আমাদের।' তিনি আরও বলেন, 'কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে বিধিবিধান ও প্রচলিত অ্যান্টি মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আর এ ধরনের কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানে পেঁৗছাতে যাচ্ছে।'
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।