গোহাটি স্টেশন, আসাম।
ট্রেন থামতেই হাপ ছেড়ে বাঁচল
জামশেদ.। এত দীর্ঘ ট্রেন জার্নির
অভ্যাস নেই তার। অভ্যাস অবশ্য মিলির
ও নেই, কিন্তু তাকে বেশ স্বতস্ফুর্ত ই
দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে জামশেদ অবাক
হয়, এত প্রাণবন্ত কেউ হয় কি করে!
হানিমুনে এসেছে জামশেদ আর মিলি।
জামশেদ টাঙ্গাইলের ছেলে, আর
মিলি বরিশাল। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, দুই
জন যেন দুই ভুবনের প্রাণী। জামশেদ
গম্ভীর রামগরুরের ছানা, আর
মিলি হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত,
অ্যাডভেঞ্চারাস। কিন্তু দুজনের মনের
মিল হতে সময় লাগে নি। অ্যাডভেঞ্চার
মিলির খুব পছন্দ, আসাম আসার প্ল্যান
টা তারই।
জামশেদ ভেবেছিল
কক্সবাজার বা দেশেই কোথাও যাবে,
কিন্তু মিলি র আসাম দেখা চাই। অবশ্য
একটা কারণ আছে এর পিছনে, মিলির
বহুদিনের জিইয়ে রাখা একটা শখ আছে,
বলার পর জামশেদ আর আপত্তি করে নি।
তবে নিজেও একটা শর্ত দিয়েছে,
তারা আগ্রাও যাবে। জামশেদের
তাজমহল দেখার বাসনাও বহুদিনের।
প্রথমে কোলকাতা এসেছে ওরা, সেখান
থেকে ট্রেনে গোহাটি।
ট্রেন স্টেশন
থেকে একটা ট্যাক্সি নিল জামশেদ,
কন্টিনেন্টাল হোটেলে সীট বুক
করা আছে তাদের জন্য।
সকালে ওঠে নাস্তা সেরেই
রিসিপশনিস্ট এর সাথে কথা বলল
জামশেদ
- হ্যালো ম্যডাম, আমাদের একজন গাইড
দরকার, বিজ্ঞাপনে দেখেছিলাম
আপনারা গাইড সরবরাহ করেন?
- অফকোর্স স্যার, আপনি কোথা থেকে শুরু
করবেন ভাবছেন? আমি কিন্তু বলব...
- সকাল দশটার মাঝে কি কোন গাইড
পাওয়া সম্ভব?
- অবশ্যই স্যার, কিন্তু ...
- ধন্যবাদ।
-ইউ আর ওয়েলকাম, স্যার।
দশটার পনের মিনিট আগেই দেখাগেল
গাইড কে।
- আসামে আপনাদের স্বাগতম, স্যার।
রিসেপসনিস্ট বলল আপনারা নাকি কোন
জায়গা নির্দিষ্ট করেন নি...
- রিসেপসনিস্ট ভুল বলেছে, আমাদের
জায়গা ঠিক করা আছে।
- তাহলে তো খুবই ভাল কথা। তা, আজ
কোথায় যাবেন ঠিক করলেন?
এবার মিলি এগিয়ে এল।
- গুলিয়ামবাড় এর নাম শুনেছেন?
সদাপ্রস্তুত গাইড এর চেহারা এবার
কিছুটা অপ্রস্তুত দেখাল।
- জ্বি ম্যাডাম?
- গুলিয়ামবাড়, অই যে ন্যাশনাল পার্ক
থেকে উত্তরে, বনের একটু গভীরে।
- স্যরি ম্যাডাম, এমন কোন জায়গার
নাম পূর্বে শুনি নি। আর উত্তরে বন
অনেক গভীর, আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব
নয়।
জামশেদ দেখল হতাশায় মিলির মুখ কাল
হয়ে গেল। এবার নাক গলাল সে।
- তাহলে আপনি একটু খোঁজ খবর
নিতে পারবেন কেউ যাবে কি না?
- অবশ্যই স্যর কিন্তু তার জন্য কিছু
খরচাপত্তর......
