আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফ্যান্টাসি ফিকশনঃ মহাকাশযাত্রীর ডায়েরি

অর্থ নয়, কীর্তি নয়...আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে

মহাকাশযাত্রীর ডায়েরি ছুটির দিন। সকালের আড়মোড়া ভাঙতে দুপুর হয় হয়। কাজকর্ম তেমন নেই। ভাবলাম স্টাডি রুমটা অনেক দিন অগোছালো হয়ে আছে, একটু গোছানো যাক। রাতেই নাস্তা বানানো ছিল।

ওভেনে গরম করে নিয়ে শীতের হালকা রোদে পিঠ দিয়ে প্রাতরাশ শেষ হল। তারপর একটা ন্যাকরা হাতে বইপত্র মোছামুছির অভিযানে নেমে পড়লাম। গোছাতে গিয়ে কত পুরনো রেকর্ডই না হাতে পড়তে লাগল। একেকটা ডকুমেন্ট মানে একেকটা গল্প। গল্পের ভেতরে ডুবে গিয়ে গোছানোর কাজটা মাটি করতে চাচ্ছিলাম না।

তাই যথাসম্ভব নির্লিপ্তভাবেই শুধুমাত্র কাজের জন্য কাজ করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু চাইলেই সব সময় সবকিছু নিজের মত হয়ে ওঠে না। একটা শেলফ থেকে কিছু বই এর সাথে এমন এক ডায়েরি বেরিয়ে পড়ল যেটা দিনটাকে আর স্টাডি গোছানোর কাজে লাগতে দিল না। এই ডায়েরি আমার হাতে এসেছিল এক মহাজাগতিক হেঁয়ালির মধ্য দিয়ে। ঘটনাটা এতটাই কাকতালীয় ছিল যে একটি বিড়ালকে একটি টাইপ রাইটারের ওপর ছেড়ে দিলে জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা যদি টাইপ হয়ে বেরিয়ে আসত তাতেও আমি এত অবাক হতাম না।

সেবার আমরা একটা প্রজেক্টের অংশ হিসেবে সৌরজগতের একেবারে সীমান্তে পাড়ি দিয়েছিলাম। আমাদের প্ল্যান ছিল প্রথমে ইউরেনাস এর উপগ্রহ এরিয়েলে ল্যান্ড করা। সেখানে ঘণ্টা সাতেক স্টে করে প্লুটোর উপগ্রহ শ্যারনকে প্রদক্ষিণ করে পৃথিবীতে ফিরে আসা। সেবছর ঐ সময় এরিয়েল, মিরান্ডা আর ওবেরন প্রায় একই সরল রেখায় ছিল। এবং ইউরেনাস অঞ্চল থেকে প্লুটোতে যাবার পথও ঐ রেখা বরাবর ছিল।

এরিয়েলে আমরা ঠিকঠাকমতই ল্যান্ড করতে পেরেছিলাম। মিরান্ডা পার হওয়ার সময় নভোযানটা গড়বড় শুরু করে। আমাদেরকে ওবেরনে জরুরি অবতরণের একটা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু সে সিদ্ধান্তের পরপরই নভোযানটা এমনভাবে বিগড়ে যায় যে আমাকে নভোযানের বাইরে বেরিয়ে এসে বেশ কিছু সময় ধরে একটা রিপেয়ার ওয়ার্ক সারতে হয়। রিপেয়ার প্রায় শেষের দিকে।

হঠাত করেই একটা টুল আমার হাত থেকে ছুটে যায়। টুলটা ধীরে ধীরে নভোযান থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। এই সিচুয়েশন ডিল করার জন্য আমাদের একটা বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। ব্যবস্থাটা অনেকটা জাল ফেলে ধরার মত। সেটা অ্যাপ্লাই করে টুলটা ফিরিয়ে নিয়ে এলাম।

