আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাধবকুন্ড আর চঞ্চল ভাইয়ের আত্মার আত্মকাহিনী - ৩



খেতে বসে কোন ভাষা খুঁজে পায় না অসিত। অনীতাও চুপচাপ খেয়ে ওঠে। খাবার পর্ব সেরে উঠোনে বসে তারা। অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে মুখোমুখি বসেও যেন কেউ কারো চোখের আলো দেখতে পায় না। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর নিশাচর প্রাণীদের চলাফেরা জীবনের জানান দেয় শুধু।

নীরবতা ভেঙ্গে অসিত বলে,‍“তাহলে আমি কেবল একজন ভালো বন্ধু,এর চেয়ে বেশী কিছু না, তাই না অনীতা?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনীতা উত্তর দেয়,“আমরা একসাথে অনেকটা সময় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পার করেছি, অনেকটা সময় আমি তোমাকে দেখার, জানার সুযোগ পেয়েছি। তোমাকে পেয়ে যে কোন মেয়েই সুখের জীবন পাবে। কিন্ত্ত সে জীবন হয়তো কোন শহুরে মেয়ের জীবন, যার বেড়ে ওঠা, স্বপ্ন দেখা – সবই শহরকে ঘিরে। সেখানে আমি এ গ্রামের আলো-বাতাসে মানুষ হয়েছি। সত্যি বলতে কি জানো, শহুরে জীবনে আমি অনেক নূতন নূতন স্বপ্নের হাতছানি পেয়েছি।

চাইলে নিজেকে তাতে তৃপ্ত আর অভ্যস্ত করে তুলতে পারতাম। কিন্ত্ত আমার মায়ের চিঠি আর আমার গ্রামের মানুষের কথা সব সময় আমাকে আমার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিত। ” এ পর্যন্ত বলে থামে অনীতা। তারপর আবার শুরু করে,“আমার গ্রামে তুমি মাত্র দু’দিন হল এসেছো, তাই তোমার চোখে এর সৌন্দর্যই ধরা পড়েছে। এর মাঝে আমরা প্রতিনিয়ত কত যে সমস্যা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে চলেছি, তা জানলে তোমার আর এই ভালো লাগাটা থাকবে না, অসিত।

আমরা তোমাদের সাথে, বাঙালীদের সাথে অনেক সমঝোতা...না, যুদ্ধ করেই টিকে আছি। ভূমি আইনের ফেরে পড়ে আমরা আমাদের নিজেদের জায়গাটুকুও ভোগ-দখল করতে পারি না। এ সবুজ বনানী – প্রাণের উৎস, আমাদের জন্য এক চরম ভোগান্তির কারণ। বাঙালীরা প্রায়ই আমাদের গাছ কাটার জন্য উৎসাহ দেয়, হাত লাগাতে বলে। তাতে সায় দেয়নি বলে এ গ্রামের অনেকেই আজ ফেরারী আসামী।

জুমের চাষ করে আমরা আমাদের খাবার কষ্ট কিছুটা কমাতে চেষ্টা করি, কিন্ত্ত তার মাঝেও আছে বাঙালীদের ভাগ বসানোর অন্যায় আবদার। জমি, গাছপালা, জুমের ফসল, পানের বরজ – আমাদের বেঁচে থাকাটাই একটা সমস্যা। এজন্যই আমার মা আমাকে শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছেন, যাতে করে আমি আমাদের সমস্যাগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারি, আর আমাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম ভালোভাবে চালিয়ে যেতে পারি। ” “রাণী হবার পর এসব সমস্যার মুখোমুখি আমি। এদের নিয়েই আমার প্রতিদিনের জীবন।

শহরে মানুষের ঘর-বাড়ী অনেক বড়, তাতে ঘরের সংখ্যা অনেক, সেই সাথে আছে অনেক সমস্যা, অনেক সংকীর্ণতা। সেই তুলনায় আমার গ্রামের মানুষ অনেক সহজ, তাদের একটাই ঘর, একটাই চাল। আর এর মাঝেই রয়েছে তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার আশা। এ আশায় বুক বেঁধে তারা প্রতিদিন পাহাড়ে পাহাড়ে কাজ করে, পানের চাষ করে, জুমের আবাদ করে। এদের মনের মাঝে সারল্য ছাড়া আর কোন কিছুর স্থান নেই।

এই যে দেখছো, উঠোনে যে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা খেলা করছে, হেসে আর আনন্দ করে পাড়া মাথায় করছে, এদের জন্য আমার স্কুলের ব্যবস্থা করতে হবে। আর স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে ওরা যখন আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে গ্রামে ফিরে আসবে, তখন দেখবে আমাদের এ গ্রামে আর এতো অন্ধকার থাকবে না। আর এতসব কাজ ফেলে আমি যদি তোমার সাথে ঘর বাঁধি, আমার গ্রামের সবার জীবন অন্ধকার আর হতাশার অমানিশায় ঢেকে আমাকে তোমার সাথে শহরে যেতে হবে। হয়তো রাণীর পদটা ততটা মানায় না আমার। কিন্ত্ত আমার পদের চেয়ে আমার কাছে আমার দায়িত্বটা অনেক বড়।

আর এ কারণেই আমি আমার নিজের সুখ-শান্তির কথা বড় করে ভাবতে পারছি না। এখন তুমিই আমাকে বলো, এতকিছু ফেলে আমি কিভাবে তোমার হাত ধরি ?” অসিত মুখ বুজে ঠায় বসে থাকে। অনীতার দায়িত্ব কতটা বড়, তা বোঝার চেষ্টা করে সে। প্রেমিক অসিতের মন ভেবে পায় না, তার মতো ছেলেকে অনীতা কেন গ্রহণ করছে না। তার অশান্ত মন আরো বিচলিত হয়ে ওঠে।

দূরে পাহাড়ে জ্বলা জোনাকী পোকাগুলো অমাবস্যার ঘোর আঁধারে যেন বিন্দু বিন্দু আলোর রশ্মি হয়ে তার কাছে ধরা দেয়। তার ভাবনাগুলো অনীতার অন্ধকার মনে ভালোবাসার আলোর বিন্দু হাতড়ে বেড়ায়। (চলবে)

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.