আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মামাবাড়ী, ইশকুল ... ১০

আগের পর্ব - Click This Link ইশকুল ! ইশকুল !! ১৯৭০ সালের জানুয়ারীর এক সকালে আমাকে স্কুলে ভর্তি করা হলো সরাসরি বড়ো ওয়ানে। শিশু শ্রেণীতে পড়তে হয়নি। মায়ের হাতে পাখার ডাঁটের মার খাওয়া আর ফখরুল ভাইয়ের কাছে বাল্য শিক্ষা পাঠের সুফল। স্কুলে ভর্তি হবার আগেই আমি বাংলায় যে কোন লেখা গড়গড় করে পড়ে ফেলতে পারতাম। হেড স্যারের রুমে বাবার হাত ধরে কাঁপতে কাঁপতে ঢূকলাম।

দোর্দণ্ডপ্রতাপ হেড স্যার বজলুর রহমানের কথা ''অখ্যাত আমার বিখ্যাত শিক্ষকেরা'' সিরিজের প্রথম পর্বেই লিখেছি। এখানে তার পুনরাবৃত্তি করলাম না। শুধু হেড স্যারের সাথে বাবার কথার সারাংশ তুলে দিই- '' স্যার, ছেলেকে আপনার হাতে দিয়ে গেলাম। চামড়া আর মাংশ আপনার, আমি হাড্ডিটা ফিরে পেলেই চলবে। ছেলেকে মানুষ করে দেবেন।

'' হেড স্যার হাসিমুখে বললেন, আপনি ভাববেন না। আমার ওপর ছেড়ে দিন। শুনে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। বাড়ী এসে আম্মার কাছে এটা বলতেই আম্মা বললেন, ভয়ের কিছু নেই। এটাই স্কুলে দেবার নিয়ম।

নিয়ম মেনে স্কুলে যেতে শুরু করলাম। বাড়ীর খুব কাছেই স্কুল। নতুন পাকা বিল্ডিং। সামনে মাঠ। আইয়ুব খানের আমলে গ্রামের প্রাইমারী স্কুলগুলো পাকা করা শুরু হয়।

পাকা কারার পর আমরাই সে স্কুলের প্রথম ব্যাচে ভর্তি হই। বড়ো হয়ে জেনেছি ১৯৪৩ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠার সময় সব জমি আমার দাদাই দিয়েছেন। দাতা হিসাবে তাই স্কুল কমিটিতে আমাদের একজন আজ অব্দি আছে। এখন আমার এক চাচাতো ভাই আছে। সে আবার ওটার সামনে অবস্থিত হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক।

মাস্টার্স করে গেছে জগা বাবুর পাঠশালা থেকে। (এখন তো সেটা পুরোদস্তুর বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের কালে জগন্নাথ কলেজকে এ নামেই ডাকা হতো) পরে জেনেছি আমার আম্মাই ২০ বছর কমিটি মেম্বার ছিলেন। বাড়ীর লম্বা দরজার সাথে লাগা রাস্তা দিয়ে (যেটা দিয়ে বাস চলতো। ১৯৭৯ সালের দিকে সেটা পাকা হয়ে যায়) যেতাম স্কুলে।

ছোট ছোট পায়ে যেতে লাগতো ৭/৮ মিনিট। স্কুলের সাথেই গ্রামের বাজার। ফলে স্কুলটা আমাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় ছিলো। বাবা যদিও হাড্ডি পেলেই খুশী বলে এসেছিলেন স্কুলে সে রকম কিছুর সামনে পড়িনি। কারণ লেখা পড়ায় ভালো করে ফেললে স্যারদের আদর পাওয়া যেতো আমাদের কালে।

বেশ ভিআইপি ছিলাম। এক শ' তে দুই শ' এটা পুরনো ও বিখ্যাত গল্প। অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় অঙ্কের খাতা দিলো। ১ শ' তে ১ শ'।