কাজ শেষ করে নভোযানে ফিরে এসে জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতে দেখি লাল মলাটের একটা ডায়েরি সেই জালে আটকা পড়ে আছে !!! আমি জীবনে এর চেয়ে বেশি অবাক আর কোনদিন হই নি। ডায়েরিখানা এক মহাকাশ অভিযাত্রীর। ঝরঝরে ইংরেজিতে লেখা এই ডায়েরিখানা প্রথমবার পড়তে পড়তে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। এই ছুটির অলস সকালে সেই বিস্ময় আরো একবার আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। পড়ে রইল সকল কাজ, ছুটির সকল অলস আবদার।

আবার ডুবে যেতে লাগলাম সেই অদ্ভুত ডায়েরির ভেতরে। ----------------------------------- *** এই অভিযানে আসাটা ঠিক হল কিনা এখনো বুঝে ওঠার সময় হয় নি। সন্ডার্স আমাকে লিখেছিল ক্যালেনবাখ নাকি আফ্রিকার কোন উপকূলে ছবি তুলতে গিয়ে বোতলে ভরা একটা চিঠি পায়। ডক্টর মানরো নামে একজন ডাক্তারের লেখা। ব্ল্যাকহোল ব্র্যান্ডন নামে এক জলদস্যুর অত্যাচারের শিকার এই ডাক্তার এক অজানা দ্বীপের কথা লিখেছিলেন সেই চিঠিতে।

সেই দ্বীপে নাকি এক অদ্ভুত ফল তিনি দেখেছেন যার আশ্চর্য গুণ আছে। অনেক কাল আগের চিঠি। তারপরও সেই চিঠির উপর ভর করে প্রফেসর শঙ্কু সহ ওরা সেই অজানা দ্বীপের উদ্দেশ্যে একটা অভিযানে যেতে চায়। আমাকে ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে পেলে খুশি হবে লিখেছিল। আমার হাতে তখন আরেকটা অভিযানের অর্থাৎ বর্তমান অভিযানের খসড়া।

সন্ডার্সকে না করে দিতে হল। এই অভিযানের শুরু অনেকটা এভাবে। আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে করতে এক সন্ধ্যায় হঠাৎ আমার কম্পিউটারে একটি অপরিচিত সিগন্যাল ধরা পড়ে। এল্টেয়ার, ভেগা এবং ডেনেবকে নিয়ে একটি ত্রিভুজ আঁকলে তার ভরকেন্দ্রের কাছাকাছি অঞ্চল থেকে সিগন্যালটা আসছিল। আমার বেশ কিছুদিন ধরে নানা আলামত থেকে মনে হচ্ছিল মহাকাশের ওই অংশে মানব সদৃশ কোন প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে।

এমন অবস্থায় সেই সিগন্যাল পেয়ে আমি প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ি। কয়েক মাস ধরে অনেক চেষ্টা করি সিগন্যালটার মর্ম উদ্ধার করতে কিংবা অন্তত প্রেরণকারীকে একটা সিগন্যাল পাঠাতে। কিন্তু ব্যর্থ হই। আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। বিষয়টা কারো সাথে শেয়ার করা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারলাম না।

এমন এক দিনে আবার একই ধরণের আরেকটা সিগন্যাল পাই। এবার কিছুটা সাফল্যের মুখ দেখি। অনেক গবেষণার পর মনে হল এটি পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা একট সিগন্যাল। যারা পাঠাচ্ছে তারা কোন একটা বিষয়ে পৃথিবীর মানুষের সাহায্য চাচ্ছে। কি বিস্ময়কর ! ইতিবাচক রিপ্লাই করার চেষ্টা করি।

