শুধু আওয়াজ নয়, চিৎকার চাই....
এক নিতান্তই পুঁচকে লেখক। ব্লগে আইডি খুলেছে খুব বেশিদিন হয় নি। প্রথম প্রথম শুধু মানুষজনের লেখা পড়েই সময় কাটাতো। ভালোই লাগতো, কত কিসিমের লেখা ব্লগ দুনিয়াতে! মুভি রিভিউ হরেক রকমের, হাজারো স্যাটায়ার, কবিতার ঝুলি, ছোট-বড় গল্প, সাহিত্য সমালোচনা! পড়তো, আর ভাবতো, আরে বাহ, এই চিন্তাটাতো আমার মাথায়ও এসেছিলো, লেখলাম না ক্যান? অথবা, এই মুভিটা তো আমারও দেখা, চাইলে তো আমিও লেখে ফেলতে পারতাম একটা মুভি রিভিউ! যত দিন যায়, তার মাথায় ব্যাপারটা ঘুরতে থাকে, লিখতে হবে, আমাকেও লিখতে হবে।
লিখতে বসলো সে।
তার সবচেয়ে প্রিয় টপিক হল মিথলজি, হিন্দু পুরাণ ঘেঁটে-ঘুটে বেশ বড়সড় একটা লেখা লেখে ফেললো সে দু’দিন খাটুনির পর। পড়ে দেখলো। নাহ, অতটা প্রাঞ্জল হয় নি। আবার লেখলো নতুন করে। আবার লেখলো, কিছুটা ইম্প্রুভমেন্ট।
লেখাটা পড়ে নিজের কাছেই ভালো লাগলো! বাহ আমি তো খুব একটা খারাপ লেখি না! সাহসে ভর করে লেখাটা পোস্ট দিলো সে।
তারপর? কিছুই হল না! ১৫ মিনিট অন্তর নিজের ব্লগ চেক করে সে, নাহ, কোন মনুষ্য সেখানে পদচিহ্ন রাখে নি। একটা দিন পার হয়ে গেলো। তার এই লেখাটা কারো চোখেই পড়লো না।
মন খারাপ ছিলো কয়েকদিন।
তারপর ভাবলো, নাহ এই টপিক খাবে না মানুষ, রস-কষ নেই তেমন একটা। অন্য কোন টপিকে লেখতে হবে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা চলছে। ভর্তিচ্ছুদের বিভিন্ন দুর্ভোগ এবং প্রশাসনিক বিভিন্ন অসামঞ্জস্য নিয়ে আরেকটা লেখা লেখলো সে, এ-বারেরটা আরও খেটে খুটে, বাস্তব বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে, লেখাটা যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য সমৃদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল তার মধ্যে। এই লেখাটাও পোস্ট করলো।
ফলাফল? তথৈবচ। তার ব্লগে মাছিও আসে না। আসবে কোথা থেকে, মধু নেই যে! ব্লগের হোমপেইজে ঘুরে বেড়ায় সে। দেখে, হাজারো অন্তঃসারশূন্য লেখায় মানুষের আনাগোনা, কমেন্টে বিতর্কের ফুলঝুরি! দেখে আর বুকের বামপাশে চিনচিনে একটা ব্যথা টের পায়। “আমি কি এদের থেকেও খারাপ লেখি? আমার লেখাগুলো কি এই চুটকিগুলোর থেকেও খারাপ?!” হতাশা গ্রাস করে ফেলে তাকে।
ব্লগ লেখালেখি থেকে বিদায় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। ধর্মান্ধ আর ধর্মপ্রাণদের সম্পর্কে তার নিজস্ব অভিমত নিয়ে একটা লেখা তার বন্ধু-মহলে প্রশংসা পায় ভালই। তখনই আবার পুরনো ভুত মাথা চারা দিয়ে ওঠে। এই লেখাটা ব্লগে দিলে কেমন হয়! যে ভাবা সেই কাজ।
পুরনো হতাশা ভুলে এই লেখাটা আবারো পোস্ট করে ব্লগে। এবং যথারীতি, এবারও তাকে হতাশ হতে হয়। তার লেখা কারো চোখে পড়ে না। ...
কোন এক প্রতিষ্ঠিত ব্লগারের লেখা পড়ছিল সে। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে খুব চমৎকার একটা লেখা।
ওই পোস্টে একজনের কমেন্টে চোখ আটকে যায় তার। কমেন্টের কথাগুলো যেনো তারই মনের কথা। কিন্তু অনেক গোছানো, অল্প কথায় পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। সেই একই বিষয় নিয়ে তার নিজেরও লেখা একটা কপি ছিলো। কমেন্টের সাথে মিলিয়ে দেখে, সে যেখানে পুরো এক পৃষ্ঠা লাগিয়ে লেখেছে, সেখানে ওই লোক মাত্র এক প্যারাতেই পুরো ব্যাপারটা তুলে আনতে পেরেছে।
খারাপ হবার একটা তীব্র বাসনা হঠাৎ অনুভব করে নিজের ভেতর। নিজের লেখা প্রায় এক পৃষ্ঠার ড্রাফট পোস্টটা মুছে ফেলে সে। তার বদলে ওই ছোট্ট কমেন্টের সাথে অল্প কিছু মালমসলা যোগান দিয়ে নতুন একটা লেখা লেখে। পোস্ট দেয়।
পোস্টটা দেবার পরে থেকেই নিজের ভেতর একটা অপরাধ-বোধে ভুগতে থাকে সে।
এ আমি কি করলাম! শেষ পর্যন্ত আমি এতটাই নিচে নামলাম! এদিকে ওই পোস্টে মানুষের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। মিনিটে মিনিটে বাড়ছে মানুষের পদচারনা। যতই দেখে, নিজের কাছে নিজে আরো বেশি কুঁকড়ে যায় সে। নিজের কাছে নিজেই ছোট হতে থাকে, মুখ ঢাকে লজ্জায়। পোস্টটা মুছে ফেলতে চায় বারংবার, পারে না।
যেনো পোস্টটা ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে, তার পাপের শাস্তি দিচ্ছে শতগুণে।
এরই মধ্যে এক ব্লগারের চোখে পড়ে যায় লেখাটা। মৃদু ভাষায় সে ভৎসনা করে চলে যায়। ওই ভৎসনা হাজার হাজার বিষ মাখান তীরের ফলার মতো বিঁধতে থাকে তার শরীরে। এই নিদারুণ অশান্তি নিয়েই ঘুমাতে যায় সে।
ঘুমের ভেতর সারারাত তার আশেপাশে ভীড় জমায় সব পরিচিত জনেরা। যারা এতদিন ধরে তাকে লেখালেখিতে উৎসাহ দিয়েছে, তারা এবার এসেছে ভৎসনা উপহার দিতে। পরিচিত ব্লগারদের মুখগুলো ভেসে উঠে একে একে, থু থু ছিটায় তারা সবাই। সেই পুঁচকে লেখক নিচ থেকে আরো নিচে নেমে যায়, নামতেই থাকে, নামতেই থাকে। এই অধঃপতনের কোন শেষ নেই।
তারপর ঘুম থেকে উঠে ছেলেটা আবার কীবোর্ডের সামনে বসে। লিখে শেষ করে এই লেখাটা......
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।