ফারুক মেহেদী ( কালের কণ্ঠ ---২৫/০৬/২০১১ )------
বহুল প্রতীক্ষিত গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী সড়কে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে। নির্মাণ করছে বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। সংস্থাটি প্রকল্পের জন্য আমদানি করা যাবতীয় নির্মাণসামগ্রী, যন্ত্রপাতি ও যানবাহনের শুল্ক মওকুফ চেয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা ঠিকাদার ও সরবরাহকারীদের বিলের ওপর ভ্যাট ও অগ্রিম আয়করও দিতে চায় না। এ ছাড়া প্রকল্পের ডিজাইন কনসালট্যান্টসহ অন্য বিশেষজ্ঞদের বিলের ওপর ভ্যাট ও অগ্রিম আয়কর মুক্তিও চেয়েছে বেলহাসা একম।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মতামত জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ২৯ মে প্রচলিত বিধান অনুযায়ী যন্ত্রপাতি ও যানবাহনে শুল্ক আরোপ, সেবা ও পণ্যের বিলের ওপর ভ্যাট এবং আমদানি করা পণ্যের ওপর উৎসে কর আরোপের পক্ষে মত দিয়েছে। অর্থাৎ যেসব বিষয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণকারী সংস্থা শুল্ক, ভ্যাট ও কর মুক্তি চেয়েছে, সেগুলোতে বিধি অনুযায়ী ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে সরকার রাজস্ব হারাবে। শুধু বেলহাসা একমই নয়, এ রকম শত শত সেবা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান এনবিআরে প্রতিনিয়ত শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করে চলেছে।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, বাজেট ঘোষণার আগে ও পরে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগে শুল্ককর কমানো বা মওকুফ করার জন্য সারা দেশের বিভিন্ন সংস্থার অন্তত দেড় হাজার আবেদন জমা পড়েছে।
এসব আবেদন শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর শাখার বিভিন্ন টেবিলে বিবেচনার জন্য জমা হচ্ছে। সবাই তাদের শিল্প টিকিয়ে রাখতে নানা যুক্তি দেখিয়ে সুবিধা নিতে চাইছে। এ তালিকায় দেশের সম্মানীয় বলে পরিচিত মুখ যেমন রয়েছেন, তেমনি সংসদ সদস্য, শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীর নামও রয়েছে।
এনবিআরের আয়কর প্রশাসনের সদস্য সৈয়দ আমিনুল করিম এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, '৪০ বছর ধরে শুধু কর মওকুফের সংস্কৃতি চলে আসছে। এবারই প্রথম আমরা এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছি।
বিদেশি উৎস ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎসকে শক্তিশালী করা ছাড়া উপায় নেই। তাই সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর স্বার্থে, রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে কর আদায় করতেই হবে। সুশাসনের স্বার্থে এবারই আমরা রাষ্ট্রের শীর্ষ মহল থেকে সর্বস্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কর আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছি। বেশি সম্পদের মালিকদের কাছ থেকে বেশি কর আদায়ের উদ্যোগও নিয়েছি।
দেশের প্রয়োজনে আমরা এবার আরো কঠোর হচ্ছি। '
এনবিআরের শুল্ক শাখার সাবেক সদস্য ড. রশিদ-উল-আহসান চৌধুরী বলেন, দেশের উন্নয়নের প্রয়োজনে সামর্থ্যবান সবাইকে কর দেওয়া উচিত। এটা সবাই স্বীকার করেন এবং নিজেরাও বলেন। তবে যখন করারোপ করা হয়, তখন নিজেদের ওপর পড়লে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান এবং তা বাতিলের নানা চেষ্টা চালান। এভাবে তদবির করে কেউ যদি বাড়তি সুবিধা পান, তবে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয় না।
প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়। কর অবকাশ, অব্যাহতি বা কর মুক্তি দিলে কেউ বাড়তি সুবিধা পায়, কেউ পায় না_এতে দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০১১-১২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার এক লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব খাতসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে এক লাখ ১৮ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। ব্যয় ও আয়ের মধ্যে ফারাক ৪৫ হাজার ২০৪ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা মতে, এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঠিকমতো পাওয়া গেলেও সরকারকে ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতে দেশের ভেতর থেকেই ব্যক্তির সঞ্চয়পত্রে সুদ দিয়ে এবং ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ধার নিতে হবে। কিছু ধার করতে হবে বিদেশিদের কাছ থেকেও। এসবের বাইরে সড়ক, মহাসড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংস্থান করা, খাদ্য আমদানি, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বানানো, এসবের আধুনিকায়ন, সেবার সম্প্রসারণ, প্রযুক্তির বিস্তার ইত্যাদি অসংখ্য কাজ করার লক্ষ্যে ৪৬ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা বা এডিপি ঘোষণা করা হয়েছে। আর এসব ব্যয় মেটাতেই সরকার আয়ের খাতগুলো বিশেষ করে রাজস্ব খাতের কোন কোন উৎস থেকে আয় করা হবে তার একটি পরিকল্পনা করেছে। কোনো কোনো খাতে একটু বেশি করারোপ করা হয়েছে, কোনো পণ্য আমদানিতে একটু শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।
কোনো কোনো পণ্যের ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে।
বাজেট তৈরির সঙ্গে জড়িত এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, অর্থনীতির আকার, মানুষের চাহিদা বৃদ্ধিসহ নানা প্রয়োজনে বাজেটের আকার বাড়ানো হয়েছে বলেই কিছু ক্ষেত্রে করের আওতা ও হার বাড়ানো হয়েছে। বিনিয়োগ ও অগ্রগতির স্বার্থে সরকার যেমন অবকাঠামো গড়ে তোলার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে, তেমনি বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ীরাও অবিরাম এসবেরই দাবি জানিয়ে আসছেন। সবাই বিদ্যুৎ, গ্যাস সমস্যার সমাধান, সড়ক ও বন্দর উন্নয়নের দাবিতে সোচ্চার। কিন্তু এসবের ব্যয় মেটাতে যখনই বিভিন্ন খাতে বাড়তি শুল্ককর আরোপ করা হয়, তখনই আপত্তি আসে বিভিন্ন মহল থেকে।
এদিকে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন ও সেমিনারে ব্যবসায়ী ও শিল্পদ্যোক্তারা নিজ নিজ ফোরামের হয়ে বাড়তি শুল্ককর কমানো ও প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। আলাদা ফোরাম হিসেবে তৈরি পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজিএমইএ, টেঙ্টাইল খাতের সংগঠন বিটিএমএ ও নিট খাতের সংগঠন বিকেএমইএ উৎসে কর কমানোর জোরালো দাবি জানিয়েছে। ঢাকা স্টক একচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জও তাদের ব্রোকারেজ হাউসের কমিশনের ওপর কর কমানোর দাবি জানাচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস, বাংলাদেশ স্প্রিং প্রস্তুতকারক সমিতি, মেলামাইন প্রস্তুতকারক সমিতি, বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন, ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ, ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ, পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম টায়ার টিউব ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স গ্রুপ, মেডিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট ও হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ইম্পোর্টার্সসহ নানা খাতের উদ্যোক্তারা বাড়তি কর, শুল্ক, ভ্যাট প্রত্যাহার ও কমানোর দাবিতে অবিচল রয়েছেন।
তাঁদের কেউ কেউ যুক্তি দেখাচ্ছেন, বাড়তি করারোপের ফলে শিল্প বসে যাবে। কেউ বলছেন তাঁরা রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতা হারাবেন। কেউবা বলছেন শিল্প অচল হয়ে অসংখ্য শ্রমিক চাকরি হারাবেন। কারো কারো দাবি, পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, ফলে সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যাবে ইত্যাদি।
শুধু বাজেটের আগে বা পরে নয়, দেখা গেছে সব সময়ই কিছু বড় প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিও করমুক্তি নিয়েছেন।
যেমন দেশি-বিদেশি যত তেল-গ্যাস কম্পানি বাংলাদেশে কাজ করছে, তারা যেসব পণ্য আমদানি করে তার শুল্ক দিতে হয় না। দাতা সংস্থা ও বিদেশি মিশন কর্মকর্তাদের আয় ও যানবাহন করমুক্ত। ইপিজেডে যত শিল্পকারখানা রয়েছে তাদের কোনো কর দিতে হয় না। রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত। আয়করও দিতে হয় না।
ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়াসহ অনেক শিল্প বছরের পর বছর করমুক্তি পেয়েছে।
এনবিআরের আয়কর বিভাগ জানায়, তৈরি পোশাক শিল্পকে কর অবকাশ দেওয়ায় তারা কর সুবিধা পেয়েছে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকার। আর গত ছয় বছরে এ শিল্পটি শুল্ক ছাড় পেয়েছে আরো প্রায় এক লাখ কোটি টাকার। ইপিজেডে সব শিল্পকে কর সুবিধা দেওয়া হয়েছে অন্তত আড়াই শ কোটি টাকার। এ পর্যন্ত মৎস্য ও পোলট্রি শিল্প কর সুবিধা পেয়েছে প্রায় পাঁচ শ কোটি টাকার।
আর ফার্মাসিউটিক্যালস ও চামড়াসহ অন্যান্য শিল্প পেয়েছে আরো অন্তত এক হাজার কোটি টাকার করমুক্তি সুবিধা। বছরের পর বছর আয়কর অব্যাহতি নিয়েছে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বহুল আলোচিত প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকও। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংস্থাটি কখনো কর দেয়নি। তাদের কর সুবিধার পরিমাণ প্রায় পাঁচ শ কোটি টাকা। গাড়ির শুল্ক বাড়ানোয় আপত্তি রয়েছে আমদানিকারকদের।
এনবিআর সূত্র আরো জানায়, কর মুক্তি বা কমানোর তৎপরতায় কম যান না বর্তমান সংসদের এমপিরাও। তাঁরা বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করছেন বিনাশুল্কে। এ সুযোগ আর নেবেন না বলে ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতে বললেও পরে ঠিকই তা আদায় করে নিয়েছেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পরিচালিত অভিযানে অনেক ভিআইপির কর না দেওয়ার নানা ঘটনা সামনে চলে আসে। কর কমানো বা মুক্তির ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
বর্তমান সংসদের অন্তত ২০০ এমপি প্রস্তাবিত বাজেটের আগে তামাক ও বিড়ির ওপর কর না বসাতে জোর তৎপরতা চালিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে আইসিটি মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি দবিরুল ইসলাম, মেহেরপুর-২ আসনের এমপি আমজাদ হোসেন, ভোলা-৩ এর এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী, বরিশাল-২ এর এমপি মনিরুল ইসলাম, সুনামগঞ্জ-১ এর এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, রাজবাড়ী-১ এর এমপি কাজী কেরামত আলী, বাগেরহাট-২ এর এমপি মীর শওকত আলী, রংপুর-২ এর এমপি ফরিদা আখতার হীরা ও রাজশাহী-২ এর এমপি ফজলে হোসেন বাদশা উল্লেখযোগ্য।
আয়করসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরেও টেঙ্টাইল মেশিনারি, টিস্যু গ্রাফটিং, পেট্রো কেমিক্যালস, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, বয়লার, কম্প্রেসার, বায়ো ফার্টিলাইজার, ইনসেক্টিসাইড, ফার্মাসিউটিক্যালস ইত্যাদি শিল্পকে কর অবকাশের আওতায় রাখা হয়েছে। ফলে এসব খাতে কোনো কর আসবে না। এভাবে সব সময়ই নানা দাবি ও আবেদনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেদের সুবিধাগুলো আদায় করে নেন।
বিদেশি শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা গড়ে তোলা, স্থানীয় চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান বাড়ানোসহ নানা যুক্তিতে সরকার করমুক্তি দিয়ে এলেও এ সুবিধা একবার চালু হলে আর প্রত্যাহার করা সম্ভব হয় না। সরকার কর বসানোর উদ্যোগ নিলেই আপত্তি ওঠে। অথচ যারা আপত্তি করছেন, তাঁদেরই বেশি মাত্রায় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো দরকার। তাঁরাই অবিরাম এসবের দাবি জানান।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের কর ও শুল্ক শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকার কোনো ব্যক্তি নয়, একটি প্রতিষ্ঠান।
দেশ পরিচালনা ও এর উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে সরকারকেই দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে অর্থের সংস্থান করতে হয়। অথচ এর জন্য শুল্ক কর আরোপ করলে বা হার বাড়ালে আপত্তি করেন ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা, যাঁরা বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অবকাঠামো নেই বলে নিজেরাই সরকারকে দোষারোপ করেন। আবার বিদেশি দাতা সংস্থা থেকে ঋণ নিলেও আপত্তি করা হয়। এ অবস্থা চলতে পারে না। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।