এবার কুলাউড়া এসে চঞ্চল ভাই’র অবস্থা দেখে আমি তো হতবাক। তার মনটা একটু ভালো করার চেষ্টায় অনেক কথা বলার চেষ্টা করলাম, জানার চেষ্টাও নেহায়েত কম হল না। ফল হল এই, উনি আমাকে নিয়ে মাধবকুন্ড যাবার প্ল্যান করে ফেল্লেন। আপত্তি না করে উনার সাথে বেরিয়ে পড়লাম।
মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের সশব্দ উপস্থিতি যেন টারশিয়ারি যুগের পাহাড়ের নীরবতা ভাঙ্গার এক অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টা।
উঁচু থেকে সশব্দে পড়ে অবিরাম এ স্রোতধারার চলার যেন কোন শেষ নেই। এর শব্দ পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনি হয়েই যেন বার বার ফিরে আসে। নানান নাম-না-জানা গাছ-পালা, লতা-পাতা আর সবুজের সমারোহে এখানে জীবনের উদ্বাত্ত উপস্থিতি। নবীন-প্রবীণের উচ্ছ্বাস আর ঝরনার শব্দও এ পাহাড়ের মাঝে প্রাণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে না। বিজ্ঞানের অবদানে মানুষের দূরের পৃথিবী আজ হয়েছে অনেক কাছের, সেই সাথে প্রকৃতি হয়েছে বিপন্ন, নিঃস্ব।
সভ্যতা তার সব সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে। প্রায় দশ বছর পর মাধবকুন্ড এসে এর কোন ব্যত্যয় দেখলাম বলে অন্ততঃ আমার মনে হল না।
এখানে এসে চঞ্চল ভাইয়ের মনের বন্ধ জানালাগুলো যেন খুলে গেল। সেই কবে, প্রায় ৮৬ কি ৮৭ সালের দিকে, তখন উনি এখানে আসতেন এ্যাডভেঞ্চার এ। তেল-চিনি-চাল আর চুলো নিয়ে চলে আসতেন এ প্রকৃতির মাঝে।
পাশের চা-বাগান আর খাসিয়া পুঞ্জিতে তার তখন অবাধ চলাফেরা। তার মুখ থেকে শোনা দু’একটি গল্পের কথা এখানে না বল্লেই না।
অনীতা আর অসিত
মাধবকুন্ডর পাশেই খাসিয়া পুঞ্জি। অনীতা এ গ্রামের রাণীর ছোট মেয়ে। তাদের প্রথা অনুযায়ী সেই হবে গ্রামের পরবর্তী রাণী।
সবাই তাকে স্নেহ করে, সেই সাথে ভবিষ্যত রাণী হিসেবে সম্মানও করে। পাশের এক চা বাগানে মিশনারি স্কুল শেষে অনীতা তখন কলেজে যায়। ধীরে ধীরে বনের আশেপাশের গাছ-গাছালি বড় হয়, সেই সাথে বড় হয় অনীতাও। কলেজ পাশ দিয়ে সে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য তৈরী। মা-বাবা আর গ্রামের সকলের চোখের পানি আর অজানা ভয়-ভীতি - সব পেছনে ফেলে অনীতা চলে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
লোক-প্রশাসনের ছাত্রী অনীতা তখন শুধুই একজন ছাত্রী। দেখে বোঝার উপায় নেই সে এক অখ্যাত খাসিয়া গ্রামের রাণী হতে চলেছে।
অসিত মা-বাবার একমাত্র আদরের সন্তান। অনেক পূজা-অর্চনা দিয়ে আর মানত করে তবে এ সন্তানের মুখ দেখেছেন তারা। কাজেই ছেলের কোন বায়না আর ফরমাসই অপূর্ণ থাকেনি।
তবে অসিত বুদ্ধিমান ছেলে, পড়াশোনায়ও ভালো। সেও একই সময়ে এলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। অনীতার সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠলো অনেক অল্প সময়েই। অনীতা গ্রামের মেয়ে, পাহাড়ী মেয়ে। শহুরে আর দশটা মেয়ের থেকে সে যেন কেমন আলাদা।
তার সংযমী আচরণ, বিচক্ষণতা আর সহজ-সরল জীবন সহজেই আকৃষ্ট করে অসিতকে। কিন্ত্ত সংসার নিয়ে ভাবার সময় তখন তার নেই, সে তখন ফার্স্ট ক্লাস ধরে রাখার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় ব্যস্ত।
দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যায়। অনীতা ভালো রেজাল্ট করে, অসিতেরও ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে সবাই যার যার গন্তব্যে চলে যায়।
অনীতা ফিরে আসে তার গ্রামে। তখন তার মা’র বয়েস হয়েছে, সময় এসেছে তার দায়িত্ব বুঝে নেবার। এদিকে অসিত ব্যাংকে ভালো চাকরী পায়, কিন্ত্ত তার মন ততদিনে বুঝতে পেরেছে অনীতার অভাব। অনীতার অনুপস্থিতিতে তার বু্কটা হু হু করে ওঠে। মা-বাবাকে জানায় তার পছন্দের কথা।
তখন তার মা তাকে জিজ্ঞেস করে, সে কখোনো অনীতাকে বলেছে কিনা, তাদের প্রেম কতদিনের ইত্যাদি। অসিত হেসে ফেলে। ভাবে, শুধু তো বন্ধুত্বের কথাই বলা হয়েছে, আসল মনের কথাটা বলা হয়নি কখোনোই। তখন মোবাইল ফোন ছিলো না, ছিলো না ই-মেইলও। চিঠি লিখে সে অনীতাকে জানায়, সে বেড়াতে আসছে তাদের গ্রামে।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।