সিগন্যাল পৌঁছাতে পেরেছিলাম কিনা জানি না। এটি কি সত্যি সত্যি এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল কোন সিগন্যাল ? তাহলে কি সত্যিই পৃথিবীর বাইরেও প্রাণ আছে ? আর তারা সত্যি সত্যি আমার সাথে যোগাযোগ করছে ! আমার সাথে ! কিন্তু এখন কী করা উচিত ? শিহরণ, ফ্যান্টাসি, সম্ভব, অসমম্ভবের দোলায় আমার কয়েক দিন কাটল। আমার রিপ্লাই কি তারা পেল ? সত্যি সত্যিই যদি আমার রিপ্লাই তারা পায় আর এর পর কিছু ঘটতে চলে তাহলে ? তাহলে কী ? কী ঘটতে পারে ? নিজেই প্রশ্ন করি, নিজেই উত্তর খুঁজি। তখনকার মানসিক অবস্থা ঠিক বলে বোঝানোর মত নয়। কী কারণে বলতে পারব না, তবে একটা বিষয় আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম যে এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলা যাবে না।

আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল সত্যিই যদি যা ভাবছি তাই হয়, তারা চাচ্ছে না বিষয়টা কারো সাথে শেয়ার করি। এরকম মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আবার সেই সিগন্যাল ! আমার বিশ্বাস ছিল এবার আগের চেয়ে আরো স্পষ্ট ম্যাসেজ পাব। ঠিক তাই হল। এবার ম্যাসেজটা একেবারে স্পষ্টভাবে বোঝা গেল। ম্যাসেজটা বলছেঃ ডিয়ার প্রফেসর, আশা করি এবারের সিগন্যালটা আগের চেয়ে আরো স্পষ্ট করে বুঝতে পারছেন।

আমরা আপনাদের সৌর জগত থেকে অনেক দূরে থাকি। মানব জাতিকে আমাদের সাদর সম্ভাষণ। আপনি জেনে খুশি হবেন মিল্কি ওয়ের মতই আরেকটি ছায়াপথে প্রায় সৌর জগতের মতই একটি গ্রহপরিবারে আমাদের বসবাস। সৌর জগতের সঙ্গে আমাদের সামান্য পার্থক্য হল এই যে মিল্কি ওয়ে'র সৌর জগতের গ্রহগুলো প্রায় একই সমতলে অবস্থিত আর আমাদের সৌর জগতটা একটা ত্রিমাত্রিক অবয়ব গঠন করেছে। এ কারণে এই দুই গ্রহে প্রাণের বিকাশে কিছু ফারাক ঘটেছে।

কিন্তু একটা বিষয়ে আমাদের একটি অভিন্ন ঐক্য রয়েছে। আমরা উভয় গ্রহের বাসিন্দারাই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্য বিষয়ে সমান কৌতূহলী। সৌভাগ্যবশত এ বিষয়ে আমরা আপনাদের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে আছি। আমরা আলোর গতিকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের বিশ্বাস আমরা সৃষ্টি রহস্য উদঘাটনের অনেক কাছে চলে এসেছি।

এ কাজের জন্য আমরা ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমণে বেরোনোর পরিকল্পনা করছি। আপনার কাছে এই উক্তিটি অবাস্তব মনে হতে পারে। আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেই, আমরা আলোর দ্রুতিকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা জ্ঞান বিজ্ঞানে আপনাদের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও একটি বিষয়ে আপনারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। সেটি ঠিক কী তা সম্পূর্ণভাবে আমরা ব্যাখ্যা করতে অক্ষম।

আপনাদের পৃথিবীর একজন বাসিন্দা আমাদের ভ্রমণে থাকলেই কেবল সেই অভাব পূরণ হবে। আমরা আপনাকে এই কাজের জন্য উপযোগী মনে করছি। এই অভিযাত্রায় আমাদের প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সম্ভাব্য দ্রুতি ব্যবহার করা হবে। কিন্তু যেহেতু আপনারা এই গতির সঙ্গে অভ্যস্ত নন, আমরা দুঃখের সাথে বলছি এই যাত্রায় আপনার আয়ু খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসবে। আপনি যদি আমাদের এই মহাযাত্রার ভ্রমণসঙ্গী হয়ে এই যাত্রাকে পূর্ণতা দিতে চান তাহলে আমাদের জানান।

