আগের পর্ব -
Click This Link
কঠিন মাইর
আম্মা আমাকে স্বরে অ স্বরে আ শেখান। আর আমি ভুলে যাই। বর্ণও উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। আম্মা কয়েক দফা চেষ্টা করলেন। এরপরও যখন হচ্ছিলো না।
তখন এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় পাখার ডাঁট দিয়ে দিলেন এক কঠিন মাইর ! বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা বেছে নেবার পেছনে একটা উদ্দেশ্য ছিলো (সে কাহিনী আম্মার কাছে পরে শুনেছি)। দাদাদাদী এমনিতে ডেকে আদর করা বা ভালোমন্দ বলা এসব করতেন না। কারণ তাঁদের ৯ ছেলে মেয়ের ঘরে রীতিমতো নাতিনাতনি বাহিনী ছিলো। বিশেষ কোন নাতিকে আলাদা গুরুত্ব দেবার দরকার তাঁদের ছিলো না। তবে নাতি নাতনিদের মারলে দাদাদাদী দু'জনেই ভীষণ রাগ করতেন।
সে জন্যই মাইরের জন্য বৃষ্টিমুখর রাত বেছেছিলেন আম্মা। আমরা দালানে থাকলেও দাদাদাদী ছিলেন টিনের ঘরে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দের জন্য দাদাদাদী আমার চিৎকার শুনতে পাবেন না।
ফলে মাইর দিলেন মনের সুখ মিটিয়ে। আমি বুঝলাম যতোই চিল্লাই সেটা দাদাদাদীর কানে পৌঁছাবে না।
মাইরের চোট শরীরের বিভিন্ন জায়গায় দাগ বসে গেছে। মাইর শেষ করে সারাগায়ে সরিষার তেল মেখে জামা পরিয়ে দিলেন। তারপর আশ্চর্য মোলায়েম গলায় পড়াতে লাগলেন। সেটাই ম্যাজিকের কাজ করলো। সেই রাতেই আমার পুরো বর্ণমালা মুখস্ত হয়ে গেলো।
তেতাল্লিশ বছর পরেও সেটা মনে আছে। একটানে পুরো বর্ণমালা বলে যেতে পারি।
লেখালেখি
বর্ণমালা শেখা হলো। এখন এলো লেখার পালা। চাইলাম খাতা পেন্সিল।
সেই কালে শুরুতে কাগজের সাথে কলমের রেওয়াজ ছিলো না। আমাদের বাড়ীতে যেহেতেু দাদার আমল থেকেই লেখা পড়ার চল ছিলো তাই খাতা কলম চিনতাম। কিন্তু খেতে হলো ধমক। আপনি কি প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্র ? খাতা পেন্সিল চাচ্ছেন ! আমার বড়ো জ্যেঠা ১৯৪০ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে সাইন্সে প্রথম বিভাগ পেয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়তে যান। সেখান থেকে ১৯৪২ সালে ইন্টামেডিয়েট পাশ করেন।
সে জন্য ওই কলেজের নাম আমাদের বাড়ীর কামলারও জানা ছিলো। কেউ বেশী কিছু চাইলে ওই খোটা কপালে জুটতো।
ফলে কপালে জুটলো স্লেট পেন্সিল। সেটা আমার হাতে আবার ভাঙতে লাগলো বেশী। ফলে লেখালেখির অনুশীলনের জন্য কপালে জুটলো কলাপাতা আর খেজুরের কাঁটা।
স্লেট পেন্সিল দেখে আমার ছোট কাকা আর আর তাঁদের এক চাচাতো ভাই আম্মার ওপর ক্ষেপে গেলেন। এতো বিলাসী হলে তো ছেলে মানুষ হবে না। আমরা কলাপাতায় লিখে বিএ পাশ করে ফেললাম ! এই সব কি হচ্ছে ?
