পরাঞ্জয়ী...
কমলাপুর রেলস্টেশন। ধীর পায়ে এগিয়ে চলা। দু'টো মানুষ, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সুনিশ্চিত ভরসা নিয়ে! বুকের ভেতর অস্থির মহাসাগরের তুফান ওঠা ঢেউ, অথচ চোখের গভীরে নির্ভরতার স্পষ্ট দৃঢ় এক অভিব্যক্তি! ১... ২.... ৩, তিনটা সিঁড়ি তারপর পা দেওয়া প্লাটফরমে। ফাস্টফুডের নাম টা মনে নেই। একটা চিপস আর একটা সাফারির প্যাকেট।
আবার নিস্তব্ধ পায়ে হেঁটে চলা। ঐ তো দেখা যায় রেইল লাইন। পর পর পাশাপাশি তিনটা সারি। দ্বীপ নীলা কে দেখায় ট্রেন চলে কিভাবে, কেমন করে ইঞ্জিনওয়ালা বগিটা পাল্টে সামনে নিয়ে লাগানো হয়। নয়ত এত বড় ট্রেন টা ঘুরিয়ে গন্তব্যের দিকে নেয়াটা সম্ভব না! ঢাকা- কিশোরগঞ্জের ট্রেন টা দাঁড়িয়ে আছে "শোভন"।
প্লাট ফরম নাম্বার ৬,৭, চলা থামেনা। প্রথমে এসি তারপর কেবিন। পর্দা টানা। মানিব্যাগের সুস্বাস্থকে পুঁজি করে কেউ কেউ নিছক নিজের সুস্বাস্থ কে পশ্রয় দিতে পর্দার আড়ালে ফুর্তি করে। দুটি মানুষের ত্রস্ত পদক্ষেপ দেখবার সময় নেই তাদের।
জানলার বাইরের কোন দূষিত বাতাস তাদেরকে স্পর্শ করেনা, পর্দা টানা! তারপর শোভন চেয়ার, প্রথম শ্রেনী। গা এলিয়ে খবরের কাগজের বাসি খবরে চোখ বুলাচ্ছে কেউ। কেউ আবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছে এক জোড়া উদাস হংস মিথুন! ওরা হাঁটে, হাঁটতে থাকে! সদ্য প্রয়াত চুলের অভাবে চক চক করা মাথা জানলা গলিয়ে বাইরে বের করে এক মধ্যবয়সী চাচা দেখছে নিলাঞ্জনা কে ঘিরে দ্বীপের অসীম মনোযোগের লোভনীয় দৃশ্য!
এর পর দ্বিতীয় শ্রেনী। সিট গুলো প্রায় খালি। একটা সীটে মাথা নীচু করে বসে আছে ছাই রঙের জিন্স পরা এক যুবক।
পাশে একটা ট্রাভেল ব্যাগ। বাড়ি যাচ্ছে হয়ত। মেয়েবন্ধুকে ফুড কোর্টের গরম কফির স্বাদ পাওয়াতে গিয়ে নিজের ফার্স্ট ক্লাশের স্বাদটা কে জলাঞ্জলী দিয়ে এসেছে। তাই বাবার দেয়া ফার্স্ট ক্লাশের ভাড়াটা কেটে ছেঁটে সেকেন্ড ক্লাশে ঠাঁই নিয়েছে! ঘাসফুল রঙের ঝকমকে জর্জেট শাড়িটা হয়ত বেড়াতে যাওয়ার সময় পরার জন্য অতি যত্নে তুলে রেখেছিল বাঁ পাশের সারিতে বসা মেয়েটা! পরিপাটি করে পরা শাড়িটা আলগোছে বারবার খুলে আসছে বাচ্চাটার যন্ত্রনায়! তিনটি বাচ্চা নিয়ে বসে থাকা মাঝ বয়সী মহিলাটা ঠিকই মনে মনে ভাবে "ভর সন্ধ্যা বেলায় একটা ছেলে একটা মেয়ে স্টেশনে ঘুরছে, লাজ শরম দুনিয়া থেকে বুঝি উঠেই গেল!"
এবার দ্বীপ নীলা কে দেখাল তৃতীয় বিশ্ব! গাদাগাদি করে বসে থাকা কিছু তৃতীয় শ্রেনীর মানুষ! ভাঁজ পড়া অপরিস্কার জামা, কাড়াকাড়ি করে ভাই বোন মিলে মুড়ির মোয়া খাওয়া খুব বেশি হলে লুঙ্গির ভাঁজ থেকে একটা "আকিজ বিড়ি"! ঘাড় সোজা করে বসে থাকতে হবে সমস্ত রাস্তা। হেলান দেবার উপায় নেই।
তবুও এই মানুষ গুলোই ঘুমাবে রাত্রে। ঘোড়ার মত সোজা হয়ে! স্বপ্ন দেখবে হয়ত। এসির ভেতর বসা মানুষ গুলোর ঘুম পাবেনা, কত ভাবনা ওদের "সময় মত পৌছতে পারব তো? ব্যবসার ডিলটা কি হবে?" কেউ কেউ আবার ব্যস্ত থাকবে বন্ধু পত্নীর শারিরীক খোঁজ খবর নিতে, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি তো দামী লেভিসের পকেটেই আছে!
দ্বীপ নীলাঞ্জনা বসে পড়ে। ট্রেনটা চলে ওদের কে পেছনে ছেড়ে। মানুষ গুলো তাকিয়ে দেখে ওদের।
শূন্য প্লাটফরম! নীলা গান গায়, সুর মেলায় দ্বীপও! চিপস এর প্যাকেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় দ্বীপ। পৃথিবীর কাছে ঋণের বোঝা নিয়ে ভেঙ্গে পড়তে পড়তে গিয়ে সোজা হয় নীলা। সাধ্য নেই অথচ বাঁচার স্বাধ ষোল আনা। অভাবী মনটা বারবার খোঁচায় নীষ্ঠুরের মত।
রেইল লাইনটার মতই শূন্যতা দেখে চারদিকে নীলাঞ্জনা।
প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিশ্ব চলে গেছে, পেছনে ফেলে গেছে চতুর্থ বিশ্বের দু'টি মানুষ " দ্বীপ, নীলাঞ্জনা!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।