অন্তহীন আমাদের পথচলা,জীবনের বাঁকে-বাঁকে গতির পরিবর্তন। আর চাওয়া - পাওয়ার অসম সমীকরণ। এই নিয়েই আমাদের জীবন
প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর ক্যাম্পাসে নতুন বন্ধুবান্ধব নিয়ে ভালোই সময় কাটছিল রাবি্বর। সারা দিন ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি শেষে রাতে আসর জমাতেন গণরুমে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের ইংরেজির ছাত্রটির তখন বেশ সুদিন চলছে।
এক রাতে হঠাৎ ডাক এল ৩২৮ নম্বর রুম থেকে। শুনে সবাই তটস্থ, না জানি কী আছে কপালে! কারণ রুমটি রাজনৈতিক নেতাদের ডেরা! সদলবলে গিয়ে দেখা গেল, নেতারা আছেন বেশ খোশ মেজাজে। একজন কাছে ডেকে প্রস্তাব দিলেন, 'আজকে তোদের নাটক করতে হবে, এক দল পাকিস্তানি বাহিনী, অন্যরা মুক্তিযোদ্ধা। ' সারা রাত ধরে রাবি্বরা মঞ্চস্থ করলেন হানাদার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ। বাদ গেল না কুচকাওয়াজ, রাজাকারের দালালি আর নারী নির্যাতনের অভিনয়ও।
এক বড় ভাই সামনে দাঁড়িয়ে নির্দেশনা দিলেন, অন্যরা মজা নিলেন বসে বসে। নির্যাতন থেকে যখন মুক্তি মিলল তখন ভোর। তারপর থেকে প্রায় রাতেই তাঁদের বাঁদর নাচ নাচাতেন ভাইরা। রাবি্বদের কাছে এখনো প্রথম বর্ষের গণরুমের সেই রাতগুলো কষ্টের স্মৃতি হয়ে আছে। বড় ভাইদের হাতে এমন র্যাগ খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে বিশ্ববিদ্যালয়টির অনেক ছাত্রের।
তবে সব র্যাগই এমন দুঃসহ নয়। শহীদ সালাম-বরকত হলের টিপু জানালেন, ক্যাম্পাসের বেশির ভাগ র্যাগই হয় স্রেফ মজা করার জন্য। রাহাতের মতে, 'এটা সিনিয়র-জুনিয়র মেলবন্ধনের সিঁড়ি। র্যাগ দেনেওয়ালাদের সঙ্গেই সবচেয়ে বন্ধুত্ব হয়। ' তিনি নিজেই উদাহরণ।
র্যাগ খেয়েছিলেন হলে ওঠার প্রথম দিনই। হলের দোকানে নিয়ে এক কেজি মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দেন এক বড় ভাই। সঙ্গে নির্দেশ_এক বসায় সব খেয়ে শেষ করতে হবে। বড় ভাইয়েরা চার পাশ থেকে ঘিরে মৃদু হাসছেন। রাহাত দেখলেন আশপাশে অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছে রুমমেটরা।
তাঁরা তখনো রাহাতের খাওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে জানেন না। যখন জানলেন, ততক্ষণে গোটা বিশেক মিষ্টি সাবাড় করে নতুন প্যাকেটের দিকে হাত বাড়িয়েছে রাহাত। এই নাটকের শেষ দৃশ্য_চোখ কপালে তুলে বিরস বদনে সিনিয়ররা একে-ওকে বিল দেওয়ার জন্য ঠেলছেন। সেই থেকে রাহাতের নাম 'খাদক'। সিনিয়রদের সঙ্গেও জমে গেল দারুণ বন্ধুত্ব।
তাঁর মতোই আরেক বিখ্যাত মানুষ অর্থনীতির রাসেল। র্যাগে বাংলা সিনেমার ভিলেন ডিপজলের ডায়ালগ দিয়ে রাতারাতি তারকা বনে গেছেন তিনি। তবে আমির খান অভিনীত 'থ্রি ইডিয়টস'র মতো জুনিয়রদের র্যাগ দিতে গিয়ে সিনিয়রদের ধরা খাওয়ার ঘটনাও নেহাত কম নয়। ইঁচড়েপাকাদের দলে আছেন দর্শনের আরিফ। তাঁকে র্যাগ দিতে গিয়ে উল্টো বিস্তর ঝামেলায় পড়েছিল সিনিয়র ভাইয়েরা।