ফলে বই পড়ে ইতিহাস শিখতে হলো না। মানুষ যে এক সময় গাছের পাতায় লিখতো তার জ্বলজ্যান্ত প্রমান তো আমি নিজেই।
বাল্য শিক্ষা
এরপর আম্মার মাস্টারীর পালা শেষ।
বাড়ীর কাচারীতে এসে নতুন মাস্টার উঠলেন। দূরের কেউ না। আব্বার জ্যেঠাতো ভাইয়ের ছেলে। আমাদেরও জ্যেঠাতো ভাই। নাম ফখরুল ইসলাম।
ম্যট্রিক পরীক্ষা দেবেন। (পরে শুনেছি একবার ফেল করে আবার দিচ্ছিলেন পরীক্ষা) শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের বিখ্যাত মাস্টার মেঝদা'র মতো না হলেও কাছাকাছি। কাচারী ঘরে বসে খুব চিৎকার করে পড়া মুখস্ত করতেন। এ রকম না পড়লে নাকি তার পড়া মুখস্ত হয় না ! ফলে তিনি পড়তে বসলে আশেপাশের দশগ্রামের লোক টের পেতেন তিনি পড়ছেন। মুরুব্বীরাও খুশী।
ছেলে পড়ছে। পড়ায় ফাঁকি দেয় না।
তিনি আমার আদর্শলিপি বই দেখে রেগে গেলেন। লেখাপড়া কি রঙের জিনিস ? লালরঙের হরফের কি দশা দেখুন ! এই সব ফালতু বইতে লেখা পড়া হয় ? আম্মাকে বললেন, চাচী টাকা দেন। বাল্য শিক্ষা কিনে আনি।
তিনি কিনে আনলেন রামসুন্দর বসাকের বাল্য শিক্ষা। মেটে রঙের প্রচ্ছদ। ভেতরে কুচকুচে কালো হরফে লেখা। আমার ওপর বইতে লাগলো বাল্য শিক্ষার শিক্ষাঝড়। ওতে আনন্দও কিছু ছিলো।
ছোটকালে নানাভাই আমাকে মুখে মুখে কিছু ছড়া শিখিয়েছিলেন। তার কয়েকটি বাল্য শিক্ষা বইতে ছিলো। নানাভাইয়ের মুখে শুনে শিখা ছড়া নিজে পড়ে পড়ে শিখছি। আনন্দ বলতে এটাই। সকাল উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে ইত্যাদি উপদেশপূর্ণ কবিতা।
এর বাইরে নানাভাই শিখিয়েছিলেন, হাট্টিমা টিমটিম, ওই দেখা যায় তাল গাছ, তাই তাই তাই মামাবাড়ী যাই, হে বালক মাঠে গিয়ে দেখে এসো তুমি কত কষ্টে চাষা লোক চষিতেছে ভূমি, উই আর ইঁদুরের দেখ ব্যবহার যাহা পায় তাহা কেটে করে ছারখার ইত্যাদি।
বাল্য শিক্ষা পড়তে গিয়ে আমাকে প্রচুর মার খেতে হয়েছে। সাধারন বেত, পাখার ডাঁট ইত্যাদি ছাড়াও আমার মাস্টার যদি কঠিন (!?) শাস্তি দিতে চাইতেন তাহলে তিনি মাদারের কাঁটাযুক্ত ডাল কেটে আনতেন। সেটা দিয়ে মারলে শরীরে কাঁটা ফুটে রক্ত বের হতো। পরে শরীর ধুয়ে সরিষার তেল মেখে দিতেন।
তার আরেকটা কঠিন শাস্তি ছিলো হাত বেঁধে শরীরে লাল পিঁপড়া ছেড়ে দেওয়া। এর পরও দিতেন সরিষা ট্রিটমেন্ট।
এখন ভাবলে খুব নিষ্ঠুর মনে হয় বটে। আমাদের কালে বিদ্যাশিক্ষা নিশ্চিত করতে কঠিন শাস্তিকে মহৌষধ জ্ঞান করা হতো। এই মহৌষধের একটা ফল হলো, স্কুলে ভর্তির আগেই বাংলায় যে কোন বিষয় পড়তে শিখে গেলাম।
আম্মার গৌরব প্রকাশের জন্য মেহমান আসলেই কঠিন কঠিন জিনিস গড়গড় করে পড়ে ভবিষ্যতে কৃতবিদ্য হবার উজ্জ্বল সম্ভাবনা সবার সামনে তুলে ধরতে লাগলাম।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।