আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খানিকটা সময় দিন, জীবনের শেষ বক্তৃতায় র‌্যান্ডি

র‌্যানডল্ফ ফ্রেডরিক। যাকে সবাই চেনেন র‌্যান্ডি পাউশ নামে। র‌্যান্ডির জন্ম ১৯৬০ সালের ২৩ অক্টোবর। তিনি কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। র‌্যান্ডি শিক্ষকতা করছিলেন।

তবে হুট করেই তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে তার শরীরে মৃত্যুব্যাধী ক্যান্সার ধরা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুকে পরাজয় করার জন্য চিকিৎসা শুরু করেন র‌্যান্ডি। কিন্তু সবকিছু পেছনে ফেলে মৃত্যুই তার নিয়তি হয়ে যায়। ডাক্তার ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে র‌্যান্ডিকে জানিয়ে দেন, সময় বেশি নেই।

তবে র‌্যান্ডি তখন শিক্ষকতা নিয়েই ব্যস্ত। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার সিরিজ আয়োজন হতে যাচ্ছে। র‌্যান্ডিকে সেখানে বক্তৃতা দিতে হবে। র‌্যান্ডি গভীর ভাবনায় পড়ে যান বক্তৃতায় বিষয়বস্তু নিয়ে। অবশেষে তিনি তার জীবনের শেষ বক্তৃতা দেওয়ার বিষয় নির্ধারন করেন শৈশবের স্বপ্ন পূরণ নিয়ে।

ইতিহাসে ‘দ্য লাস্ট লেকচার’ নামে র‌্যান্ডির সেই বক্তৃতা বিখ্যাত। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও এ মানুষটি ছিলেন অবিচল। মৃত্যুভয় তার ছিল না। বরং জীবনের প্রতিটি সময়কে উপভোগ্য করে তুলতে সক্ষম ছিলেন সাহসী র‌্যান্ডি। কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির সম্মেলনকক্ষে ২০০৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ৪০০ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সামনে বক্তৃতা দেন র‌্যান্ডি।

অবাক বিস্ময়ে সেদিন সবাই তাকিয়ে ছিলেন র‌্যান্ডির দিকে। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন তার বক্তৃতা। র‌্যান্ডি পাউশ ২০০৮ সালের ২৫ জুলাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কিন্তু মরেও তিনি অমর হয়ে রইলেন শত শত তরুণের হৃদয়ে। মৃত্যুকে জয় করতে পেরেছিলেন র‌্যান্ডি পাউশ।

-------------------------------------------------- উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানাই। সেই সঙ্গে ধন্যবাদ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘লাস্ট লেকচার’ আয়োজনে আমাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। তবে কেউ যদি মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে এমন লেকচার বা বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পায় তার জন্য বিষয়টি আরো অন্যরকম। আমি ঠিক এমনই একটি জায়গায় আজ দাঁড়িয়ে।

আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত। দীর্ঘ চিকিৎসার পর চিকিৎসকরা আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন খুব বেশিদিন আর বাঁচবো না। আমার এ বিষয়টি মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। আমার তিনটি সন্তান আছে। কিন্তু তারপরও এই বাস্তবতায় আমার কিছুই করার নেই।

আমাকে মরতে হচ্ছে। যাইহোক। আজ এখানে মৃত্যু নিয়ে কথা বলবো না। বলবো জীবন নিয়ে। কীভাবে আমরা বাঁচবো।

বিশেষ করে আমাদের শৈশবের স্বপ্ন নিয়ে। সেই সঙ্গে কিভাবে সেই স্বপ্নের ছোঁয়া পাওয়া যায়। ছোটবেলার ছবিগুলো দেখলেই আমি আবিষ্কার করি, আমি কখনো হাসি ছাড়া ছিলাম না। প্রতিটি ছবিতে হাসছি। স্বপ্ন দেখছি।

আমার অসাধারণ শৈশব ছিল। টিভির সামনে বসে যখন আমরা দেখতে পাই চাঁদে মানুষ গিয়েছে তখন স্বপ্ন নিয়ে কোনো সন্দেহই থাকে না। সবকিছুই সম্ভব। এই আত্মবিশ্বাসটা আমাদের কখনোই হারানো উচিত না। আমি ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতাম, জাতীয় ফুটবল লিগে খেলবো।

এটি হলো, আমার একমাত্র স্বপ্ন যা আমি পূরণ করতে পারিনি। আমরা যখন কোনো স্বপ্ন পূরণ করতে পারি না, তখন সেটা পাওয়ার জন্য অবিরামভাবে চেষ্টা করে যাই। আমিও সেই কাজটি করেছি। দীর্ঘ সময় ধরে ফুটবল খেলেছি। ফুটবল স্কুলের অনুশীলনে যাওয়ার পর কোচ আমাকে প্রচন্ড পরিশ্রম করাতো।

বারবার ভুল ধরতো এবং ধমক দিত। আমারও মন খারাপ হতো। একদিন সহকারী কোচ এসে আমাকে বললেন, ‘তিনি তোমাকে প্রচুর খাটায়; তাই না?’ আমি বললাম, হ্যা। তখন সহকারী কোচ বললেন, ‘তার মানে তিনি তোমাকে পছন্দ করেন। যিনি বারবার তোমার ভুল ধরবে এবং তা সংশোধন করে দেওয়ার চেষ্টা করবে তিনিই তোমার ভালো চান।

