জীবনটা খালি ফ্যান্টাসিতেই কেটে গেল। । তখন বয়স চার কী পাঁচ। একদিন বললাম-''আমি ‘নতুন কড়ি’তে গান করব"। ।
'আব্বু বললেন-''নতুন কুঁড়িতি না নতুন ভূষিতি নিবেনে তুমারে''। তা-ই হল
''কমিক বই ফালতু,পয়সা নষ্ট। '' আম্মুর এমন অভিযোগের উত্তরে ক্লাস টু কী থ্রি তে থাকতে বলেছিলাম'তোমার পয়সায় আর পড়ব না। নিজে লিখে সেটাই পড়ব'। খাতায় ছক কেটে,ডায়ালগ বক্স একে আমি সত্যিই কমিক লিখতে শুরু করলাম!
আম্মুর কষ্ট ছিল,মেয়ে পাশ করে কিন্ত প্লেসপায়না।
প্রায়ই ভাবতাম আমি-প্রথম না,টেনেটুনে দশমই হয়েছি । আব্বু-আম্মু খুশি হয়ে রেজাল্টের দিনই আমাকে নিয়ে গেছেন শিশুপার্কে। সেখান থেকে আড়ং । আড়ং থেকে কেনা ফ্রকটা ট্রায়াল রুম থেকে পরে আমরা গেছি ‘মিডনাইট সানে’। সেখান থেকে ডিনার খেয়ে সংসদ ভবন হয়ে বাসায় ।
কিন্ত,সেই মজার রাত আর আসেনি। পরীক্ষা দিতাম ,কিন্ত,বুঝতাম না তা কেমন হল। চামেলী-সিমিদের উৎসাহে বেশ উন্নতি হল ক্লাস সিক্সে । কিন্ত,প্লেস ছুটলো সেবারেও।
ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষার পর ঘটলো জীবন বদলানো এক ঘটনা।
একটা বন্ধু হল। নাম কিশোর,ভালো নাম সারতাজ। খুব সুন্দর । মাথাভরা ঘন,সোজা চুল। কালো দুটো চোখ।
ওর প্রিয় রঙও ছিল কালো। প্রায় সবসময়ই কালো শার্ট পরে থাকত। ফর্সা টুকটুকে গায়ের রংটা তাতে আরও বেশি ফুটে উঠত। কিশোর আমার সাথে সারাদিন গল্প করত,দাবা খেলত,গ্রুপস্টাডিও করত। ক্লাস এইটের ফাইনালে আমি মাত্র এক নম্বরের জন্য এগারো তম হই ।
আম্মুর বকা আবারও। কিন্ত,আমি জানতাম কিশোর থাকলে প্লেস একদিন হবেই । সারাক্ষন ওর কথা ভাবতাম । দোকানে গেলে ছেলেদের পোশাকগুলো দেখে ভাবতাম ‘এটা কিশোর পরলে কেমন লাগতো’?একদিন তো একটা কালো পাঞ্জাবী এমনভাবে নেড়েচেড়ে দেখছিলাম যে দোকানদার জিজ্ঞেস করেই বসলো-‘কী আপা,পছন্দ?’ক্লাস টেনের টেস্টের রেজাল্ট বেরলো,বিজ্ঞান শাখায় আমি ফার্স্ট। এস এস সি’র আগে শুরু হল তুমুল পড়া।
সারারাত পড়তাম। ভোরে ক্লান্ত হয়ে পড়লে কিশোরের বুকে হাত রেখে ঘুম । বন্ধুরা,প্লিজ ভয় পেয়ো না। কিশোর নামে আসলে কেউই ছিল না। সবই আমার ফ্যান্টাসি আমি বিশ্বাস করতাম কিশোর আছে,আমার শুধু ওকে খুঁজে বের করার কষ্টটুকু করতে হবে ।
কলেজে থাকতে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাতে হয়েছে কয়েকবার । ঢাউস সেই মেশিনের দিকে তাকিয়ে একদিন ভাবলাম-there must be a brunch of knowledge which sets a link between human body and machine.থাকতেই হবে। নইলে এসব মেশিন তৈরী হচ্ছে কী করে?মেশিনগুলো যেহেতু ইলেক্ট্রনিক সেহেতু নিশ্চয়ই সেই বিদ্যা EEE’র অংশ। ইয়েস,আমি EEE –ই পড়ব । কাউকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করার দরকারই মনে করিনি।
ভার্সিটির একটা সিমেস্টার শেষে নিশ্চিত হলাম ওরকম একটা বিষয় আসলেই আছে। নাম ‘Biomedical electronics’.আমার মুখে বিজয়ীর হাসি,’অনুমানের উপর বিশ্বাস করেই I have come to the right way’
একেকটা সিমেস্টার শুরু হত আর ভাবতাম-টেনেটুনে হাফ স্কলারশিপটা ধরতে হবে এবার । কাপড় কিনব,যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য । আমার রেজাল্টের অবস্থা যে কী ছিল তা তো বন্ধুরা অনেকেই জানো
প্রথম চাকরি পেয়ে হলাম বেজায় খুশি । এবার ঠ্যাকায় কে?বিরাট এক্সপার্ট হব ।
একটা ফোন পেয়ে চমকে উঠব একদিন । ওপাশ থেকে বলবে-‘কিছু আইডিয়া শেয়ার করতাম । সময় হবে আজ সন্ধ্যায়?’ নাহ,সেই অনুরোধ ফেলতে আমি পারব না। প্রিয় কালো ব্লেজার,সাদা টপ,জিন্সটা চাপিয়ে এক ক্যান কোক খেতে খেতে গিয়ে হাজির হব । ‘কেমন আছো?’ এই প্রশ্নের উত্তরে বলব,-"ক্যানটা কোথায় ফেলা যায়’'?
এই ফ্যান্টাসিটা সত্যি না হলেও ঝড়ে বক মরা স্টাইলে অনেকটাই কাছাকাছি গিয়েছিল।
সত্যি বলছি। জীবনে ওই একবারই মনে হয়েছিল মিলন শুধু মগজে মগজেই সম্ভব। বাকি শরীর থাকারই কোন দরকার নেই ।
কম্পনার চাকা থামেনি আজও। প্রায়ই ভাবি কোনো একদিন পুরোপুরি ডুবে যাব সৃষ্টির নেশায়।
চলে যাব সব ক্ষুধা-তৃষ্ণার উর্দ্ধে। থামাতে পারবে না আমাকে কেউই,কোনকিছুই । চোখদুটো লাল হয়ে যাবে,ঘড়ি দৌড়বে,গনগন করবে কম্পিউটার,তবুও আমি থামব না। হঠাৎ আমার ধ্যান ভাংবে পেছনে এসে দাঁড়ানো কারো নিঃশ্বাসের শব্দে । ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে আমি চমকে যাব ।
কালো কাপড় পরা একজন দাঁড়িয়ে ,হাতে এক গ্লাস ফেনা ওঠা কোক । "কিশোর???না না। তুমি কিশোর নও। আমি ভুল দেখছি। প্লিজ যাও'’।
কিন্ত সে যাবে না। হাতের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলবে –"যথেষ্ট হয়েছে,এবার ওঠো। " ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।