আপনাকে বিশেষ ব্যবস্থায় আমাদের গ্রহে নিয়ে আসা হবে। আর হ্যাঁ, অনুগ্রহ করে এই বিষয়টি কারো সঙ্গে শেয়ার করবেন না। এই ম্যাসজ পেয়ে আমি বেশ কয়েক দিন অনেক ভেবেছি। প্রথমত এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে এটি ফ্লাইং সসারের মতই আরেকটি প্রপাগান্ডা। যদি তাই হয় তাহলে পুরোটাই একটা লস প্রজেক্ট।

আর যা ভাবছি বাস্তবিক যদি তাই হয়, মানব জাতির সদস্য হিসেবে আমাকে বাছাই করার কোন যৌক্তিক কারণ দেখছি না। আরেকটি খটকা হল বিষয়টি কারো সাথে শেয়ার না করতে বলা। সবই মেনে নিলাম। ওরা তো বলছে আমার আয়ু খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে। ওরা কি সত্যিই আলোর বেগ অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে ? এটি কি সম্ভব ? এর উত্তর আমার জানা নেই, তবে মহাকাশের যে অঞ্চল থেকে এই সিগন্যাল আসছে তা কিন্তু এই তথ্যের সত্যতার দিকেই ইঙ্গিত করে।

এত দূর থেকে এত কম সময়ে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ আসা সম্ভব নয়। ওকে, ধরে নিলাম তারা আলোর গতি অতিক্রম করেছে। কিন্তু আমি রিপ্লাই করলে সেই রিপ্লাই তো আলোর বেগেই যাবে। এবং এই গতিতে যেতে থাকলে আমার জীবদ্দশায় এই রিপ্লাই তারা পাবে না। এমনিতর ভাবতে ভাবতে দিন যাপন কঠিন হয়ে উঠল।

এর মধ্যে আরেকটি ম্যাসেজ পেলাম। এই ম্যাসেজ আমার রিপ্লাই বিষয়ক সমস্যা সম্পর্কে। ওরা লিখেছেঃ আপনি হয়তো আপনার রিপ্লাই এর দ্রুতি বিষয়ে ভাবছেন। আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি আপনার প্রেরিত সিগন্যাল আমরা বিশেষ প্রক্রিয়ায় এক্সেলারেটেড করে সহজেই রিসিভ করতে পারব। এই ম্যাসেজ পাওয়ার পর আমি আর বেশি কিছু ভাবিনি।

এমনিতেই ভাবনার ভার দুর্বহ হয়ে উঠেছিল। একটা চান্স নিয়ে দেখতেই হবে। যদি ফেক না হয় ! আমার আয়ুর বিনিময়েও যদি মানব সদৃশ আরেকটি জাতির সঙ্গলাভ এবং ব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে তাদের অনুসন্ধান জানা যায় তাও ভাল। আমি রিপ্লাই করলাম আমি রাজি। *** এখানে এসে চারপাশ দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম।

এরা ঠিক হোমো সেপিয়েন্স না। এদেরকে বলা যায় হোমোফাইট বা উদ্ভিদ মানব। এদের চুলে ফটোসিনথেসিস হয়। এদের শক্তি চাহিদার বেশিরভাগ এভাবে পূরণ হয়। এ কারণে এরা বছরের পর বছর না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।

এদেরকে দেখে ভীষণ ঈর্ষা হয়। পৃথিবীর মানুষের যদি এদের মত খাওয়ার চিন্তা না থাকত বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন এসব বিষয়ে কতই না সময় দিতে পারত। একারণেই কি এরা বিজ্ঞানে এত উন্নত ? কি জানি। যাদের খাওয়ার চিন্তা নেই তাদের ভাল খারাপ দুই কাজের জন্যই অফুরন্ত সময়। এদের আরেকটা বিষয় বেশ ভাল লাগে।

