আগের পর্ব-
Click This Link
আদিগন্ত ফসলের মাঠ
মামাবাড়ী ছিলো সুলতানপুর গ্রামে। ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া-কুমিল্লা সড়কের পশ্চিমপাশটা সুলতানপুর। তার পশ্চিমে রাধিকা। কেউ কেউ একত্রে বলে রাধিকাসুলতানপুর। রাস্তার পুবপাশের গ্রামের নাম চিনাইর।
মামাবাড়ীর সামনের রাস্তাটা বাড়ী থেকে কোমর সমান নীচু। তারপর থেকে পাকা রাস্তা পর্যন্ত ফসলের মাঠ। বেশী বড়ো না। কিন্তু রাস্তার পুব পাশেরটার যেন দিগন্তই সীমানা। সবুজের অসীম চাদর যেন বিছানো।
ধান পাকলে সেই মাঠটাই হয়ে যেতো অনন্ত সোনালী। দূর থেকে মাঠের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলা ক্ষুদে ক্ষুদে মানুষদের মনে হতো হাওয়ায় ভেসে চলেছেন।
মাঠের মাঝ খান দিয়ে রেল লাইন। ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া থেকে আখাউড়ার লাইন। দূর থেকে ট্রেনকে মনে হতো লম্বা একটা শুয়া পোকা এঁকেবেঁকে চলেছে।
অনেকক্ষণ দেখা যেতো। রং বোঝা যেতো না সব সময়। শুধু পশ্চিম থেকে সূর্যের আলো পড়লে দুপুরের পর রং বুঝতাম।
কাচারী ঘরের সামনে বিশাল ডেউয়া (এক প্রকার টকমিষ্টি ফল) গাছ ছিলো। তার ছায়ায় বসে ট্রেনের জন্য, বাসের জন্য বসে থাকতাম।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর পর বাস চলতো। মাঝে মাঝে দেখতাম ট্রাক বা স্কুটার। রাস্তা ছিলো মূলত: হেঁটে চলা লোকজন আর রিকশার দখলে। লোকজন অনেক কম ছিলো বলে ভীড় লেগে থাকতো না। বাসগুলোর নাম লেখা হতো বেশ বড়ো হরফে।
দু'একটা নাম মনে আছে-অগ্রদূত, বিদ্যুৎ ! পরে জেনেছি এগুলো ছিলো মালিক সমিতির বাস। কুমিল্লা সমবায়ের সোনালী সাফল্যের স্বাক্ষর।
বিচিত্র প্রতিবেশী, বিচিত্র নামধাম
মামাবাড়ীর কাছেই ছিলো একটি পুরনো হিন্দুবাড়ী। বিশাল এলাকাজুড়ে। বাড়ীর সামনে দীঘি সাইজের পুকুর।
পুকুর পাড়ে অনেকগুলো উঁচু মঠ। কয়েকটা ভাঙাচোরা। বড়ো হয়ে জেনেছি এগুলো সমাধিস্মারক। বাড়ীর সাথে পশ্চিম পাশে মামাদের পুকুর। তার সাথে লাগানো আরেকটা বিশাল দীঘি।
ঠিক উত্তরপাশের বাড়ীতে এক বুড়ো থাকতো। প্রায়ই তাঁর চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যেতো। ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়ার ভাসা চিৎকার চেঁচামেচিকে বলে ''কেচকেচি''। সেই থেকে বাড়ীর নাম হয়ে গেলো ''কেচকেইচ্চার বারী"
সেই কালে অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাড়ীর নামও তুচ্ছ কোন কারণে বিচিত্র নামে বদলে যেতো। কখনো সেই সব নাম অবমাননাকরও হয়ে যেতো।
আমাদের এলাকায় বাড়ীর সামনের পাঁচিলে কাঁথা শুকাতে দেওয়ায় বাড়ীর নাম হয়ে গেলো ''খ্যাঁতাঅলাগো বাড়ী''। আসল নাম ছিলো মিয়াবাড়ী। সেই কালে সবা্রতো স্বচ্ছলতা ছিলো না। কতোটা স্বচ্ছলতা থাকলে বাড়ীর সামনে দেয়াল তোলে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু সেই নাম এখনো চলছে।
আরেক বংশীয় বাড়ীতে এজমালী পুকুরের মাছ ধরার পর মাছ ভাগ হচ্ছিলো। সেই কালে দেশী কুঁচোচিংড়ী ছিলো সবচেয়ে সস্তা মাছ। চিংড়ী সাধারণত আগ্রহী কোন শরীকের ভাগে পুরোটা দেয়া হতো। কখনো জেলে বা বাড়ীর কামলাকে দিয়ে দেয়া হতো। সেই বার দুই শরীকের মনোমালিন্যের জন্য কুঁচো চিংড়ীও ভাগ করা হয়।
আর যায় কোথায় ? সারা গ্রামে রটে গেলো সেই খবর। চৌধুরী বাড়ীর নাম হয়ে গেলো ''ইছাভাগাঅলাগো বাড়ী'' !