’ বিষয়টি আসলেই সত্যি। এবার আসি দ্বিতীয় স্বপ্নে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন বাবা-মার সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ার ডিসনিল্যান্ডে যেতাম। সেখানে আমি এতো আনন্দ পেতাম যে মনে মনে ঠিক করেছিলাম, যখন বড় হবো তখন এমনই একটি ডিসনিল্যান্ড আমিও তৈরি করবো। এরপর পড়াশোনা করলাম।

গ্র্যাজুয়েট হলাম। আমি জুনিয়র শিক্ষকও হলাম। আমি কাজ শুরু করলাম ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ে। গবেষণা চলতে থাকলো। সফলও হলাম।

ভার্চুয়াল ভাবে আমি ডিসনিল্যান্ড ঠিকই বানালাম। আমার স্বপ্ন সফল হলো। তবে সত্যি কথা বলতে কি, ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার জন্য প্রয়োজন ভালো বাবা-মা। যা আমার ছিল। আমার বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

আর আমার মা ছিলেন চমৎকার মানুষ। তার সঙ্গে ছিল আমার আত্মিক সম্পর্ক। যখন আমি পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে ঘরে ফিরি। আমার মা সবার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, ‘এ হলো আমার ছেলে।

সে ডক্টর। তবে মানুষকে সাহায্য করতে পারবে এমন ডক্টর না। ’ আমি তখন মাকে নিয়ে বলতে থাকি, পিএইচডির জন্য কী পরিমাণ কষ্ট আমাকে করতে হয়েছে। মা আমাকে তখন চুপ করিয়ে বলেন, ‘একটা কথা মনে রেখ; এই বয়সে তোমার বাবা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ’ আমার বাবা-মার একটা মজার বিষয় ছিল, তারা আমাকে ঘরের দেয়ালে ছবি আঁকতে দিতেন।

কেন দিতেন জানি না। তবে আমি যখন দেয়ালে ছবি আঁকতাম তখন তারা আমাকে কিছুই বলতেন না। ঘরের দেয়াল ভরা ছিল আমার আঁকা ছবি। কেন দিতেন জানি না। হয়ত ভাবতেন, আমার প্রতিভা বিকাশ যদি দেয়ালে হয় তাতে কোনো আপত্তি নেই।

তাই প্রতিটি মানুষকে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। প্রতিটি মানুষকে বাঘের মতো হতে হবে। বাঘের মতো শক্তি থাকতে হবে। সবসময় কৌতুহলী হতে হবে। সবসময় হাসি-আনন্দের ভেতর সময় কাটাতে হবে।

আমি খুব তাড়াতাড়িই মারা যাচ্ছি। আমি এখনো হাসি-আনন্দের মধ্যে সময় কাটাচ্ছি। সামনেও কাটাবো। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত হেসে যাবো। যদি নিজের স্বপ্নগুলোকে পেতে চাও তবে সব সময় সত্যি কথা বলতে হবে।

দ্বিতীয়ত হচ্ছে, ক্ষমা চেতে শেখো। ক্ষমা চাওয়া খুব কঠিন কিছু না। কয়েকটি বাক্য বলতে হবে। ‘আমি দুঃখিত। এটি আমার ভুল ছিল।

কীভাবে আমি সঠিকভাবে করতে পারি?’ এই সামান্য কয়েকটি লাইন আমরা বলতে পারি না। সবশেষ হচ্ছে, প্রতিটি মানুষকে বিশ্বাস করা উচিত। প্রতিটি মানুষকে তার কাজের জন্য সময় দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে সঠিক কাজ বের হয়ে আসবে। আরেকটি বিষয় আমি বলতে চাই।

সেটা হলো, অন্যের নামে অভিযোগ করে কখনো কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। তোমাদের কি মনে হয়? অন্যের ভুল-ত্রুটি খুঁজে তারপর অভিযোগ করে সময় নষ্ট করা প্রয়োজন; নাকি নিজের কাজটা সঠিকভাবে করে সমস্যা সমাধান করা প্রয়োজন? সুতরাং অভিযোগের পেছনে না ছুটে কাজ করো। পরিশেষে হলো, আমি কেন এবিষয়ে কথা বলছি? কেন এ বক্তৃতা? আসলে আমি বোঝাতে চেয়েছি কীভাবে জীবনটাকে যাপন করতে হবে। কীভাবে কাজ করলে স্বপ্ন নিজ থেকে তোমাদের কাছে চলে আসবে। সেটাই বোঝাতে চেয়েছি।

যদি তুমি সঠিকভাবে নিজের কাজ করতে পারো তবেই স্বপ্ন তোমার কাছে আসবে। হয়ত এখানে কেউ কেউ আজকে বক্তৃতায় লাভবান হবে। তবে সত্যিকথা বলতে কী, আজকে এখানে উপস্থিত ৪০০ বেশির মানুষের জন্য দেইনি। দিয়েছি মাত্র তিনজনের জন্য। তারা হলো আমার তিন সন্তান।

ধন্যবাদ। ~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~ - মূল লেখা > http://bit.ly/KSe1Lq ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.