ছয় বলে তিন রান।
অধিনায়ক আমার হাতে বল তুলে দিলেন। আমার উপর তার এমন ভরসা হতেই পারে। এর আগেও বেশ কয়েকবার শেষ ওভারে বল করে দলকে জিতিয়েছিলাম। আমার নিজের উপরও যথেষ্ট কনফিডেন্স ছিল, থাকে সবসময়।
কিন্তু তারপরও সেদিন কেমন জানি ভয় ভয় করছিল। কারণ সেদিনকার সেই ম্যাচটার সাথে শ্রাবণীর অনেকখানি যোগাযোগ ছিল। শ্রাবণী হল সেই মেয়ে যাকে আমি ভালবাসতাম। খেলা শুরুর আগের দিন সে শর্ত দিয়েছিল যদি অ্যা জার্নি বাই বোট ক্লাবকে জেতাতে পারি তবে সে আমাকে ভালবাসবে এবং সাথে বিনামুল্যে একটা বিশেষ পুরস্কার দিবে। সঙ্গত কারনেই পুরস্কারটার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাইছি না।
ঐ মুহুর্তে যখন শেষ ওভারটি করার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হল ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল পুরস্কারটা এখন আমার হাতের মুঠোয়। তবু ক্রিকেট খেলা বলে কথা। কখন কি হয়ে যায় তা মোটেও টের পাওয়া যায় না আগেভাগে। ছয় বলে ছত্রিশ রান করেও ম্যাচ জেতানোর রেকর্ড আমাদের সকলের জানা আছে। তাই দুরুদুরু বুকে বল শুরু করলাম।
আমি সবসময় মস্তিষ্ক দিয়ে বল করি। হাত দিয়ে না। কোন বলটা কিভাবে করলে ভাল হয় তা আগে ঠিক করি। এখন যে ব্যাটসম্যান স্ট্রাইকিং এন্ডে, সে বেশ দক্ষ। ২৫০ রানের আমাদের বিশাল ইনিংসকে তাড়া করে সে একাই খেলছিল।
তখন তার ব্যক্তিগত রান ১৫০। তাই ভাবলাম, এ ব্যাটসম্যানকে আউট করার চিন্তা না করে যদি আঘাত করে আহত করতে পারি, সেটাই ঢের ভাল। স্লো মিডিয়াম বল করি বলেই হয়তো সে হ্যালমেট পড়েনি। এ সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে চাইলাম। বলটা হয়েছিলও মনমতো।
সরাসরি গিয়ে পড়ল ব্যাটসম্যানের মাথায়। নো বল এবং ব্যাটসম্যান মাটিতে। ইয়াহু! ব্যাটসম্যান রিটায়ার্ড হার্ট!
৬ বলে ২ রান। ব্যাট হাতে নতুন ব্যাটসম্যান। আমি নিশ্চিন্তে একটা ইয়র্কার ছেড়ে দিলাম।
হাউজ দ্যাট!! ব্যাকফুটে যাওয়া ব্যাটসম্যানের পায়ে আঘাত করল বল। পা ছিল বলে রক্ষা। নয়তো অবধারিত ছিল অক্কা। আম্পায়ার আঙল তুলতে বাধ্য।
৫ বলে ২ রান।
হাতে ২ উইকেট।
তার আগে সেরে নেই এই খেলার ভূমিকাটা। আমাদের গ্রামে ছোটখাটো একটা নদী ছিল। সবাইকে নদী পার হয়ে বাজারে যেতে হতো। কিন্তু নদীতে নৌকা নাই।
নৌকা না থাকায় সবাইকে নদী পেরুতে সাঁতার দিতে হতো। তো আমাদের মধ্যে যাদের পরিবারে সাঁতারুর সংখ্যা কম, নদী পার হবার মতো শক্ত সামর্থ্য লোকের অভাব, তাদের দাবী -নদী পারাপারের জন্য একটা নৌকা তৈরী হোক। অন্যদিকে, যাদের সাঁতারু নিয়ে কোন সমস্যা নেই, তাদের দাবী- ওসব নৌকা-টৌকার কোন দরকার নাই। সাঁতার দিতে হয় বলে আমরা যথেষ্ট সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। নৌকা তৈরী করাটা খরচের কাজ এবং ঘাটে নৌকা দাঁড়িয়ে থাকলে কেউ আর সাঁতরে নদী পার হতে চাইবে না।
