আগের পর্ব-
Click This Link
চড়ুইভাতি
আমরা ভাইবোন বাহিনী ঠিক করলাম চড়ুইভাতি করবো। বাড়ীতেই। তখন ধান কাটার মৌসুম চলছে। সবাই এককাপ ধান জমা দিলাম। জমি থেকে কিছু যোগটড় করে ধান সিদ্ধ করলাম।
শুকিয়ে ঢেঁকিতে চাল করলো বোনেরা। আমরা পুকুরে নামলাম মাছ ধরার জন্য। কিছু মাছ ধরলাম। প্রতি ঘর থেকে একটা করে ডিম এলো। দাদী দিলেন মুরগী।
মসলা দিলেন আম্মা। জমানো টাকা থেকে সরিষার তেল কিনা হলো।
সব যোগাড় করে রান্না শেষ করে খেতে খেতে প্রায় বিকাল হয়ে গেলো। ঝাল লবন আর মসলার গোলমালে রান্না যা হয়েছে তার বিবরণ নাই দিলাম। শুধু হাড়ে হাড়ে টের পেলাম ক্ষুধা লাগলে বাঘেও কেন ঘাস খায়।
সেই স্বাদ, গন্ধ কোথায় গেলো ?
আমাদের বাড়ীর দরজা বেশ লম্বা। রাস্তা থেকে ঘরগুলোর দূরত্ব ৫শ' গজের মতো হবে। বাড়ীতে যেদিন গোশত বা ইলিশ মাছ রান্না হতো কিংবা ডিম ভাজা হতো রাস্তা থেকে তার ঘ্রাণ পাওয়া যেতো। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় লোকজন সে ঘ্রাণ পেয়ে বলতো এ বাড়ীতে গোশত বা ইলিশ রান্না হচ্ছে, চল দাওয়াত খেতে যাই। আমরা সেটা শুনে খুব মজা পেতাম।
এখন নাকের কাছে না নিলে এই সব তরকারীর ঘ্রাণই মিলে না। কোথায় হারিয়ে গেলো সেই ঘ্রাণ ? সেই স্বাদও আর পাইনা। স্বাদ যে কোথায় হারালো ? দেশী জাতের মাছ, মুরগী,ডিম সবই গায়েব হবার পথে।
ছোট বেলায় মামাবাড়ী গেলে বিন্নি চালের ভাত খেতে পছন্দ করতাম খুব। ২০০৩ সালে আবার যখন ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া এলাকায় গেলাম।
বিন্নি চালের সন্ধানে লোক লাগালাম। বিন্নি ভাও রান্না করা হলো বিন্নি চালের ভাত রান্নার স্পেশাল তরিকাও অনুসরণ করা হলো। মুখে দিয়ে বিন্নির মতো লাগলো বটে। কিন্তু সেই ঘ্রাণ আর পেলাম না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুঝলাম যে দিন গেছে সেটা আসলেই চলে গেছে।
গ্রামের মেলা, হাল খাতা
আমাদের গ্রামে চৈত্র সংক্রান্তি আর পহেলা বৈশাখ মেলা বসতো। মাঠের মধ্যে বটগাছের তলে। আমরা সাজুগুজু করে মেলায় যেতাম। মেলার ভিড় অনেক দূর থেকে দেখা যেতো। কানে আসতো হৈহুল্লোড়।
কাছাকাছি গেলে দেখতাম মাঠের বুক চিরে নানা দিক থেকে লোকজন আসছে। সাথে ছোট ছেলেমেয়ে। মেলায় আমাদের মূল আকর্ষণ ছিলো বাতাসা, মুড়কি, নাড়ু, হাওয়াই মিঠাই। বাঁশি বেলুন আর কাঠের তৈরী খেলনা। মাটির পুতুল।
বড়োদের আকর্ষণ ছিলো বাঁশ বেত কাঠের তৈরী নানা জিনিস। জাল পাওয়া যেতো। পাওয়া যেতো পাটি, গৃহস্থালীর নানা জিনিস। মেয়েদের চুড়ি, লেইস,ফিতা,আলতা ইত্যাদি।
আনন্দের সাথে মূল বিষয় ছিলো বাণিজ্যিক।
দরকারী বেচা কেনা সেখানে সবাই সারতেন।
পহেলা বৈশাখে সব দোকানে হতো হালখাতা। বাকীর খাতার কিছু টাকা হাতে করে বড়োরা যেতেন। সাথে যেতো ছোট ছেলে মেয়েরা। দোকান সাজানো হতো রঙিন কাগজে।
পর্দা দিয়ে ঘিরে ভেতরে বসার ব্যবস্থা। নানা রকমের মিষ্টি পরিবেশন করা হতো। সেই মিষ্টির স্বাদ এখনো যেন মুখে লেগে আছে। কারণ গ্রামে ভেজাল তখনো এতো সর্বব্যাপী
হয়ে ওঠেনি। শহরে ভেজাল যে ছিলো তার প্রমান পাই সৈয়দ মুজতবা আলীর পঞ্চতন্ত্রে।
''কায়রো'' শিরোণামের লেখায় বলছেন- বসন্ত রেস্টুরেন্টে ভেজাল তেলে ভাজা পচা ডিমের যে উমদা অমলেট মিলে সে ফিরিস্তি দিতেও ভুললুম না।
তাঁর ''শবনম'' উপন্যাসের নায়িকার কপালের রঙের বর্ণনা দিতে গিয়ে মুজতবা আলী লিখেছেন- কপালটি পাগমানের বরফের মতো। সেতো আপনি দেখেননি। বলা যায় নির্জলা দুধের মতো। সে-ও আপনি দেখেননি।
বলা যায় বনমল্লিকার পাঁপড়ির মতো। কেননা ওতে এখনো ভেজাল হয়নি। (দুধে পানি মেশাবার ঐতিহ্য দেখুন)।
বলছিলাম হালখাতার মিস্টির কথা। যেসব দোকানে বাকী ছিলো সেখানে মিস্টি ছিলো অবধারিত।
যে দোকানে বাকী নেই। সেই দোকানদারও ছোটদের দেখলে ডেকে বসিয়ে মিস্টি খাওয়াতে কঞ্জুসী করতেন না। সেই উদারতাটুকুও তখনো টিকেছিলো।
এখন পহেলা বৈশাখে ঢাকায় যে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয় সেটা নিতান্তই ঢাকাই এবং অতিসাম্প্রতিক। এরশাদ জামানায় আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন থেকে শুরু।
পান্তা-ইলিশের প্রচলনও মূলত তখন থেকে। আবহমান বৈশাখ যাপনের সাথে এর কোন মিল নেই।
তবে ছায়ানটের বটমূলের অনুষ্ঠান শুরু ১৯৬৭ সাল থেকে। ছায়ানটের এই অনুষ্ঠানটি নানা প্রতিকূলতার পরও টিকেছিলো। বোমা হামলাও এর পথ আটকাতে পারেনি।
তবে এবার একটা ভয়ের বিষয় দেখলাম, জানি না ছায়ানট এই ঝাপটা কিভাবে সামলাবে। রমনার অন্যপ্রান্তে মোবাইল কোম্পানী পাশ্চাত্য ধরণের কনসার্ট আয়োজন করে দর্শকশ্রোতার মূল স্রোত ওখানে টেনে নিয়েছিলো। ছায়ানটের অনুষ্ঠানে এবার লোক সমাগম কম হয়েছে।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।