জামশেদ কয়েক টা নোট বাড়িয়ে দিল।
- থ্যাংকস স্যার। আসলে আমার
জানামতেই একটা ছেলে আছে, লোক
নিয়ে গভীরে যায়। খুব ভাল
ছেলে স্যর। আমি ওকে পাঠিয়ে দেব।
চলে গেল গাইড।
নতুন গাইডকে পছন্দ হল না জামশেদ
এর। কেমন যেন ছন্নছাড়া ভাব।
- আপনি গুলিয়ামবাড় এর
মন্দিরে যেতে চান?
মিলি নি সন্দেহ হল, এ লোক
জায়গা চেনে। শুধু গুলিয়ামবাড়
বলে কিছু নেই, আছে গুলিয়ামবাড়ের
মন্দির।
"হ্যাঁ আমরা" জবাব দিল মিলি।
প্রশ্ন টা নতুন গাইড জামশেদ
কে করেছিল। এবার
সে বিরক্তি নিয়ে মিলির
দিকে তাকাল।
- সম্ভব না, সেখানে কোন মেয়ে যায়
না।
হ্যাঁ, এটাও জানে মিলি।
গুলিয়ামবাড়ের কথা মিলি জেনেছিল
প্রাক্তন প্রেমিক রাশেদ এর কাছ
থেকে।
সেই খুঁজে পেয়েছিল ওটি। অমুল্য
এক সম্পদ আছে সেখানে।
আছে পুরাতত্ত্বের বিশাল আবিষ্কার।
কিন্তু ফিরে যেতে চায়নি রাশেদ, কেন
তা মিলি জানে না
বর্তমানে ফিরে এল মিলি। অসহায়
ভাবে তাকাল জামশেদ এর দিকে।
জামশেদ পুরো কাহিনী জানে, সে জন্যই
তার মত মিতব্যয়ী মানুষ এত খরচ আর
ঝক্কিঝামেলা করতে রাজি হয়েছে।
গলা খাকারি দিল জামশেদ।
- আমরা টাকা খরচ করতে রাজি আছি।
- সম্ভব না।
- তুমি যা চাইবে সেই পেমেন্ট ই
পাবে।
- ঘন্টায় এক হাজার টাকা, পারবেন?
আগেই বলি, যেতে প্রায় দু দিন লাগবে,
তা ছাড়া গাড়ি, তাবু, খাবারদাবার সহ
অন্যান্য খরচ ও আপনার। রাজি?
এত!!
প্রায় লাখ রুপির ধাক্কা, কিন্তু
প্রাপ্তির তুলনায় কিছুই নয়।
- বেশ।
- আমার একটা লোক ও আসবে আমাদের
সাথে।
- এটা ইম্পসিবল!
-তাহলে আমি নেই।
গভীর
জংগলে আমি একা যাব না,
বিপদে আপনারা কোন কাজে আসবেন না।
যুক্তি আছে, রাজি হয়ে গেল জামশেদ।
- আমার নাম গোবিন্দ। দুপুর নাগাদ
আমি সব যোগাড় যন্ত করে আপনাদের
নিতে আসব, রেডি থাকবেন।
যে লোকটি গোবিন্দের সাথে আসল
সে কি উপকারে আসবে তা বুঝল
না জামশেদ।
বনের
মাঝে ঘোরাঘুরি করায় সন্যাসীর
কি দরকার!
সন্যাসীর গায়ের পোশাকে র
রং শুরুতে সাদা ছিল না হলুদ
তা বলা অসম্ভব। গলায় রুদ্রাক্ষের
মালা, আবক্ষ দাড়ি। হাতে একটা অদ্ভুত
প্রায় ছয় ফুট লম্বা লাঠি। অদ্ভুত,
কারণ লাঠির মাথায় কোন প্রাণীর
মেরুদণ্ড আর এক মানব শিশুর
মাথা জড়ানো। লাঠিটা যেন ভয়াবহ
সুন্দর।
হঠাৎ জামশেদ এর মনে হল তার
এমন একটা লাঠি থাকলে মন্দ হোত না!
