আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মামাবাড়ী, ইশকুল...৭



আগের পর্ব- Click This Link মামাবাড়ীর পথে একাদিন দেখি আম্মা ব্যাগ গোছাচ্ছেন। কাল মামাবাড়ী যাবো। শুনে খুশী আর ধরে না। মামাবাড়ী মানে অপার স্বাধীনতা, সীমাহীন আদর, মজার মজার খাবার, নো ধমক আর সবচেয়ে সুখের কথা লেখাপড়া থেকে ছুটি। খুশীতে রাতে ঘুম আসছিলো না।

পরদিন সকালে রওয়ানা দিলাম রিকশায়। নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদী কোর্টের কাছাকাছি একটি খ্রীস্টান পাড়া আছে। পাড়ার কাছে সেই খাল যার নামে নোয়াখালী জেলার নাম হয়েছে ( নতুন খাল নোয়াখালীর ভাষায় নোয়া খাল। সেখান থেকে নোয়াখালী)। খালের ওপর তখন সেতু ছিলো না।

খেয়া নৌকা ছিলো। পেসেঞ্জার আর রিকশা একত্রে পার হতো। ফিরিঙ্গি নোয়াখালীর ভাষায় হেরাঙ্গী। ফিরিঙ্গি খেয়া তাই হেরাঙ্গীর খেবা। এখন পুল আছে সবাই বলে হেরাঙ্গীর হোল।

সেই পুলসিরাত পার হয়ে মাইজদী কোর্ট রেল স্টেশানে এলাম। ট্রেনে যাবো মামাবাড়ী। সেই কালে ট্রেনই ছিলো আধুনিক বাহনকূল শিরোমনি। কুউউউ..........ঝিকঝিক ! কুউউউউ......................! তখন নোয়াখালী থেকে কোন মেইল তথা এক্সপ্রেস ট্রেন ছিলো না। সব স্টেশনে থামে এমন লোকাল ট্রেন ছিলো।

তখন লোকে বলতো মিসট্রেন। ট্রেনের বগি আর ইঞ্জিনের রং ছিলো লালচে খয়েরী। লোকাল ট্রেনে বেশীর ভাগ তৃতীয় শ্রেণীর বগি। দু'একটা ছিলো দ্বিতীয় শ্রেণীর বগি। প্রথম শ্রেণী ছিলো না।

প্রথম শ্রেণী ছিলো ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট রুটে। অন্য অঞ্চলের কথা জানি না। কারণ আমার দৌড় ছিলো ওই পর্যন্ত। তখন ডিজেল ইঞ্জিন চালু হয়ে গেছে। নোয়াখালীর মতো অবহেলিত রুটে ডিজেল ইঞ্জিনের বদলে তখনো টিকে থাকা কয়লার ইঞ্জিনে চলতো ট্রেন।

আমাদের আবার কয়লার ইঞ্জিন ছিলো প্রিয়। কারণ কয়লার ইঞ্জিনের কুউউউউ...............হুইসেল আর স্টিম ছেড়ে ঝিকঝিক শব্দে চলা আমাদের খুব প্রিয় ছিলো। ট্রেনে গেলেই চাইতাম কয়লার ইঞ্জিন থাকুক। সেদিন ট্রেন আসতেই খুশিতে মন ভরে গেলো কুউউউ্ ঝিকঝিক শব্দে। মনের আনন্দে ট্রেনের দুলুনীতে দুলতে দুলতে পৌঁছে গেলাম লাকসাম জংশনে।

আমাদের কালে একটা প্রবচন ছিলো-কতো লাকসাম ! কতো বাত্তি !! উল্কা-গ্রীণ এ্যারো লাকসাম এসে নোয়াখালীর ট্রেন থেকে নেমে গেলাম। কারণ ওর দৌড় সে পর্যন্তই। আমরা অপেক্ষা করছিলাম সেই কালের সবচেয়ে বনেদী এক্সপ্রেস টেন ''উল্কা'র" জন্য। ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে চলতো উল্কা। আরেকটা উল্কা চলতো আখাউড়া সিলেট রুটে।

বসে আছি। অপেক্ষা আর শেষ হয় না। ধমকের ভয়ে আম্মাকে কিছু বলতে পারছিলাম না। অতীষ্ট হয়ে দেরীর কারণ জানতে চেয়ে যা জানলাম তাকে সুসংবাদ বলা যায় না। নোয়াখালীর ট্রেন লেট করায় আমাদের রেখেই উল্কা চলে গেছে ঢাকার পথে।

আমরা বসে আছি দুপুরের পরে আসা গ্রীণ এ্যারোর জন্য। সেটাও এক্সপ্রেস ট্রেন। সে আবার ভিন্ন। তার গায়ের রং লালচে খয়েরী নয়। নামের সাথে মিল রেখে ইঞ্জিন বগি সব সবুজ।

সবুজ তীরের মতোই সবুজ মাঠের বুক চিরে তীর বেগে ছুটে চলতো। গ্রীন এ্যারো আর ফেলে গেলো না। ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া স্টেশনে এসে নামলাম মাগরিবের পরপরই। দক্ষিণ পাশের ২নং প্ল্যাটফরমে নামলাম। আকাশ সিঁদুরে লালে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

মনে হলো অচেনা মাঠের পারে নেমে দাঁড়িয়েছি। জার্নি বাই ট্রাক রিকশায় এলাম বাসস্ট্যান্ড। এখানে এসে পড়লো মাথায় বাজ। শেষ বাস কুমিল্লার পথে ছেড়ে গেছে। যাবো শহরের ৬ মাইল দক্ষিণে বি বাড়ীয়া কুমিল্লা রোডের পাশে সুলতানপুর গ্রামে।

কারণ তখন ওখানেই ছিলো মামাবাড়ী। আব্বা মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছেন। তখন বাসের লোকজন এগিয়ে এলো সাহায্য করার জন্য। তখনো বিপদাপন্ন মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগে সর্বস্ব কেড়ে নেবার সংস্কৃতি এতো বিপুল প্রসার লাভ করেনি। ওরা আমাদেরকে কুমিল্লাগামী একটি ট্রাকে তুলে দিলো।

ড্রাইভারের পাশে আমি আর আম্মা। আব্বা ট্রাকের লোকের সাথে মালের উপরে। ট্রাক আবার চলতো আস্তে। রাস্তা ছিলো খারাপ। মাল বোঝাই।

তাই পথ যেন আর শেষ হয় না। দেখতে দেখতে সেই ভয়ানক ভ্রমন শেষ হলো। ঘোর অন্ধকার রাস্তার পাশে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো ট্রাক। আমরা হেঁটে পৌঁছে গেলাম মামাবাড়ী। রাস্তার বেশ কাছেই বাড়ী।

নানী যখন বিস্ময় কাটিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমার নাতি আইছেরে মজিদ ! ( আমার সেই মেঝমামা, যার নামে স্লোগান দিয়েছিলাম। ) নানীর সেই খুশী আর আদরে ভেসে গেলো পথের সব ক্লান্তি ! (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।