আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ধ্বংসের মুখে

রঙ্গিলা বন্ধুরে....... i_mahmud2008@yahoo.com

উজার হচ্ছে বন, অবমুক্ত হচ্ছে বণ্যপ্রাণী লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ধ্বংসের মুখে একদিকে ধবংস হচ্ছে প্রাকৃতিক বন অন্য দিকে এ বনেই অবমুক্ত করা হচ্ছে বণ্যপ্রাণী। এ দৃশ্য মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের। গাছ চোরদের প্রতিরোধ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে বন বিভাগ। দেশের অন্যতম জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মূল্যবান বৃক্ষদি প্রতিনিয়তই পাঁচার হচ্ছে। ফলে জীব বৈচিত্র ধ্বংসের পাশাপাশি প্রাণীরা হারাচ্ছে তাদের নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপনের পরিবেশ।

গাছ চোরদের অবাধ দাপট এবং খাদ্যাভাবে বনের প্রাণীরা ছুটছে লোকালয়ে। মানুষের হাতে ধরা পড়ে অনেক প্রাণী আবারও ফিরে আসছে এ বনে। কোন কোন প্রাণী আহত অথবা নিহত হচ্ছে মানুষের হাতে। কিছুদিন পূর্বেও দেশের অন্যতম চিরহরিৎ বন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে দেখা মিলতো বিশাল আকারের বৃক্ষের সারি। এখন ছায়া তরু খুব বেশি একটা চোখে পড়ে না।

চারদিক যেন বিরানভুমিতে পরিনত হচ্ছে। ক্রমশ বৃক্ষহীন হয়ে পড়ছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এখন এ বনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে চোখে পড়ে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা ফাইল করা কাটা গাছ এবং নষ্ট গাছের অংশ। বন জুড়ে রয়েছে বন উজাড়ের প্রমান হিসাবে দাড়িয়ে থাকা গাছের মোথা। কিছুদিন পূর্বেও বৃক্ষরাজির রাজত্ব করা লাউয়াছড়া বন এখন নিঃস্ব প্রায়।

প্রায় প্রতি রাতেই অব্যাহত গতিতে চলছে গাছ কাটা। বনদস্যুদের থাবায় বিরান ভূমিতে পরিণত হচ্ছে লাউয়াছড়া বনাঞ্চল। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে নিয়োজিত আই-প্যাক এর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শুধু জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে অর্ধ শতাধিক মূল্যবান বৃক্ষ চুরি হয়েছে। গাছ চোররা এতই অপ্রতিরোধ্য যে, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ লাউয়াছড়া বনের রেস্ট হাউসে রাত্রী যাপনের রাতে কটোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে গেষ্ট হাউসের পাশ থেকে গাছ কেটে নিয়েছে। তিনি জানান, এলাকায় প্রচলিত আছে লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে একটা গাছ চুরি করতে বনদস্যুদের সময় লাগে মাত্র আধা ঘন্টা।

তাদের গাছ কাটতে সময় লাগে ১০ মিনিট এবং পরিবহনে সময় লাগে ২০ মিনিট। বনদস্যুরা বনের ভিতরে প্রবেশের জন্য প্রায় ৪৫টি আকাবাকা সরু রাস্তা ব্যবহার করে থাকে। বন বিভাগের লাউয়াছড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী রেঞ্জ) এ কে এম আজহারুল ইসলাম গাছ পাচারের কথা স্বীকার করে বলেন, আমাদের জনবল কম। আর গাছ চোরেরা অত্যন্ত সংঘবদ্ধ। সীমিত সংখ্যক জনবল এবং মান্ধাত্তা আমলের অস্ত্র নিয়ে গাছ চোরদের সাথে পেরে উঠা সম্ভব নয়।

তবুও আমরা গাছ চোরদের প্রতিরোধে জীবন বাজী রেখে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, স¤প্রতি গাছচোররা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকিছড়া ষ্টীল ব্রীজের পাশ থেকে ১টি বৃহদাকার সেগুন গাছ কেটে পিকআপে ভর্তি করে। খবর পেয়ে জানকিছড়ার ক্যাম্প পাহারাদার আব্দুর রব ও নিসর্গ টহল বাহিনীর সভাপতি আব্দুল আহাদ ষ্টীল ব্রীজের এক মাথায় রশি বেঁধে ও ছোট গাছ ফেলে বেরিকেড দিয়ে গাড়িটিকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কিন্তু গাছ চোরদের পিকআপটি রশি ছিড়ে গাছের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় পিকআপের চাপায় দুই বন প্রহরী আহত হন। গুরুতর আহত আব্দুল আহাদকে মৌলভীবাজার সদর হাসপালে প্রেরন করার পর আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে সিলেট এম এ জি ওসমানী হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

পিকআপ নিয়ে গাছচোররা পালিয়ে যাওয়ার সময় বনকর্মীরা তাদের ধাওয়া করলে শ্রীমঙ্গল বিটিআরআই এর পাশ দিয়ে ভাড়াউড়া চা বাগানের ফাড়ি পথে চা সেকশনের খাদে পড়ে গাড়িটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এসময় গাছ চোররা পালিয়ে যায়। বন বিভাগ এর লোকজন খবর পেয়ে কাঠ পাচারকারী পিকআপ (ঢাকা মেট্রো ন-১৪-১১০৬) ২৫ সিএফটি সেগুন ফাইলসহ আটক করে । একই সাথে গাছচোরদের বহনকারী লাইটেস (ঢাকা মেট্রো গ-১২-০২২২৮) আটক করা হয়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, গাড়ি আটক করেও বিপদে আছেন।