আমরা খ্রীস্টের জন্মের পর থেকে সাল গণনা করি। এরা সময় গণনা করে বিগ ব্যাং থেকে। একটা মৌল কণা, মানুষ এখনো যার সন্ধান পায়নি, তারা একে ডাকে ঋষভ নামে। এই কণার এক হাজার স্পন্দনের জন্য যে সময় লাগে তাকে এরা সময় গণনার একক করেছে। এখানে আসার পরে জানতে পারি আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে সময় সুড়ঙ্গের শর্টকাট রাস্তা দিয়ে।

এই সুড়ঙ্গ ওরা শুধু আমাকে নিয়ে আসার জন্য তৈরি করেছে। এই সুড়ঙ্গের দুই প্রান্ত যুক্ত থাকে অতি বৃহৎ সময়ের দুইটি প্রান্তে। যাত্রা শুরুর পর বিশেষ প্রক্রিয়ায় সুড়ঙ্গটিকে স্কুইজ করে ফেলা হয়। এভাবে অকল্পনীয় দীর্ঘ সময়ের পথ অকল্পনীয় হ্রস্ব সময়ে পাড়ি দেওয়া যায়। কিন্তু এটাই এদের দ্রুতির চূড়ান্ত সীমা নয়।

এদের সর্বোচ্চ দ্রুতির প্রযুক্তিক নিদর্শন হল আলোক দরিয়া। এটি চৌম্বক ক্ষেত্রপূর্ণ একটি চ্যানেল। চ্যানেলটা দেখতে অনেকটা আলোর তৈরি ঝর্ণার মত। এই চ্যানেলের দুই তীর অতি দীর্ঘ সময় এর দুই প্রান্তকে যুক্ত করে। এর এক তীর থেকে ডুব দিয়ে আরেক তীরে ওঠার জন্য কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে।

এই সময়ে কয়েক হাজার থেকে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরত্ব অতিক্রম করা যায়। *** কয়েক দিন বাদে চারপাশের সাথে কিছুটা অভিযোজিত হওয়ার পর আমাকে মহা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এক সুবিশাল আথিতেয়তা দেওয়া হল। হোমো সেপিয়েন্স এবং হোমোফাইট এর সাক্ষাতের এই ঐতিহাসিক ক্ষণটিকে তারা বিপুল উৎসবের মধ্য দিয়ে বরণ করল। তারপর তাদের নিজস্ব রীতিতে ঘটা করে আমাকে অভিবাদন জানাল এবং বিনোদনের আয়োজন করল। পরের দিনটা সম্পূর্ণ বিশ্রামের জন্য ছেড়ে দিল এবং তার পরের দিন আমাকে নিয়ে এক দীর্ঘ আলোচনায় বসল।

আলোচনার প্রথমে তারা আমাকে তাদের ম্যাসেজের ব্যাখ্যা দিল। এরা আমাকে লিখেছিল সৃষ্টি রহস্য উদ্‌ঘাটনে এরা ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমণে বেরোবে। আর লিখেছিল এই ভ্রমণে আমার সাহায্য দরকার। ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমণে বেরোবার ইচ্ছাটা এদের প্রবল হয়েছে একটা হাইপোথেসিস এর ভিত্তিতে। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে এরা যে হাইপোথেসিস দাঁড় করিয়েছে তা অনেকটা এরকমঃ প্রতিটি পদার্থই কিছু মৌল কণার সমন্বয়ে গঠিত।

এমনকি জীবদেহও এই কণা দিয়েই গঠিত। এই কণার প্রাথমিক গাঠনিক একক পরমাণু। একটা পরমাণু দেখতে একটা সৌর জগতের মতই। পরমাণুগুলো যেভাবে সুসংবদ্ধ হয়ে কোষ-কলা সহ একটি সম্পূর্ণ জীবদেহ গঠন করে, তেমনি করে সৌরজগতগুলোও সুসংবদ্ধ হয়ে একটি অতি অতি বৃহৎ জীবদেহ গঠন করতে পারে। এটির সম্ভাবনা তত্ত্বীয়ভাবে এভাবে বাস্তব যে পরমাণু, অর্থাৎ জড় পদার্থই জীবদেহ গঠন করে।

