আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মামাবাড়ী, ইশকুল...৫



আগের পর্ব- Click This Link রেডিও থেকে ট্রানজিস্টর বড়ো জ্যেঠা বেতারে চাকরী করতেন বলে আমাদের বাড়ীতে বহু আগে থেকেই রেডিওর আনাগোনা ছিলো। সেই কালের রেডিও মানে বিশেষ দ্রষ্টব্য জিনিস। ট্রাঙ্কের মতো বিশাল সাইজ। বিশাল বিশাল সু্ইচ বাটন (সাইজের কারণে হ্যাণ্ডেল বলাই বিধেয়), বাজখাঁই আওয়াজ। সাথে ঘড়ঘড় আওয়াজ।

স্টেশনের দুর্বলতার জন্য পরিষ্কার রিসিপশন হতো না। সেই রেডিও দেখার জন্য গ্রাম ভেঙে মানুষ আসতো বাড়ীতে। এটা আবার দাদা পছন্দ করতেন না। বলতেন ইবলিশের বাকসো। দাদীও যে খুব পছন্দ করতেন তা-ও না।

খবর টবর হলে কান পাততেন। গানের আওয়াজ গেলেই-নাউজুবিল্লাহ ! ষাটের দশকে ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের ফলে রেডিওর সাইজ নাটকীয়ভাবে কমে বর্তমান সাইজে চলে আসে। আব্বা প্রথমে কিনলেন একটা এক ব্যাণ্ড রেডিও। ভালোই শোনা যেতো। তবে শিলং শোনা যায় না বলে অসন্তোষ ছিলো বাড়ীতে।

পরে কিনলেন ফিলিপসের তিন ব্যাণ্ড রেডিও। সেই কালের হর্টিথ্রব হিরো। সামনের দিকটা সাদা স্টিলের। খুব স্মার্ট রেডিও। আব্বার কাছ থেকে খুব দ্রুত সেটা চালানো শিখে নিলাম।

ফলে আমি হয়ে উঠলাম অপ্রতিদন্দ্বী রেডিও অপারেটর। খবরের ব্যাপারে আমাদের বাড়ীর লোক জনের আগ্রহ ছিলো। বিবিসি, রেডিও পাকিস্তান, আকাশবাণীর খবর শোনা হতো। গ্রাম ভেঙে লোক আসতো অনুরোধের আসরের রাতে। তারা ঠিকই মনে রাখতেন সময়।

যথাসময়ে এসে হাজির হতেন। সপ্তাহে খুব সম্ভব দুই রাতে সেটা হতো। সত্যিকারের ভালো ও জনপ্রিয় গানগুলোই তখন বাজানো হতো অনুরোধের আসরে। লায়লা আর্জুমান্দ বানু, নীনা হামিদ, ফেরদৌসী বেগম (পরে রহমান), ফিরোজা বেগম,আঞ্জুমান আরা বেগম, নিঘাত সীমা, শাহনাজ বেগম ( পরে রহমতুল্লাহ), ফৌজিয়া খান, নীলুফার ইয়াসমীন, সাবিনা ইয়াসমিন, জিনাত রেহানা, নাহিদ নিয়াজী প্রমুখ গায়িকা ছিলেন সুপারহিট। গায়কদের মধ্যে আব্বাস উদ্দিন আহমদ, আবদুল আলীম, বেদারউদ্দিন আহমদ, আনোয়ার উদ্দিন খান, বসীর আহমদ, কাজী আনোয়ার হোসেন, খান আতা, খন্দকার ফারুক আহমেদ, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, আবদুল জাব্বার, হরলাল রায় প্রমুখ ছিলেন জনপ্রিয়।

তখনকার সিনেমার গান শোনার জন্যই বেশী আগ্রহী ছিলেন সবাই। আর জনপ্রিয় ছিলো নাটক। বেদের মেয়ে, কাজল রেখা, রূপবান,সয়ফুর মুলক বদিউজ্জামান ইত্যাদি লোককাহিনী নির্ভর নাটক ছিলো বেশী জনপ্রিয়। উঠানের মাঝখানে চেয়ারের ওপর রাখা হতো ট্রানজিস্টর, পাশে হারিকেন। তার চারপাশ ঘিরে উঠান ভরা লোক।