শুরু হল যাত্রা। রাত প্রায়
আটটা পর্যন্ত চলল গাড়ি। এর পর তাঁবু
খাটানো হল। জ্বালান হল
ক্যাম্পফায়ার। এত ভেতরে ঢোকা আইন
সিদ্ধ নয়, কারণ হিংস্র জানোয়ারদের
ভয় আছে গোবিন্দ অফিসারদের
সামলে নিয়েছে, কিন্তু ঘুষ
দিয়ে তো আর জানোয়ারদের সামলান
যায় না।
তাই রাত এ যাত্রা বন্ধ।
এভাবে টানা দুই দিন চলার পর
দেখা গেল গুলিয়ামবাড়ের মন্দির।
হ্যাঁ, ভুল বলে নি রাশেদ, পরিত্যক্ত
মন্দির এটা। যখন মন্দিরের
সামনে পোউছল ওরা তখন সূর্য
ঢলে গেছে। প্রতিটি ঘন্টার জন্য অর্থ
ব্যয় হচ্ছে, জামশেদ এখনই
মন্দিরে ঢুকতে আগ্রহী।
কোন এক অজ্ঞাত
কারণে গোবিন্দ ও বেশীক্ষণ
থাকতে চাচ্ছে না।
মিলি আর জামশেদ দুজন প্রবেশ করল
মন্দিরে, পেছনে এল গোবিন্দ। শুধু
সন্ন্যাসী বাইরে দাঁড়িয়ে জ্বল জ্বল
করে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে।
ভেতরে ঢুকেই মিলি দেখতে পেল তার
আকাংক্ষিত মুর্তি।
মুর্তি টা বেশ কয়েক জায়গায়
ভেংগে গেছে।
তবে যা টিকে আছে তা যথেষ্ঠ।
মুর্তিটির মাথা অনেকটা মানুষ এর
করোটির মত। শুধু মাড়িযুক্ত মুখ
থেকে বেড়িয়ে আছে আধহাত জিহ্বা।
পুরুষাঙ্গ দ্রিষ্টি কটুভাবে উত্থিত।
সম্পূর্ণ নগ্ন দেব মুর্তিটি।
কাধে একটা পেঁচা।
হ্যাঁ, এই মুর্তিই খুঁজছে মিলি। হাজার
বছর আগে সম্পুর্ণ ভিন্ন এক সভ্যতা,
অ্যাজটেক দের
মাঝে মিক্টেলান্তেকুটলি নামে এক
দেবতার পুজা প্রচলন ছিল। অবশ্য
অপদেবতা বলাই ভাল, কারণ অন্ধকারের
দেবতা ছিল সে। প্রতি বছর হাজার
হাজার নারী পুরুষ বলি চড়ান হোত সেই
দেবতার নামে।
অ্যাজটেক সেই
দেবতার মুর্তির সাথে ভারতীয় এই
দেবতার অবিশ্বাস্য মিল। কি করে,
কিভাবে এ সম্ভব তা দিয়ে মিলির
প্রয়োজন নেই, মিলি জানে এ আবিষ্কার
তাকে বিখ্যাত করে দেবে। কিন্তু
ধনী করবে কে? হ্যাঁ, ধনী হবার
ব্যবস্থা ও আছে। বেদিটার
পেছনে চলে গেল মিলি ভাঙ্গা এক
গাদা আবর্জনা দেখতে পেল সে।
পাগলের মত সরাল সে আবর্জনা।
সেখান
থেকে বেড়িয়ে এল রাশেদের
লুকিয়ে রেখে যাওয়া নিখুঁত মুর্তিটি।
পাথর কুঁদে নির্মিত মুর্তি, আর চোখের
জায়গায় দুটি রক্ত লাল পাথর, লালের
মাঝে ছোট ছোট নীল ফুটি।
দেখলে অস্বস্তি হয়, মনে হয়
তাকিয়ে আছে। "দশ লাখ, আমার দশ লাখ
চাই " পেছন থেকে হঠাৎ বলল
গোবিন্দ।
- পাবে
- মুর্তি লুকিয়ে ফেলুন, আমার
সাথি দেখলে অসুবিধা আছে।
তাকে টাকা দিয়ে কিনতে পারবেন না।
বেড়িয়ে এল ওরা তিন জন।
সন্ন্যাসী অস্থির
ভাবে তাড়া দিতে লাগল
তারাতারি গাড়ি ছাড়ার জন্য।
গোবিন্দ গাড়ি ছাড়ল। কিন্তু
গাড়িতে মিলি পা রাখতেই বন্ধ
হয়ে গেল ইঞ্জিন।
শিউরে উঠল
সন্ন্যাসী।
-গুলিয়াম বাড় আজো জাগ্রত! রক্ষা নাই!