ওপরে নীচের বিষয়টা হিসাব না করে বাড়ী গিয়ে আম্মাকে বললাম, আমি এক শ' তে দুই শ' পেয়েছি আম্মা। খাতা দেখে আম্মা হাসলেন। বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেই বেলা সেটা মাথায় ঢুকলো না। বাংলায় গিয়ে যখন ১ শ' তে ৯৮ পেলাম। তখন বিষয়টা মাথায় ঢুকলো।

গনি মিয়া একজন কৃষক প্রথম শ্রেণীতে পড়া যে গল্পটি সবার মনে আছে সেটির প্রথম দিকটা সবার মুখস্ত - গনি মিয়া এক জন কৃষক। তার নিজের জমি নাই। অন্যের জমি চাষ করে। ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন বর্গাচাষীর করুন অর্থনৈতিক অবস্থার পাশাপশি অপচয়ের কুফল শিক্ষা দেবার দারুন চেষ্টা ছিলো সেটা।

কিন্তু সে চেষ্টা যে মাঠে মারা গেছে তার প্রমান আমাদের দেশে বিদ্যমান সর্বব্যাপী অর্থহীন ফুটানী। মজার ব্যাপার হলো চাকরীসূত্রে উত্তরবঙ্গে কাজ করতে গিয়ে গনি মিয়ার সন্ধান পেলাম। সোজা বাংলায় সে অসাধারণ লেখকের সন্ধান পেলাম। এর লেখক কাজী জসিম উদ্দীন। ইনিও কবি ( পল্লী কবি নন) ।

তাঁর বাড়ী জয়পুরহাট (সাবেক বগুড়া) জেলার কালাই উপজেলার হারুঞ্জা গ্রামে। বহু কীর্তিমান পুরুষের জন্মস্থান এ গ্রামটি । এ জসিম উদ্দীনের পুত্র ডা. আবু হায়দার সাজেদুর রহমান ছিলেন ৬০ ও ৭০ দশকের অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার। তাঁর ভাতিজা খুরশীদ আলম ছিলেন সে সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্লে-ব্যাক গায়ক। তাঁর গাওয়া শত শত গান জনপ্রিয় হয়েছিলো।

চাচার অনেক গানও তিনি গেয়েছেন। এ বাড়ীর কাজী মোখলেছার রহমান বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে ডেপুটি ম্যজিস্ট্রেট হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার হয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রাচীনতম পুরাকীর্তির স্থল মহাস্থান গড়ের কাছাকাছি অবস্থিত হারুঞ্জা গ্রামে কিছু পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান আছে। নামতার কোরাস আমাদের হেড স্যার খুব কাজের একটা পদ্ধতি বের করেছিলেন।

প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর সবাইকে ( তখন ওয়ান আর টু'র ছুটি হতো বারোটায়। ক্লাস শুরু দশটায়। বিষয় ছিলো বাংলা আর অঙ্ক) মাঠে জড় করতেন স্যার। বেত হাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন। একেক জনকে একেকটা নামতা ঠিক করে দিতেন।

সে সেই নামতাটি বলতে থাকতো। তারটা শুনে সবাইকে চিৎকার করে নামতা বলতে হতো- একেকে এক ! দুইএকে দুই !! ইত্যাদি। কখন কার ঘাড়ে কোন নামতা বলার হুকুম হয় সে ভয়ে সবাই বিশের নামতা পর্যন্ত মুখস্ত করেছিলাম। কারণ, কোন নামতা বলতে না পারলে বজল মাষ্টরের বিখ্যাত বেতের বাড়ি খাওয়া অবধারিত ছিলো। নামতা মুখস্ত করার ফলে আমাদের অঙ্ক করার সময় বেঁচে যেতো।

দ্রুত অঙ্ক করায় নামতা জানার বিকল্প নেই। আমার দুই ছেলেকে নামতা শিখাতে পারছি না। এখন নাকি সব সৃজনশীল। কিছুই মুখস্ত করতে হয় না। (চলবে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।