ভালো আছি একটা গল্প লিখবো ভাবছিলাম, স্বাধীনতার গল্প। কিন্তু গল্পটা শুরু করতে গিয়েই বরাবরের মতো সেই সমস্যাটা আবার দেখা দিল- কী দিয়ে শুরু করব গল্পটা। মানে গল্পের প্রথম কথাটা কী হবে। স্বাধীনতার গল্প বলে কথা। আমরা দেখেছি, রূপকথার গল্পের শুরু সবসময়ই হয়- ‘সে অনেক অনেক দিন আগের কথা; এক দেশে ছিল...’।
পুরনো দিনের গল্প লেখিয়েরা লিখতেন- ‘ছেলেটার অপরাধ, ও তিনদিন গরহাজির থেকে গতকাল ইশকুলের বারান্দায় পা দিয়েছে’।
আর এখনকার, মানে আধুনিক কিংবা বলো আধুনিকান্তিক গল্পকাররা যে গল্প লেখেন. তা যেন পাঠকের সামনে উপস্থিত হয় একদম কেতাদুরস্ত স্যুট-টাই পরে ডামাডোল পিটিয়ে। যেমন, ‘টকশোতে যাওয়ার আগে একটুখানি মেকআপ- ও তেমন দোষের কিছু নয়’।
তাছাড়া রহস্য গল্প, রোমান্টিক গল্প, শিশুতোষ কিংবা কিশোরগল্প- প্রত্যেকটির গীতরস ও সুর-ব্যঞ্জনা হয় আলাদা রকমের।
কিন্তু স্বাধীনতার গল্পের প্রথম শুরুটা কেমন হবে, কী দিয়ে হবে, কেমন হলে ভালো হয় ? একটু তেজী তেজী যুদ্ধংদেহী মনোভাব হলে, নাকি মুক্তি-আনন্দ-উল্লাসের বরাভয় থাকলে।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, এত যে স্বাধীনতা স্বাধীনতা করছি, স্বাধীনতার মানেটা আসলে কী ? অর্থটা কী স্বাধীনতার ? এবার ভাবনাটা শুরু করতে হলো মূল থেকে। কারণ এবারের সমস্যাটা আগের চেয়ে গুরুতর ও জটিল। স্বাধীনতা কী- উত্তর খুঁজতে গিয়ে ভাবনার খেই হারিয়ে ফেললাম এবং সেই সব হারানোর মধ্য থেকেই বেরিয়ে এলো কাক্সিক্ষত গল্পটি, অনেকটা হাওয়ায় ভেসে আসা স্বপ্নবর্তিকার মতো।
আসলে গল্প না; একেবারে সত্যি ঘটনা। কিন্তু ঘটনাটা এমন যেন গল্পকেও হার মানাবে।
তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি আমি। এমন করেই তখন স্বাধীনতার মাসে পচিঁশে মার্চ এসে দরোজায় কড়া নেড়েছিলো। হেডমিষ্ট্রেস ম্যাডাম বাংলা ক্লাসে এসে দু’দিনের জন্য স্কুল ছুটির ঘোষণা দিলেন। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিতব্য স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানালেন। এসবের আগে তিনি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের সামনে একটা নাতিদীর্ঘ আলোচনা রাখলেন।
আমরা তন্ময় হয়ে শুনছিলাম তার কথা। ভালো ভালো কথা। দামি দামি উপদেশ। আর শিশুদের উপযোগী মজার মজার কৌতুকে ঠাসা ছিল তার সারগর্ভ আলোচনাটা। আলোচনা শেষ, তবে তখনও কথার রেশ ফুরোয় নি- এমন সময় সহসা একটা ছেলে- নাম মিঠু- প্রশ্ন করে বসলো,
-‘ম্যাডাম, স্বাধীনতা কি ?’
আমরা সবাই হকচকিয়ে গেলাম।
ম্যাডামও বুঝি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। আমাদের কেউ কেউ বিদ্রুপের হাসিও হাসছিলো- এটা কোন প্রশ্ন হলো ? সারারাত লাইলি-মজনুর কেচ্ছা শুনে এখন শুধায়, লাইলি ছেলে না মেয়ে ?
