আগের পর্ব -
Click This Link
চা বাগানের বুক চিরে
শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনে নেমে ফুলছড়া চাবাগানের ভেতরের এক চা স্টল পর্যন্ত রিকশায় গেলাম। রাস্তাটি তখনো পাকা ছিলো। রেল লাইন পার হয়ে, যতদূর মনে আছে, ইস্পাহানী জেরিন চা বাগান আর ফিনলের একটা বাগানের মাঝখান দিয়ে সে রাস্তা শুরু। সমতল আর ছোট টিলার সারা শরীর, যতদূর চোখ যায়, শুধু চা আর চা গাছের সবুজে ছাওয়া। যেদিন প্রথম যাই তার দু'একদিন আগে বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছিলো।
পরিচ্ছন্ন পাতার সবুজের দ্যুতি চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিলো। বিকেল চারটার দিকে রওয়ানা হলাম। জ্যৈষ্ঠের বিকেলের সোনালী-কমলা রোদ। জীবনে প্রথম চা বাগান দেখছি বলে মজাই আলাদা।
(এরকম আরেকটা মজা পেয়েছি ২০০৩ সালে হবিগঞ্জের নোয়াপাড়া চা বাগানে ঢুকে।
আমি কর্মসূত্রে সেখানে ( মাধবপুর, হবিগঞ্জ) এসেছি। পরিবারের সবার সাথে গৃহকর্মী মহিলাটিও ছিলো। চা বাগান ঢোকার পর ও বললো চা বাগান কোথায়। বলা হলো, এটাই চা বাগান। অবাক হয়ে জানতে চাইলো, চা কই ? সব তো গাছের পাতা ! ওর ধারণা ছিলো ধানের ছড়ার মতো কালো কালো চায়ের দানা গাছে ধরে ! )
দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ফুলছড়া চা স্টলের কাছে।
নামার পর দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চিতে বসলাম। বেঞ্চি মানে মাটিতে পুঁতে রাখা গাছের গুঁড়ির সাথে কাঠের তক্তা পেরেক মেরে আটকানো। আরো দু'এক জন ছিলো। সবাই বসে আছে। কারো যেন কোথাও যাবার তাড়া নেই।
বেশ কিছু সময় পর আরো দুটি রিকশা এলো। নামলেন ছ'সাত জন। হেঁটে এসে যোগ দিলেন কয়েক জন। এরপর তাদের কেউ কেউ চা খেলেন, কেউ বিড়ি। তারপর সবার সাথে দল বেঁধে রওয়ানা হলাম চা বাগানের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠো পথে।
একটু পর পর পাহাড়ী ছড়া পড়ছে। অল্প পানি, কিন্তু অবিশ্বাস্য রকমের স্বচ্ছ। একটা সুঁচ পড়লেও তুলে অঅনা যাবে। পানিতে পা দিয়েই চমকে উঠলাম- ঠাণ্ডা !!!!!!!!!!!!!!