যদি তাই হয়, তবে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড একটি জীবন্ত সত্তা হতে পারে ! এবং এই সত্তা এত সুবিশাল যে একটি সৌর জগত তাতে একটি পরমাণুর মত আচরণ করে ! আমি শুনে উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলাম ! বলে কী ! এই হাইপোথেসিস আরো বলে, আন্তঃপারমাণবিক দূরত্ব যে পরিমাণ হলে একটা পারমাণবিক বন্ধন গঠন সম্ভব, সৌরজগতগুলো তার চেয়ে বেশি দূরত্বে আছে বলে মনে হয়। এই জায়গাতেই আমাদের প্রয়োজন মানুষের সাহায্য। আমরা খেয়াল করেছি মহাবিশ্বের এমন অনেক ঘটনা, অনেক বস্তু রয়েছে যা শুধুমাত্র আপনারা দেখতে বা পরিমাপ করতে পারেন। ঠিক একই কথা আমাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাদের ধারণা, হোমো সেপিয়েন্স এবং হোমোফাইট একসাথে পর্যবেক্ষণ করলে যে পরিমাণ সৌরজগতের সন্ধান পাওয়া সম্ভব, তাতে আন্তসৌরজাগতিক দূরত্বের আপাত সমস্যাটি সমাধানের একটি সম্ভাবনা তৈরি হবে।

আমাদের এই হাইপোথেসিস পরীক্ষার জন্য আমরা ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমণে বের হব। মহাবিশ্ব দেখতে কেমন তা আমরা দেখব মহাবিশ্বের একদম প্রান্ত থেকে। আমাদের ধারণা, মহাবিশ্বের তারকাপুঞ্জ সসীম কিন্তু মহাকাশ অসীম। যদি সম্ভব হয় আমরা মহাবিশ্বের জ্যোতিষ্কপুঞ্জের একেবারে বাইরে গিয়ে মহাবিশ্বের দিকে তাকানোর চেষ্টা করব। ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমণের এই মহাযাত্রায় আমরা আমাদের প্রযুক্তির সর্বোচ্চ দ্রুতি ব্যবহার করব।

আমরা ইন্টার গ্যালাকটিক হাইওয়ে তৈরি করেছি। এটি ব্যবহার করে আমরা গ্যালাক্সি থেকে গ্যাক্সিতে অতি ক্ষুদ্র সময়ে পৌঁছে যাব। আমাদের বিশ্বাস, এভাবে যতই আমরা মহাবিশ্বের প্রান্তের দিকে এগিয়ে যাব, মহাবিশ্বের প্রকৃত রূপটি ততই স্পষ্ট হবে। *** আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। স্ক্রিনে যে আকাশ দেখছি তা আমি চিনি না।

আমরা এমন এক রহস্যময় জগতে বসবাস করি, নিজের অবস্থান থেকে একটু সরে গেলেই আর চারপাশের কোন কিছুই পরিচিত মনে হয় না। মনে পড়তে লাগল দিক দিশাহীন সমুদ্রের নাবিকের কথা। ধ্রুবতারা দেখে যারা দিক নির্ণয় করত। কোথায় পড়ে রইল ধ্রুবতারা। ধ্রুবতারাও তো বেশিদিন ধ্রুব থাকবে না।

এক সময় সিফিয়াস মণ্ডলের গামা জ্যোতিষ্ক অর্থা এররাই তারকাটিই হবে পৃথিবীর ধ্রুবতারা। আইনস্টাইন একেবারে মোক্ষম কথাটাই বুঝতে পেরেছিলেন। কোন কিছুই ধ্রুব নয়। যাক সে কথা। পরিচিত এই বিশ্বটা ধীরে ধীরে অপরিচিত রূপ নিচ্ছে।

