আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মামাবাড়ী, ইশকুল...৩



আগের পর্ব- Click This Link চিৎকার করে পড়া আগেই বলেছি আমার শিক্ষক নিজের পড়া শুরু করলে দশ গ্রামের লোক টের পেতো যে, তিনি পড়ছেন। সেই দলে আমাকেও নাম লেখাতে হলো। চিৎকার করে পড়তে হবে। তাঁর কথা হলো, আমার গলা যেন আম্মা বাড়ী থেকে শুনতে পান। সে এক মহাজ্বালা।

আমার ছোট চিকন গলার স্বর আর কতোই ওঠে। যতো চিৎকারই করি, তিনি বলেন আরো জোরে। আমি মাদার কাঁটার মারের ভয়ে চিৎকার করে পড়ি। ছাত্র শিক্ষকের যৌথ চিৎকারের ফলে কাচারী ঘরে নরক গুলজার অবস্থা। দুই দিন পর গেলো গলা ভেঙে।

ক'দিন আবার চললো তার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা। চিন্তা ডাক্তারের (ডা.চিন্তাহরণ দে) অব্যর্থ মহৌষধ ! ওষুধে আখেরে কাজ হলো। চিৎকারের আদেশ রহিত হয়ে গেলো। তবে পড়তে হবে উচ্চারণ করে। তাও ভালো যে পড়তে বসে শ্লোগান দিতে হবে না।

মজিদ ভাই ! মজিদ ভাই !! ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের জোয়ার আমাদের গ্রামেও পৌঁছেছিলো। জেলা শহর থেকে ৪ মাইল দূরে আমাদের গ্রাম। মাঝে মাঝে লোকজন বাঁশের লাঠি হাতে মিছিল করতো। কিছু কিছু শ্লোগান মনে আছে-আমার ভাই তোমার ভাই মুজিব ভাই মুজিব ভাই, জেলের তালা ভাংবো শেখ মুজিবকে আনবো, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা ইত্যাদি। মিছিল এলে আমার চাচাতো জ্যেঠাতো ফুপাতো ভাই বোনদের বাহিনী দৌড়ে রাস্তার কাছে চলে যেতো।

আমি যেতাম না ভয়ে। ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে সে মিছিল দেখতাম। তখন অবশ্য ঝোঁপঝাড় ছিলো। এখন তো গাছ গাছালি গেছেই ঝোঁপঝাড়ও বিলুপ্তির পথে। মিছিল চলে গেলে বাঁশের কঞ্চি হাতে নিয়ে আমরা ভাইবোন বাহিনী মিছিল বের করতাম।

ওই শ্লোগানগুলো দিতাম। কিন্তু আমার ভেজাল লেগেছে মুজিব ভাই নিয়ে। আমার মেঝো মামার নাম আবদুল মজিদ। আমি মুজিব ভাইকে ধরে নিলাম মজিদ ভাই। শ্লোগানও দিতাম মজিদ ভাই বলে।

পরে একটা খটকা লাগলো লোকজন আমার মামার নামে শ্লোগান দেয় কেন ? আম্মা তার সমাধান দিলেন, এটা মজিদ ভাই না মুজিব ভাই। গাড়ী ! গাড়ী !! এখন যেমন গহীন গ্রামেও হুট করে কোন না কোন গাড়ী চলে যায় তখন সেটা ছিলো না। রাস্তাও ছিলো না সে রকম। কাঁচা রাস্তায় ধূলার ঝড় ছিলো গাড়ীর সঙ্গী। কদাচিৎ কোন গাড়ী এলে আমাদের মধ্যে সাড়া পড়ে যেতো।

আমাদের বাড়ীর সামনে দিয়ে রাস্তা। অনেক দূর থেকে দেখা যেতো গাড়ী। শব্দও শোনা যেতো দূর থেকেই। তখনকার গ্রাম খুব নীরব ছিলো। এখনকার মতো লোকে গমগম করতো না, সজোরে গান বাজিয়ে গ্রাম গরম করার নিত্য ঘটনা ছিলো না।

যাই হোক, এক দিন কাচারী ঘরে পড়ছি। এর মধ্যে কানে গোলো ভাইবোন বাহিনীর চিৎকার-গাড়ী ! গাড়ী !! চিৎকার শুনে সেটা আমার মধ্যেও সংক্রমিত হলো। আমিও গাড়ী ! গাড়ী!! বলে চিৎকার করতে করতে ওদের দলে ভিড়ে গেলাম। সামনে যে আমার ভয়ানক মাস্টার সাহেব বসে ছিলেন সেটা বেমালুম ভুলে গেলাম। গাড়ী দর্শন শেষে যখন ফিরলাম তখন হুঁশ হলো আসলে কি করেছি।

কাচারীর সামনে আমার মাস্টার সাহেব সদ্য গাছ থেকে ভেঙে আনা মাদার কাঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখেই দৌড় দিতে গেলাম। কিন্তু পালাতে পারলাম না। ধরে এনে মনের সুখ মিটিয়ে মারলেন। ভাইবোন বাহিনী ধমক খেযে পালালো।

আড়াল থেকে অবশ্য সে কাণ্ড ওরা দেখেছে। সারা শরীর রক্তাক্ত হয়ে গেলো। এবার আর তিনি সরিষার তেল মাখলেন না। সে কাজ সারলেন আম্মা। হায়রে গাড়ী দেখা ! বড়ো বেলায় এসে আমিও কর্তব্যের সূত্রে বেশ কয়েক বছর গাড়ী চড়ে বিভিন্ন গ্রামের রাস্তায় গেছি।

ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা যখন আমার গাড়ী দেখতে ছুটে আসতো তখন ওদের মুখে আমার ছোট বেলার ছবি দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে যেতাম। আবেগে দু'একবার চোখেও পানি এসে যেতো। ড্রাইভারকে বলতাম গাড়ী আস্তে চালাতে। যাতে ওরা ব্যথা না পায় আর বেশী সময় ধরে মনের শখ মিটিয়ে গাড়ী দেখতে পারে। (চলবে)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।