পুয়াপিঠা
চালের আটা দিয়ে তেলে ডুবিয়ে ভাজা পুয়াপিঠা আমার প্রিয় পিঠাগুলোর একটি। নানী সেটা ভাজলে মজা লাগতো বেশী। সে বার নানীর কাছে পুয়া পিঠার আবদার করতেই নানী কাঁদতে শুরু করলেন। পরে জানলাম, কিছুদন আগে আমার বড়ো মামা (নাম ছিলো বিলাত আলী মিয়া) মারা গেছেন কি এক অসুখে ভুগে।
তখন ডাক্তাররা নানা খাবারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করতেন। ভালো হবার আশায় রোগী বা রোগীর পরিবার সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতো। বড়ো মামা রোগশয্যায় থেকে পুয়া পিঠা খাবার জন্য নানীর কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করেছেন। ডাক্তারের নিষেধ ধাকায় নানী সেটা দেননি। তার কিছুদিন পরে মামা মারা যাওয়ার পর নানী পুয়াপিঠা বানানো এবং খাওয়া ছেড়ে দেন।
ছেলে যে পিঠা না খেয়ে মারা গেছে মা বাকী জীবন সেই পিঠা আর খাননি। আমৃত্যু সেই পণ বজায় রেখেছিলেন নানী।
পালকি চলে ! পালকি চলে!!
একদিন বিকাল থেকে দেখি সাজ সাজ রব। মেঝ মামার বিয়ে। বড়ো মামা মারা যাবার পর মামী বাপের বাড়ী চলে গেছেন।
ছেলের বউয়ের জন্য নানী উতলা হলেন। (বড়ো মামীর পরে আরেক জায়গায় বিয়ে হয়েছে। মামা বাড়ীর সাথে তাঁর এখনো যোগাযোগ হয় মাঝে মধ্যে)। সন্ধ্যায় রওয়ানা হলো বর। রঙিণ কাগজ আর ফুল দিয়ে সাজানো পালকিতে যাবে বর।
বাকীরা যাবে হেঁটে। পিচ্চি আমি হাঁটবো কিভাবে ? মামার সামনে তুলে দেয়া হলো পালকিতে। অনেক পথ। এক সময় মামার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো মানুষের চিৎকার চেঁচামেচিতে।
জেগে দেখি পৌঁছে গেছি বিয়ে বাড়ীতে। ফেরার পথেও মামার সাথে আমি। মামী আলাদা পালকিতে।
অথচ আমি নিজে যখন বিয়ে করি পালকি তখন বিলুপ্ত প্রজাতি। আমি গেছি গাড়িতে ! পালকি পাইনি।
কোন মানে হয় ?
চুর রে চুর !
মামাবাড়ীতে বেড়াতে গেলে যে ঘরে ঘুমাতাম সে ঘরে খাটের সাথে বিশাল এক কাঠের সিন্দুক ছিলো। খাটটা ছিলো উঁচু। উঠতে ছোট কাঠের সিড়ি ছিলো। খাটের গায়ে নানা কারুকাজ। সিন্দুকের গায়েও।
আমি খাটের বদলে সিন্দুকের ওপরে থাকতাম। মামী ছিলেন বাপের বাড়ী। মামা আমার সাথে সিন্দুকের ওপর ঘুমালেন। মাঝ রাতে হঠাৎ মামার চিৎকারে সবার ঘুম ভেঙে গেলো-
চুর রে.......................চুর !!!!!!!!!!!!!!
সবাই ধড়মড়িয়ে উঠলাম। কুপিবাতি জ্বেলে দেখা গেলো সিঁধ কেটে চোর ঢুকেছে।
বেশ কিছু জিনিস চুরি হয়েছে। আমি আর মামা সিন্দুকের ওপরে থাকায় সেখান পর্যন্ত যেতে পারেনি চোর। কি কি চুরি হলো তার খোঁজ চললো। সব চেয়ে মন খারাপ করলেন মামা। শ্বশুরবাড়ী থেকে সদ্য পাওয়া ফিলিপসের তিনব্যাণ্ড ট্রানচিস্টারটা চোরে নিয়ে গেছে !
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।