সবাই আলসে হয়ে যাবে। তো, নৌকা নিয়ে আমাদের গ্রামে তখন দুটা দল। আর গ্রামে দুটা ভিন্ন ভাবধারার দল থাকলে, সমঝদাররা বুঝতেই পারছেন কি হয়ে থাকে। সবসময় সব বিষয়ে দুটা দল দুদিকে দাঁড়িয়ে যায়। একটা উদাহরন দিলে ব্যাপারটা আপনাদের কাছে আরো স্পষ্ট হবে।
সেদিন হঠাৎ করে একটা গ্রাম্য বৈঠকে একজন বলল, সে নাকি স্বপ্নে বিরাট একটা মাছ দেখেছে। তখন একজন বলে উঠল, মাছ দেখলে নাকি অর্থযোগ হয়। আরেকজন এর বিরোধিতা করল। বলল, একটা মাছ দেখলে অর্থ আসে না। টাকা আনতে হলে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ দেখতে হয়।
তখন সারা গ্রামে ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়ল এবং এক ঘন্টার মধ্যে দেখা গেল নৌকা পক্ষের লোকেরা বলছে, অর্থ আসবে, সাঁতার পক্ষ বলছে, অর্থ আসবে না। তারপর মারামারি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ককটেল বিষ্ফোরন এবং শেষ পর্যায়ে মানুষ খুনোখুনি। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটত।
এভাবে আমাদের গ্রামের জনসংখ্যা কমে যাওয়াতে সবাই এক সময় বুঝতে পারল আমাদের এই একগুয়েমীর কারনে মূলত ক্ষতি হচ্ছে আমাদের গ্রামের। আমরা বুঝতে পারলাম, একে একে প্রতিভাবান মানুষগুলাকে হারিয়ে ফেলায় অন্যান্য গ্রাম থেকে আমর ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি।
পাশের গ্রামগুলার সাথে কাবাডী খেলা হলে , ক্রিকেট, ফুটবল খেলা হলে আমরা খুব সহজেই হেরে যেতাম। এমনকি শেষের দিকে ষাঁড়ের লড়াইয়েও আমাদের গ্রাম হেরে গেল। অথচ প্রতিবছর মহেশ নামের ষাঁড়টির বদৌলতে এই খেলার শিরোপা আমাদের জন্য পূর্ব নির্ধারিত থাকত। দুর্ভাগ্যবশত মহেশের উপর একটা ককটেল পড়ে যাওয়ায় একদিন ষাঁড়টি মারা গেল। সত্যি কথা বলতে কি ষাঁড়ের লড়াইয়ে হেরে যাবার পরপরই সবাই বুঝতে পারে নিজেদের বেকামী।
সবাই আমরা বুঝতে পারি, এভাবে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করলে আল্টিমেট ক্ষতিটা নিজেদেরই। তাই সবাই মিলে ঠিক করল, নৌকার বিষয়ে একটা সমাধান হোক। সেই সমাধানের জন্যই ছিল আমাদের সেই ক্রিকেট ম্যাচ। আমি অ্যা জার্নি বাই বোট ক্লাবের খেলোয়াড়, আমাদের অপোনেন্ট স্যুইমিং ক্লাব। আমাদের দল জিতলে নৌকা সবসময় ঘাটে থাকবে।
৫ বলে ২রান।
আগের বলটা দিয়েছিলাম ইয়র্কার। এবার করলাম একটা স্লো-ডেলিভারী। লাইন লেন্থ ঠিক রেখে হঠাৎ স্লো ডেলিভারী খুব কাজে দেয়। আগের বলটায় গতি যেহেতু অনেক বেশি ছিল নতুন আসা ব্যাটসম্যান আবারও একটা উচ্চ গতির বল আশা করছিল।
আমার এই হঠাৎ ধীর গতির বল তাকে ঘাবড়ে দিবে। ঘাবড়ে গিয়ে উল্টা পাল্টা কিছু করে বসতে পারে তখন।
যা ভেবেছিলাম তাই হল। আউট না হলেও একটা ডট বল আদায় করে নিতে পারলাম।
৪ বল।
২ রান।
৩ বল। ২ রান।
২ বল। ২ রান।
