আগের পর্ব-
Click This Link
বাস ! বাস !! বাস !!!
একদিন গাড়ীর শব্দ শুনে চমকে গেলাম। অন্য গাড়ীর মতো শব্দ না। বেশ বাজখাঁই টাইপের। রীতিমতো গর্জন। যথারীতি ছুটে এলাম।
তারপর দেখলাম পেছনে ধূলির ঝড় নিয়ে তিনি এগিয়ে এলেন। পিঠ ও পেটভর্তি মানুষ নিয়ে বিশাল বাস। সদরঘাট থেকে রামপুরা রুটে এককালে চলা মুড়িরটিন বলে পরিচিত বাসগুলোর মতো। অবশ্যই এর বহু আগের এডিশন।
আমার ভাইবোন বাহিনীর অনেকেই দেখলাম এটার নাম জানে না।
আমি যেহেতু ঢাকা চাটগাঁ ঘুরেছি সেহেতু আমি এর নাম জানি। খুব ভাব নিয়ে ওদের জানালাম, এর নাম বাস। (বড় হয়ে জেনেছি এর নাম আসলে অমনিবাস। বাংলাদেশে সেটা শুধু বাস হলো কিভাবে এর কারণ জানতে পারিনি আজো)
বেশ গদাই লশকরী চাল। অসমান কাঁচা রাস্তায় হেলে দুলে চলেন।
ইন্জিনের শব্দের সাথে নানাপ্রকার ক্যাঁচকোঁচ শব্দও আছে। আমাদের অবাক করে আমাদের বাড়ীর সামনে এসে থেমে গেলো বাসটি। হেলপার হাঁক দিলেন, গেট খালি করেন। সেই হাঁকে কয়েকজন নেমে রাস্তায় দাঁড়ালেন। তারপর ব্যাগ বোঁচকা নিয়ে হাঁসফাস করতে করতে নেমে এলেন আমার ছোট চাচা।
নেমে আসা অন্যযাত্রীরা আবার উঠলেন। হেলপার বাসের পেটে বিশাল এক চাপড় দিলেন। বাস আবার চলতে শুরু করলো। পুরো ব্যাপারটাতে একটা আয়েসী ভাব ছিলো। সবকিছু হলো খুব ধীরে সুস্থে।
কারো কোন তাড়া নেই। সবাই এই বিলম্ব উপভোগ করছে যেন। বাস এতো ধীরে চলছে কেন, ছাড়তে দেরী হচ্ছে কেন এই সবের বালাই নেই।
চাচার কাছে শুনলাম সেদিন থেকেই বাস চালু হয়েছে। এখন থেকে প্রতিদিন সকালে এই বাসে চৌমুহনী (বেগমগঞ্জ উপজেলা সদরের বাজার) যাওয়া যাবে।
বিকালে ফেরা যাবে। শুনে আমাদের খুশী কে দেখে ? প্রতিদিন দুইবার বাস দেখা যাবে।
বাসটি ছিলো পেস্ট কালারের। এখনকার ট্রাকের মতো সামনের দিকটা বাড়ানো। তারপর ড্রাইভারের সিটা।
এর পেছনে আলাদা একটা কেবিন। ড্রাইভারের পাশের সিট আর কেবিন ছিলো স্পেশাল পেসেন্জারদের জন্য। ভাড়াও বেশী। আর পেছনের বড়ো অংশটা ছিলো আমজনতার জন্য। তাদের আরেক জায়গা ছিলো ছাদ।
মালপত্রের সাথে আদমআলীরা। ড্রাইভারের সিট আর কেবিনে বসার সিট কাঠের তৈরী। আলাদা একটা গদির মতো ছিলো। বাড়তি ভাড়া দিলে সেটা সিটের ওপর পেতে দেয়া হতো। আর আমজনতার ওখানে জানালার পাশে টানা কাঠের সিট।
মাঝখানে স্কুলের সিট বেঞ্চের মতো বেঞ্চ। একটু চওড়া। পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে দুই সারিতে বসতে হতো। কেবিন থেকে পিছনটা দেখা যেতো। এতজন বসার পরেও মাঝের সামান্য জায়গায় লোক দাঁড়িয়ে ভ্রমন করতো।
গেটে ঝোলাঝুলিতো ছিলোই। এছাড়া সামনের সিটের সাথের পাদানীতে দাঁড়িয়েও লোকজন ভ্রমন করতো।
বাসের হর্নও ছিলো বিশেষ দ্রষ্টব্য। সামনের দিকটা সানাইয়ের মতো। পিতলের।
তার পেছনে গোলাপী রঙের ফুটবলের ব্লাডারের মতো গোল রাবারের বল টাইপের জিনিস। দড়ি দিয়ে ড্রাইভারের মাথার কাছে ঝোলানো। হর্ন দেবার দরকার হলে ড্রাইভার রবারের বলে চাপ দিতেন। ভঁৎ ভঁৎ করে বিকটস্বরে বেজে উঠতো সানাই-হর্ন। কান ঝালাপালা অবস্থা।
সেই বাস স্টার্ট দেওয়ার কায়দাও দারুন। আমাদের বাড়ীর সামনে বেশ কয়েকবার স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই স্টার্টযজ্ঞও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বাসের সামনের মাডগার্ডের সামনে থেকে লোহার এক ডান্ডা বের করা হলো। তারপর সেটা সামনে থেকে ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে স্টার্ট দেয়া হয়। তার আগে দেখি হেলপার দৌড়ে গিয়ে রাস্তার পাশের খাল থেকে বালতি ভরে পানি এনে সামনের বনেট খুলে ঢালছে।
বড়ো হয়ে জেনেছি পেট্রোল ইঞ্জিনের রেডিয়েটরে পানি ঢালার তত্ত্ব।
মাঝে মাঝে দেখা যেতো ডান্ডা ঘুরিয়ে বাস স্টার্ট নিচ্ছে না। তখন পেছন থেকে মারো ঠেলা হেঁইও। শুধু বাসের লোকের ঠেলায় কাজ হতো না। জোয়ান প্যাসেঞ্জারদেরও ঠেলার সময় হাত লাগাতে হতো।
ঠেলা খেয়ে স্টার্ট নেবার পর ঠেলাদাতা প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে ছোটাছুটি শুরু হতো আবার বাসে ওঠার জন্য। এ প্রসঙ্গে এরশাদ আমলে বিমান নিয়ে একটা কার্টুনের কথা মনে পড়লো। ককপিঠ থেকে বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন বলছেন, প্যাসেঞ্জারস আর রিকোয়েস্টেড টু পুশ দা এয়ারক্রাফ্ট ফ্রম ব্যাক টু স্টার্ট ইট।
শুধু বাস দেখে তো মন ভরে না। শখ হলো বাস ভ্রমনের।
বেশ ক'বার সেই বিখ্যাত বাসে ভ্রমন করেছি। একবার মরতেও বসেছিলাম। সে গল্প আরেক দিনের জন্য তোলা রইলো।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।