গাছ চোররা তাকে প্রাণে মারার হুমকি দিচ্ছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বন দস্যুরা এতই নির্ধয় যে এদের হাত থেকে জীবন রক্ষাই দায়। কাঠ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও পুলিশ প্রশাসন কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় বনকর্মীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছেন। দেশের সব কিছু আপডেট হচ্ছে কিন্তু বন বিভাগের কোন পরিবর্তন হচ্ছেনা। বন বিভাগ সূত্র জানায়, জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বনদস্যুদের কেটে ফেলা গাছ বনাঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত ৩৩ হাজার কেভি প্রধান বিদ্যূৎ লাইনের উপর পড়ে ৬টি খুটি এলাকার বেশ কিছু তার ছিড়ে যায় ফলে কমলঞ্জ ও কুলাউড়া এ দু উপজেলা ১৫ ঘন্টা বিদ্যুৎহীন ছিলো।

এদিন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খবর পেয়ে রাত সাড়ে ৩টায় বন বিভাগ বনদস্যুদের ধাওয়া করলে বনদস্যুরাও দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে বনকর্মীদের পাল্টা ধাওয়া করে। এসময় বন কর্মীরা আত্মরক্ষার্থে ৩ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়লে বনদস্যূরা পালিয়ে যায়। পরে বন বিভাগ কেটে ফেলা গাছের ১৭ টুকরায় ৮০ ঘনফুট কাঠ উদ্ধার করে। উদ্ধার করা কাঠের মূল্য প্রায় ২ লক্ষাধিক টাকা। পল্লী বিদ্যূৎ সমিতি কমলগঞ্জ জোনাল অফিসের ডিজিএম মোবারক হোসেন জানান, বনদস্যুদের কেটে ফেলা গাছগুলো পাহাড়ের ভিতরে ৩৩ হাজার কেভি প্রধান বিদ্যূৎ লাইনের ৬টি খুটি এলাকার তার ছিড়ে, ইন্সুলেটরসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ ভেঙ্গে লক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লাউয়াছড়া বনের বাগমারা এলাকার একজন বাসিন্দা জানান, এক দিকে গাছ কেটে প্রাকৃতিক এ বন ধ্বংশ করা হচ্ছে অন্যদিকে ধ্বংসাত্বক এ বনেই আবার প্রতিনিয়ত অবমুক্ত করা হচ্ছে বণ্যপ্রাণী। স¤প্রতি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রবেশ পথ সংলগ্ন ছড়াতে ২৫ কেজি ওজনের ১২ ফুট লম্বা একটি অজগর সাপ, ২টি মেছো বাঘ, একটি গন্ধগকুলসহ বেশ কিছু প্রাণী অবমুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু লাউয়াছড়া তো এই প্রাণীদের জন্য নিরাপদ নয়। ফলে প্রতিনিয়তই লাউয়াছড়ার প্রাণী খাদ্যের সন্ধ্যানে বেড়িয়ে পড়ছে লোকালয়ে। যার বেশিরভাগই মারা পড়ছে মানুষের হাতে।

আলাপকালে প্রখ্যাত প্রাণী সংরক্ষণবিদ সিতেশ রঞ্জন দেব বলেন, শত বছর আগে কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া বনের আয়তন ছিল প্রায় তিনগুন। পর্যায়ক্রমে বনের ভিতরে চা বাগান ও মানুষের বসতি গড়ে ওঠায় কমে আসে লাউয়াছড়ার আয়তন। লাউয়াছড়া পৃথিবীর এমন একটা প্রাকৃতিক বন যেখানে আছে সহস্রাধিক প্রজাতির বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ, নানাজাতের অর্কিড ও জীববৈচিত্র। কিন্তু লাউয়াছড়া আস্তে আস্তে তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। তিনি বলেন, বন বিভাগ ও নিসর্গ প্রকল্পের আওতায় ২০০৪ সালে লাউয়াছড়ার গাছ চুরি প্রতিরোধের জন্য এলাকার কাঠ পাচারের সাথে জড়িত থাকা বিভিন্ন বন মামলার আসামী ৪০ জনকে পাহারাদার নিয়োগ করে।

নিয়োগকৃতদের সম্মানী ভাতাও প্রদান করা হতো। যার ফলে এসব বনদস্যু পাহারাদার হিসেবে নিয়োজিত হয়ে বনের ভিতরে অবাধ যাতায়াতের বৈধতা পেয়ে যায়। তারাই আবারো কাঠ পাচারের সাথে জড়িয়ে পড়ে। গড়ে উঠে শক্তিশালী গাছচোর চক্র। এভাবে গত কয়েক বছরে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে কোটি কোটি টাকার গাছ পাচার করা হয়েছে।

কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গাছ পাচার নিয়ে বন মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ এম.এ শহীদ এম.পি, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অচিরেই লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বন নিধন যজ্ঞ রোধ করা সম্ভব না হলে এবং সরকার বন রক্ষায় এগিয়ে না আসলে দেশের অনান্য চিরহরিৎ বনের মতো লাউয়াছড়াও হয়ে পড়বে নিশ্চিহ্ন। ইসমাইল মাহমুদ মৌলভীবাজার ০১৭১৫১৭১৯৫০ ০১১৯৬১২৮৫১৩

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.