আমি তার মাঝে খুব ভাব নিয়ে রেডিও চালাতাম। সবাই মুগ্ধ চোখে আমার স্পেশাল দক্ষতা দেখতো। আকাশবাণী শিলংয়ের গানও খুব জনপ্রিয় ছিলো। শামসাদ বেগম, লতা মুঙ্গেশকার, আশা ভোঁসলে, মোহাম্মদ রফি, মুকেশ, কুন্দন লাল সায়গল, মান্না দে, হেমন্ত কুমার ( হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) খুব লোকপ্রিয় ছিলেন। শিলং রেডিওর বৈশিষ্ট্য ছিলো তারা সায়গলের গান দিয়ে শেষ করতো।

রেডিও পাকিস্তানের গায়কদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন নূর জাহান, মেহেদী হাসান, নাজাকত আলী খান, সালামত আলী খান,আহমদ রুশদী, দীনা লায়লা, রুনা লায়লা (১৯৭৪ সালে রুনা বাংলাদেশে চলে আসেন) প্রমুখ। কলের গান আমার চাচা আর ডাঙ্গর ভাই বাহিনীর বদৌলতে মাঝে মাঝে মজার কাণ্ড হতো। একবার তারা নিয়ে এলেন কলের গান। বাকসের মতো মঞ্চ, তারওপর সানাইয়ের মতো সাউন্ড সিস্টেম। হিজমাস্টার ভয়েসের লোগোতে তার ছবি আছে।

সাথে একগাদা রেকর্ড। এখনকার সিডির মতো। সাইজে কয়েকগুন বড়ো আর কালো। বেশীর ভাগ হিজ মাস্টার্স ভয়েসের। অন্য কোম্পানীরও ছিলো।

নাম মনে নেই। হেন্ডেল ঘুরিয়ে দিয়ে পিনের মাথা ডিস্কের ওপর বসিয়ে দেয়া হতো। শুরু হতো মুড়িভাজার মতো চড়চড় শব্দ। তারপর ভেসে আসতো গান। সেখানে প্রাধান্য ছিলো সায়গল, শামসাদ বেগম, রফি, মুকেশ, লতার গানের।

উর্দু গানও ছিলো। আর ছিলো আমাদের সিনেমার গান। কলের গান শোনার জন্য সারা গ্রাম থেকে পুরুষ মহিলা জড়ো হলেন। বেশ রাত পর্যন্ত চললো। পরে দাদার বকাবকির ঠেলায় অনুষ্ঠান শেষ হলো।

টেপ রেকর্ডার তখনকার টেপ রেকর্ডারও ছিলো বিশেষ দ্রষ্টব্য। প্রায় এক ইঞ্চি চওড়া ছিলো টেপ। বিশাল বিশাল চাকায় সেটা পেঁচানো ছিলো। এখনকার মতো খাড়াভাবে নয় শোয়ানো ছিলো চাকা গুলো। রেডিওতে, এফডিসিতে রেকর্ডিংয়ের জন্য এই সেদিন পর্যন্ত সেই টেপ ব্যবহৃত হয়েছে।

সেখানেও মুড়ি ভাজার চড়চড় শব্দ মিলতো। কারণ সেটা রেকর্ড হতো কলের গান থেকে। ১৯৬৩ সালে ফিলিপস কমপ্যাক্ট ক্যাসেট (যেটা আমরা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ব্যবহার করেছি। গ্রামে এখনো কিছু ব্যবহার আছে) বের করে। ধীরে ধীরে সেটা জনপ্রিয় হয়।

আমাদের কালে এসে কমপ্যাক্ট শব্দটি ঝরে গিয়ে শুধু ক্যাসেট নামে পরিচিত হয় সেটা। ডিস্ক থেকে কমপ্যাক্ট ডিস্ক (সিডি) সেদিনের ঘটনা। আমার ছেলেও তার ইতিহাস জানে। গেলো সপ্তাহে সিডির জনক গত হলেন। এই সামু ব্লগের ব্লগাররাও তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন।

(চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।