সবাই নানা রকম গল্প করতে করতে চলছেন। কয়েকজন বাঁকে বয়ে ( ওখানে বলে ভার।
বাঁশের বাঁকের দু'প্রান্তে সিকার মতো দড়ির তৈরী খোলের ভেতর দুটি বাঁশের চাঙাড়ীর মতো জিনিস। তার ভেতর বয়ে নেয়া হয় নানা জিনিস। কেউ বয়ে নেন আনারস- ২৫টি করে দুই চাঙাড়ীতে ৫০টি। কেউ বয়ে নেন লেবু-৫০০ করে ১০০০টি। কেউ বয়ে নেন কলার ছড়া (সেটা অবশ্য ভারের দুই প্রান্তে দড়িতে ঝুলিয়ে), কেউ কাঁঠাল।
বয়ে নেবার জন্য যে টাকা পান তা দিয়েই ঘরের জন্য দরকারী জিনিসপত্র কিনে এনেছেন শ্রীমঙ্গল হাট থেকে। সপ্তাহে দুটি হাট বসে। সে দুদিনই এইভাবে সবাই হাটে জান। কার আনারস কত বিক্রি হলো, লেবু বা কাঁঠাল বা কলা কতো বেচা হলো তার বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে চললাম। কেউ কেউ ছিলেন, বন থেকে কেটে আনা কাঠের খড়ি বিক্রি করে এসেছেন।
চলতে চলতে ছোট মামাকে বললাম, আমরা দোকানে এসে বসে থাকলাম কেন ? ( ছোটমামা আমাদেরকে স্টেশনে রিসিভ করেছেন) মামা বললেন, এই পথে বাগান থেকে বাঘসহ নানা হিংস্র প্রাণীর উপদ্রব আছে। সে জন্য সবাই একত্র হয়ে দল বেঁধে চলি। তখন বললাম, বাঘের সামনে পড়ে গেলে সবাই কি করে ? তখন মামা এক কাহিনী বললেন-
''এক বার মামাসহ এক দল এই পথে যাচ্ছিলেন। মোড় ঢ়ুরতেই দেখেন একটা বড়ো বাঘ বসে আছে। সেই বাঘকে এখানে বলা হয় খান্দরা বাঘ।
তখন আমরা হাতে থাকা খালি টিন, ডালি এই সব শব্দ করে বাজাতে শুরু করলাম আর জোরে চিৎকার করতে লাগলাম। তখন বাঘটি কিছুক্ষণ আমাদের দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে উঠে চলে গেলো। ''
গল্প শুনে তো ভয় পেয়ে গেলাম। যদি বাঘের সামনে পড়ে যাই ! ভাগ্যিস ভালোয় ভালোয় পৌঁছে গেলাম।
একটা ছড়ার পারে মামাবাড়ী।
সামনে চওড়া রাস্তা। বালি আর মাটির তৈরী। সেই পথে ট্রাক আর ট্রাক্টর চলে। একটু দূরে একটা চা বাগান- নাম খুব সম্ভব এম আর খান। গ্রামটির নাম মোহাজেরাবাদ আর ইউনিয়নের নাম আশিদোন।
গ্রামের সবাই পাহাড়ে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। খাবারতো যোগাড় হয়। কিন্তু মূল সমস্যা ছিলো লেখাপড়ার আর স্বাস্থ্য সুবিধা বঞ্চিত। বাগানের টিলাবাবু নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের একটা দোকান ছিলো বাগানের এক প্রান্তে। সেটাই সে গ্রামের একমাত্র ''সুপার স্টোর''।
এখানে কিছু না পেলে যেতে হতো শ্রীমঙ্গল। নানা যে এই গহীন পাহাড়ে কেন ঢুকলেন !
তবে বাড়ীটি ছিলো খুব সুন্দর করে সাজানো। সামনের ঘরটি মাটির দেয়াল আর টিনের চাল। ভেতরে আরো দুটি ঘর টিনের। ভিটি কাঁচা।
মাঝে বিশাল উঠান। বাড়ীতে ঢোকার পথটি খুব সুন্দর পাতাবাহারের গাছ সার করে লাগানো। খুব সুন্দর করে কেটে সাইজ করা। একপাশে ছোট একটা পুকুর অন্যপাশে ধানক্ষেত। সামনের মাটির ঘরের উঠানটিও পাতাবাহারের দেয়াল ঘেরা।
ভাগ ভাগ করে নানা রকমের ফুলের বাগান। বাগানবিলাস আর অপরাজিতার লতা উঠে আছে সে ঘরের চালে। বাড়ীর পেছনে বিশাল এক পাহাড়। আনারস, কাঁঠাল, কলা আর লেবুর বাগান তাতে। বাড়ীর পেছন দিকে ইন্দারা।
সেটাই ছিলো পাণীয় জলের উৎস। এক কথায় ছবির মতো। অনেক পাহাড়ী বাড়ীর ছবি যেমন আমরা দেখি ইন্টারনেটে আর পোস্টারে সেই রকম অনেকটা।
পরে অবশ্য সে গ্রামে পরে অনেক মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। তার কথা বলবো পরের পর্বে।
(চলবে) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।