কত সময় যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। কখনো মনে হচ্ছে যাত্রা মাত্রই শুরু হল, কখনো মনে হচ্ছে অনেক দিন হয়ে গেছে। সময়ের আশ্চর্য এই যাত্রার শেষে কী আছে কে জানে। *** সময় সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আমরা অনেকগুলো গ্যালাক্সি ঘুরে ফেলেছি।

আমার সঙ্গীদের খাওয়ার দরকার হচ্ছে না। আমার জন্য বিশেষ প্রক্রিয়ায় খাবার উৎপাদন করা হচ্ছে। এই নভোযানে ছোটখাট একটা খামার বাড়ি করা হয়েছে আমার জন্য। স্ক্রিন দেখে মনে হচ্ছে আমরা গতিশীল হওয়ার পরও মহাকাশের চেহারা ঘুরে ফিরে একই থেকে যাচ্ছে। আমার দু'একবার সন্দেহ হয়েছে আমরা কোন দুষ্ট বৃত্তে আটকা পড়লাম না তো।

*** হোমোফাইটদের ধারণাই ঠিক। ওরা এমন কিছু দেখতে পায় যা আমরা পারি না। এবং একথা উল্টোভাবেও ঠিক। আমার জন্য একটি আলাদা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে। আমার পর্যবেক্ষণ এবং হোমোফাইটদের পর্যবেক্ষণ এক করে একটা সমন্বিত ভার্চুয়াল স্পেস ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে।

এই ম্যাপটা স্বংক্রিয়ভাবে নতুন পর্যবেক্ষণের ফলাফল আপডেট করে নিচ্ছে। *** বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি পার হয়ে এলাম। এখনো উল্লেখযোগ্য কিছু দেখতে পেলাম না। কিসের আশায় কোথায় ছুটে চলেছি কে জানে। *** আমরা অভিযানের দ্রুতি আগের চেয়ে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছি।

এই অভিযানে আসার পর আসলে বুঝতে পারছি মহাবিশ্বকে আমরা আমাদের অজান্তেই একটা সীমানায় বেঁধে ফেলেছিলাম। সেটা ছিল একটা মস্ত বড় ভুল। তবে এই মুহূর্তে আমরা মানব এবং মানবসদৃশ এই জাতির সম্মিলিত প্রয়াসের সর্বোচ্চ আউটপুট দিচ্ছি। সর্বোচ্চ দ্রুতিতে অভিযান চলছে। ইন্টারগ্যালাক্টিক হাইওয়ে, সময় সুড়ঙ্গ, আলোক দরিয়া এবং আমার বোঝার বাইরে আরো অনেক প্রযুক্তি একত্র করে এক মহা গতি প্রয়োগ করা হয়েছে।

পৃথিবীতে এখন দুই শত কোটি বছর পার হয়েছে। আর এই নভোযানে আমাদের হিসাবে আমরা এক বছর পার করেছি। তারা সত্যি কথাই বলেছিল। আমার শরীর দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো বার্ধক্যে আক্রান্ত হতে চলেছি।

এমন লক্ষণই দেখতে পাচ্ছি। এই অভিযান অসম্পূর্ণ রেখেই কি আমাকে চলে যেতে হবে ? *** আমার আয়ু হয়তো আর কিছুক্ষণ আছে। কিন্তু আর দুঃখ নেই। একি দেখছি আমি স্ক্রিনে ! একি দেখছি ! হাত অবশ হয়ে আসছে। আর লিখতে পারছি না।

----------------------------------- ছুটির সকাল গড়িয়ে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। আমি আবার অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম কে এই প্রফেসর, কী নাম এর ? কী দেখেছিলেন তিনি? আর সবচেয়ে বড় বিস্ময় এই ডায়েরি মহাকাশের সেই সুদূর অঞ্চল থেকে মিরান্ডার কাছে কীভাবে এল? উত্তর খুঁজে পাইনি। মহাবিশ্ব বোধ হয় তার সৃষ্টি রহস্য চিরকাল গভীর গোপন সঙ্গোপনেই বয়ে বেড়াবে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.