মফস্বল থেকে পাকাপাকিভাবে ঢাকায় আসা ১৯৯৯ সালে। পরের বছরই পহেলা বৈশাখ- বন্ধুদের সেকি প্রস্তুতি! কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ছুটি আমাকে পাঠিয়ে দিলো খুলনায় মায়ের কাছে। পরের বছর কিছুটা থিতু হলাম। নাড়ীর প্রতি টান ছিলো, কিন্তু রমনায় ছায়ানটের অনুষ্ঠান আর চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা টানছিলো ভীষণভাবে। খুব কাছ থেকেই দেখলাম মৃত্যুকে।
বোমা হামলায় ঝরে গেলো ১০টি প্রাণ। যার বিচার হয়নি এখনো।
এরপর প্রতি বছরই পহেলা বৈশাখে মেতে উঠেছি প্রাণের উৎসবে। কিন্তু চেষ্টা করেছি ভীড় থেকে দূরে থাকতে। মৃত্যুকে যে কাছ থেকে দেখে সেই জানে মৃত্যু ভয় কি জিনিস।
বছরখানেক হলো ফটোগ্রাফির নেশায় পেয়েছে আমাকে। সেই থেকে আবারো ভীড়ভাট্টায় মিশে যাওয়া। গত বছরো তুলেছি অনেক ছবি। তবে তা ছিলো শুধুই রাজু ভাস্কের্যর পাশে স্থাপিত বিশাল জেনারেটরের ওপর থেকে তোলা। এবার ছবি তুললাম আরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে।
কিন্তু প্রায় প্রতিটি স্থানেই ছবি তুলতে গিয়ে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। শোভায়যাত্রায় ঠাই পাওয়া বিশালাকৃতির কুমির, কিংবা কাকাতুয়া, বাঘের মুখের প্রতিচ্ছবি অথবা প্রাণোচ্ছল মানুষের প্রতিকৃতি তুলবো না কি যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন তুলবো? ছবি তুলতে গেলেই অবধারিতভাবে ফ্রেমের মধ্যে ঢুকে পড়বে হয় কোনো পণ্যের পোস্টার, নয়তো সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি পেশাদার কিংবা শৌখিন ফটোগ্রাফারদের ভালো এককিট ছবি নষ্ট করার কাজটিও বোধকরি কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি হিসেবেই নিয়েছে। কেউ থাকছেন কাছে, কেউ জ্বালিয়ে দিচ্ছেন আপন শক্তিতে কেউবা বেছে বেছে খুঁজে বের করছেন দিন বদলের চেষ্টাগুলোকে।
কিন্তু ব্যবসার আড়ালে তারা আসলে বদলে দিচ্ছেন আমাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি পালনের চিরচেনা সেই ধারা, হাজার বছরের আঙ্গিক।
ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গায় এখন কাকচক্ষু জল। তবে সে জলে কেবলই বিষ। নদী থেকে অনেকটা খালে অবনমন হয়েছে তুরাগ, বালুর। শীতলক্ষ্যারো একই অবস্থা।
মুঠোফোন সেবা দেয় এমন একটি প্রতিষ্ঠান তাই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনলো ধানমন্ডি লেকে। নদী দখল আর দূষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে ধরলে এই উদ্যোগে সাধুবাদ জানাতেই হয় বৈকি। অন্যভাবে ভাবলে, ইট পাথরের আধুনিক এই শহরে এই প্রথম নৌকাবাইচ দেখলো নগরের মানুষ। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো স্বচক্ষে দেখলো প্রথমবারের মতো। দেখে চোখও জুড়ালো তারা।
কিন্তু ফটোগ্রাফারেরর চোখ আর জুড়ায় না। কারণ যেখানে লেন্স তাক করি, সেখানেই কেবল বাংলালিংক। মনে প্রশ্ন জাগে, নগরে ঐতিহ্যের প্রদর্শন না কি পণ্যের বিজ্ঞাপন? আমি ভালোভাবে ছবি তুলতে পারেনি, তাই হয়তো অনেকেই ভাববেন ব্যক্তিগত কষ্ট কিংবা ক্ষোভ থেকে বিষয়টিকে বিচার করছি। এমন কেউ ভাবলে তাতে দোষ দেবো না খুব একটা। কিন্তু একবার ভাবুনতো, হাজার বছরেরর ঐতিহ্য আর কৃষ্টিকে পৃষ্টপোশকতা দিতে গিয়ে মুফতে কত বড় প্রচারণা চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো?
অমুক কোম্পানি, তমুক কোম্পনির লোগো আর শুভ নববর্ষ লেখা কাগুজে পাখা বিকোতে দেখলাম দেদারছে।
হাতে হাতে শোভা পাওয়া এই কাগুজে হাত পাখাগুলো কিক্রি হয়েছে পাঁচ থেকে দশ টাকায়। অথচ তাল পাখা নিয়ে বসে থাকা দোকানীর অধিকাংশকেই দেখলাম সারা দিন কেবল নিজের পাখাতে বাতাস করতে। যে কয়টি পাখা নিয়ে বসেছিলেন তারা, তার প্রায় সবগুলোই নিয়েই সন্ধ্যা বেলা ঘরে ফিরতে হয়েছে তাদের। হাত পাখার ব্যবসাতেও কর্পোরেট থাবাটা দেখলাম ভালোই পড়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।