আজ কারও রক্ষা নাই!
মানে? বিরক্তি নিয়ে জানতে চাইল
জামশেদ।
- মেয়ে মানুষ! কোন মেয়েমানুষ এই
মন্দির থেকে ফেরে না!
-রাবিশ!!
কিন্তু গাড়ি আর স্টার্ট হল না। বনেট
খোলার আগেই সুর্য অস্ত গেল,
ধীরে ধীরে নেমে এল অন্ধকার।
অগত্যা মন্দিরের সামনে ক্যাম্প
করা হল।
কেন যেন কেউ রাতের
অন্ধকারে মন্দির ঢোকার সাহস পেল
না।
রাত গভীর হল। মাত্রই
ঝিমুনি এসেছে জামশেদ এর, হঠাৎ
তন্দ্রা ছুটে গেল তার। আজব এক শব্দ
শুনেছে সে। অনেক টা বেবুনের মত।
কিন্তু এই জংগলে বেবুন!
ক্যাম্প ফায়ার থেকে এক টুকরো জ্বলন্ত
লাকড়ি তুলে উঠে দাড়াল সে।
উঠে বসেছে সন্ন্যাসী ও। লাকড়ির
আলো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। দেখা গেল
এক অদ্ভুত প্রাণী কে। সঙ্খায়
তারা প্রায় এক ডজন।
গায়ের
চামড়া কালো, হালকা রোমশ, অনেক
টা রাবারের মত। আক্রিতিতে প্রায়
পাঁচ ফুট, দেহে দড়ি পাকানো পেশী।
দুই পায়ে সোজা দাড়িয়ে আছে। সবার
হাতে প্রস্তরযুগের প্রাগৈতিহাসিক
অস্ত্র, পাথরের কুড়াল, ছুরি, বর্শা।
সবচেয়ে ভয়াবহ হল মুখ।
মুখের
আক্রিতি মানুষের মত, লোমহীন, কিন্তু
কোন চোখ নেই। চোখের কোটর ও নেই।
শুধু নিখাঁজ চামড়া। রণ
হুঙ্কারে ঝাপিয়ে পড়ল জন্তুগুলো ওদের
উপর।
মুহুর্তে দাড়িয়ে পড়ল সন্ন্যাসী।
লাঠিটা উচু করে ধরে গর্জে উঠলেন "
হাবাতে! "
অদ্রিশ্য শক্তি বেড়িয়ে গেল তার হাত
থেকে। কোন দেয়ালের সাথে হঠাৎ
ধাক্কা খাওয়ার মত পেছনে ছিটকে গেল
প্রাণী গুলো। কিন্তু উঠে এল তারা,
বেশ দ্রুত ই। ততক্ষণে ছোট্ট এক
টুকরো ডাল দিয়ে নিজের
চারপাশে ব্রিত্ত
একে ফেলেছে সন্ন্যাসী।
প্রাণীগুলো ব্রিত্তের বাইরে থেকেই
নানা অঙ্গভঙ্গি করল, কিন্তু
ভেতরে আসতে পারল না।
জামশেদ আর
গোবিন্দ কোন সুযোগ পেল না,
প্রাণীগুলো আক্ষরিক অর্থেই তাদের
ছিঁড়ে ফেলল। কিন্তু অক্ষত অবস্থায়
তুলে নিয়ে গেল মিলি কে।
পরিশিষ্টঃ অনেক অনুসন্ধান এর পর শুধু
পুরুষ পর্যটকদের ছেড়া কাপড়
পেয়ে পুলিশ ঘোষণা দিল
উলফা সন্ত্রাসীরা পুরুষ দের
হত্যা করে গুম করেছে,
মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেছে।
কেস ক্লোজড।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।