তবে আমার মনে হয়, আমার মত অনেকের মথায়ই প্রশ্নটা ঝিনঝিন করে বাজছিলো- আসলেই তো, স্বাধীনতা জিনিসটা কি, সেটাই তো জানি না। যা হোক, সব জল্পনা-কল্পনা এবং ঠাট্টা-বিদ্রƒপের অবসান ঘটিয়ে ম্যাডাম আরো কিছুক্ষণ বক্তব্য রাখলেন। কিছুটা সপ্রতিভ হয়ে বললেন,
-‘আরে তোমরা হাসছো কেন ? তোমরা কেবল ক্লাস থ্রিতে পড়ো, এমন প্রশ্ন তো থাকতেই পারে, তাই না ! তাছাড়া আমি তো বলিনি যে, কোন প্রশ্ন করতে পারবে না তোমরা। শোন, স্বাধীনতা মানে হলো, মুক্ত হওয়া, আযাদ হওয়া।
পরাধীনতা বা অপরের অধীন না থাকা। এটাকে স্বেচ্ছাচরিতাও বলা যায়। ফরাসি এক দার্শনিক বলেছেন...। ’
এভাবে তার বক্তব্য চললো। এবং বক্তব্যের এই শেষাংশে এসে তার কন্ঠটা কেমন যেন গুরুগম্ভীর হয়ে উঠলো।
কারণ তখন তিনি কঠিন কঠিন শব্দে- যা আমাদের ছোটদের জন্য প্রায় দুর্বোধ্য- স্বাধীনতার প্রসিদ্ধ সংজ্ঞাগুলি বলছিলেন। কয়েকজন ইংরেজ পন্ডিতের নাম উল্লেখ করে কয়েকটি ইংরেজী সংজ্ঞাও দিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার মানেটা আমার- অমাদের বললেও বোধ হয় ভুল হবেনা- ঠিক করে জানা হলেও সঠিকভাবে বোঝা হলো না। বোঝা হলো না, স্বাধীনতার সাথে ক্রীড়া অনুষ্ঠানের সম্পর্ক কী। এর জন্য পাকিস্তানিরাই বা আমাদের উপর হামলা করবে কেন এবং আমাদেরকে তাদের সাথে যুদ্ধ করে এত মানুষ হারাতে হলো কেন ? বরং মনে হলো, বিষয়টা আরো খানিকটা ঘোলাটে হয়ে গেছে।
স্বাধীনতা কী আর পরাধীন থাকার কষ্টটাই বা কী-এরপর থেকে এ প্রশ্ন প্রায়ই কাঁটার মতো খচখচ করে মনের মধ্যে বিধঁতো। মনে পড়ে, ছেলেবেলার সেই উচ্ছল দিনগুলির মাঝেও বহুদিন একাকী নীরবে-নিভৃতে বসে মিঠুর প্রশ্ন আর ম্যাডামের কথাগুলো ভেবেছি। তারপর একসময় প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ভুলে গেছি সেই ঝিম ধরানো প্রশ্নটা । ব্যস্ত হয়ে পড়েছি পৃথিবীর পথে পথে প্রকৃতির নানান কাজে।
দশ বছর পরে।
যখন আমার ও মিঠুর জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই স্রোতের তালে বইছে। একদিন মিঠুর সাথে দেখা হলো সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের সামনে। আবার ক্লাস থ্রির ঘটনাটা আমার মনে পড়লো। কথায় কথায় জানতে চাইলাম,
-‘দোস্ত স্বাধীনতার মানেটা কি পরে তুই বুঝতে পেরেছিলি, মানে এখন তুই বুঝিস ?’
মিঠু আমাকে হাত ধরে টেনে স্মৃতিসৌধের বেঁদিতে নিয়ে বসালো। বললো,
-‘সত্যি দোস্ত, একদম সত্যি কথা কই।
তুই কিন্তু হাসবি না। শোন, সেদিন ক্লাসের সেই ঘটনার পর থেকে স্বাধীনতার মানেটা বোঝার জন্য আমি একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। বাড়ি গিয়ে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাইয়া ডিকশনারি খুলে দেখিয়েও দিলেন। এছাড়া অনেকে অনেকভাবে আমাকে বুঝিয়ে বলছিলো। আমি যে একটুও বুঝলাম না, তা না।
কিন্তু কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিলো যে, আমি ব্যাপারটা সঠিকভাবে বুঝতে পারছি না। পরের বছর ঢাকায় এসে মামার সঙ্গে গেলাম চিড়িয়াখানায়। মামাও আমার কৌতূহলের কথাটা জানতো।
‘দোস্ত, একদম সত্যি কথা কই। হাসবি না কিন্তু।
’ মিঠু আবার আমার হাত ধরলো।
-‘চিড়িয়াখানায় সেদিন কী যে হয়েছিলো কে জানে। সিংহের খাঁচাটার সামনের দাঁড়িয়ে আমি তো প্রায় ভয় খেয়ে গেলাম। সিংহটা বিকট আওয়াজে তর্জন গর্জন করছিলো। আর খাঁচার শিকগুলো ধরে কেবল মোচড়ামুচড়ি করছিলো।
একেকবার এমনভাবে রডগুলো টানছিলো, মনে হচ্ছিলো যেন টেনে ছিঁড়েই ফেলবে। ছোট ছোট বাচ্চারা তো ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। আমি মামার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মামা সিংহটা ওরকম করছে কেন ? মামা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন খাঁচাটার দিকে। আমার কথা শুনে হালকা একটা হাসি দিলেন। বললেন, মুক্তির জন্য, ‘স্বাধীনতার জন্য’।
দোস্ত, বিশ্বাস কর, সিংহটার ওই ভয়াল মূর্তি দেখার পর মামার ঐ একটা কথা শুনে আমার কাছে স্বাধীনতার মানে জলের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে সেদিন। ’
পাঠক, সত্যি বলতে কি, মিঠুর মুখে ওর নিজের ঘটনাটা শোনার পর আমিও সেদিন সত্যিকারের স্বাধীনতার মানেটা ঝুঝতে পেরেছিলাম। বুঝতে পেরেছি, পরাধীনতার যন্ত্রণা কত কঠিন। বুঝেছি, কেন আমাদেরকে পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে লড়তে হয়েছিলো। সেদিন মনে হলো, সদ্য কারামুক্ত স্বাধীনতার আনন্দ আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।
আমি আজই স্বাধীন হয়েছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।