এক বড় ভাইয়ের নির্দেশ ছিল ইলেকট্রিসিটি না থাকা অবস্থায় যেভাবে হোক কম্পিউটার চালু করতে হবে। সেয়ানা আরিফ কম্পিউটার খুলে হার্ডওয়্যার একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিলেন। সে তাণ্ডবে শেষ পর্যন্ত কম্পিউটারই বরবাদ হয়ে গেল। প্রত্নতত্ত্বের শিহাবকেও র্যাগ তো খেতেই হয়নি বরং ফার্স্ট ইয়ারে তিনিই উল্টো অনেককে র্যাগ দিয়েছেন। রহস্য ভাঙলেন বন্ধু তৌহিদ।
'ছয় ফুট লম্বা, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী শিহাবকে দেখলে সবাই ভয় পেত। কোন ইয়ারে পড়ে জিজ্ঞেস করার সাহসও করেনি কেউ। ' মনের আনন্দেই তাই ফার্স্ট ইয়ার কাটিয়েছেন শিহাব। দেখলেই অনেকে সালাম দিত, মনে পড়লে এখনো হাসি পায় তাঁর। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের খানজাহান হলের বুদ্ধিমান রনি তো বড় ভাইয়ের রুমে ঢোকার আগে মোবাইলে পাঁচ মিনিট পর পর অ্যালার্ম দিয়ে রাখতেন।
অ্যালার্মের শব্দে বাসা থেকে ফোন এসেছে বলে বেরিয়ে গিয়ে র্যাগ থেকে বাঁচতেন।
ছেলেদের মতো এত যন্ত্রণাকর নয় মেয়েদের র্যাগ। ওদের র্যাগ মানেই ফার্স্ট ইয়ারে ছাত্রীদের দিয়ে ইচ্ছেমতো খাটিয়ে মারা আর নানা শর্তের জীবনযাপন। মোবাইলে কথা বলা যাবে না, প্রতিদিন রুম ঝাড়ু দিতে হবে, বড় আপুর ল্যাবের ব্যবহারিক খাতা লিখে দিতে হবে_আরো কত কি! মাঝেমধ্যে সিনিয়রদের কেউ আবার বায়না ধরেন বাজার করতে হবে, রান্না করতে হবে।
বছর তিনেক ধরে জাহাঙ্গীরনগরে র্যাগ দেওয়ার হার অনেক কমেছে।
বাংলার মাহফুজ জানালেন, 'সিনিয়রদের র্যাগ স্রেফ মজা করার জন্য হলেও রাজনৈতিক র্যাগ ছিল ভয়াবহ। ' মীর মশাররফ হোসেন হলের পদার্থবিজ্ঞানের আরমানকে ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুমের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা মাপানো হয়েছে সাতবার। ভয়াবহ এ অভিজ্ঞতার পর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে ছেলেটি। পত্রপত্রিকায় ঘটনাটি প্রকাশিত হলে বহিষ্কারও হয় কয়েকজন। বছরের পর বছর প্রতিদিন বড় ভাইদের র্যাগের শিকার হয়ে প্রথম বর্ষের ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করতেন, কবে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা হবে, ছাড়তে পারবেন গণরুম।
কেন? চলুন শুনি প্রাণিবিদ্যার শামীমের ঘটনা_র্যাগ খেয়ে হঠাৎ মাঝরাতে রুমে ফিরে ছেলেটি শুরু করল হাউমাউ কান্না। হতবাক বন্ধুরা সান্ত্বনা দেওয়া শুরু করেন, 'আর মাত্র কয়েকটা দিন, তার পরই আমরা রুম পাব। ' বন্ধুর আকুল কান্নার কারণ জানালেন রাজীব_'ক্লাস থ্রিতে ওঠার পর যে ছেলেটি কখনো ফুলপ্যান্ট ছাড়া খেলতে যেত না, সেই শান্ত, ভদ্র, মেধাবী ছেলেটিকে সেদিন রুমের মধ্যে হতে হয়েছিল দিগম্বর!'
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।