যেমন যেমন চাচ্ছিলাম, ঠিক তাই হচ্ছিল। বল অনেক সময় শাসন মানতে চায় না। কিন্তু সেদিন ব্যতিক্রম হচ্ছিল দেখে বেশ আনন্দ হচিছল আমার। আরো আনন্দিত শ্রাবণীকে পাবো বলে। শ্রাবণী নিশ্চয়ই টিভিতে খেলা দেখছিল তখন।
আমাদের গ্রামে হাতে গোনা কয়েকটি টিভি ছিল তখন। চ্যানেল সংখ্যাও ছিল মাত্র তিনটি। টিটিভি, শিটিভি, হিটিভি। শ্রাবণী কোন চ্যানেল দেখছে আমার মনে তখন কেবল এই প্রশ্নটাই খেলা করছিল। যদি শিটিভি দেখে তাহলে সাড়ে সর্বনাশ।
আমার এতো কষ্ট করে এতো ভাল খেলায় তখন কিছুই হবে না। এই টিভি চ্যানেলটা আমাদের ভাবধারার সম্পূর্ণ বিরূদ্ধে। তারাও চায়না গ্রামে নৌকা আসুক। ধরা যাক, শেষ বলে ব্যাটসম্যান বলটা উপরে তুলে দিয়ে কট আউট হল। শিটিভি করবে কি জানেন? শিটিভি আগেকার কোন খেলার ফুটেজ থেকে দৃশ্য কেটে এনে সেই বলটাকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে তাকে ছক্কা বানিয়ে দেবে।
হিটিভি দেখলে আমার আবার নো টেনশন। শেষ বলে যদি ব্যাটসম্যান ছক্কা ও মারে তাকে কট আউট করতে বিন্দুমাত্র কার্পন্য করবে না আমাদের সমর্থনকারী এই হিটিভি। অন্যদিকে সরকারী চ্যানেল টিটিভির কথা নাইবা বললাম। সর্বকালের সব সরকারের টিভি চ্যানেল বোধ করি একই রকম।
তাই কায়মনোবাক্যে চাই শ্রাবণী যেন বুদ্ধি করে হিটিভি দেখে।
১ বল। ১ রান।
আউট! আমি পেরেছি! শ্রাবণী, আমি পেরেছি। তোমার কথামতো আমি একাই হারিয়ে দিলাম আমাদের চিরশত্রু স্যুইমিং ক্লাবকে।
পুরস্কার দিতে এসেছিলেন নব নির্বাচিত গ্রামমন্ত্রী জনাব ইমরুল সাহেব।
তার হাত থেকে আমরা পুরুষ্কার হিসেবে একটা নৌকা পেয়ে বেশ ভাল লাগল। তবে তার থেকে বেশি ভাল লাগছিল শ্রবণীর ঘোষণাকৃত পুরস্কারের কথা ভেবে। কী পুরস্কার দেবে শ্রাবণী আমাকে? ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল আমার। তাই তড়িঘড়ি করে গ্রামের এক মাত্র মোবাইলের দোকানে কল দিয়ে শ্রাবণীকে চাইলাম।
‘হ্যালো শ্রাবণী।
কোন টিভি দেখেছ?’
‘টিটিভি। ’
‘দেখেছো শ্রাবণী? আমরা জিতেছি। ইনফ্যাক্ট আমিই জিতিয়েছি দলকে। একদম তুমি যেভাবে চেয়েছিলে সেভাবে। খেলা দেখেছো?’
‘আরে না।
খেলা তো দেখায়নি। অন্য চ্যানেলগুলাও দেখা যাচ্ছিল না। ’
‘দেখায়নি? তবে আমি যে টিটিভি ক্যামেরাকে মাঠে দেখলাম। ’
‘ খেলাই দেখাচ্ছিল তো। কিন্তু সারাক্ষণ নতুন গ্রাম মন্ত্রীকে দেখিয়েছে।
দেখতে যা হ্যান্ডসাম! তাই না?’
শ্রাবণীর প্রশ্ন শুনে রাগ হল খুব। কিছু বললাম না তাই। চুপ করে থাকলাম।
‘উনি নাকি খুব জিনিয়াস স্টুডেন্ট ছিলেন। জীবনে নাকি পরীক্ষায় ফেল করেননি!’
শ্রাবণী বলেই যাচ্ছে।
‘এই টিটিভিটা জানি কি! মন্ত্রী সম্পর্কে এতো কিছু বলল, শুধু বলল না উনি বিবাহিত কিনা। নিশ্চয়ই বিবাহিত না। এতো কম বয়েস! মাত্র ২৫! তুমি কি কিছু জানো?’
‘কি জানি?’ মুখ খুললাম এবার।
‘তুমি কি জানো, মন্ত্রী বিয়ে করেছেন কি না?
আমি ব্যাপারটা আসলেই জানতাম না। তাই কলটা কেটে দিলাম! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।