আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইরাকী বন্দীর আত্মকথা ( ৪র্থ পর্ব )

Right is right, even if everyone is against it; and wrong is wrong, even if everyone is for it

সুপ্রিয় পাঠক , ইরাকী বন্দীর আত্মকথা শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার আজকে পর্বে আমরা মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত এক ইরাকী বন্দী , মার্কিন সেনা এবং তাদের ইসরাইলি সহযোগীদের হাতে কিভাবে ইরাকের ভেতরেই পাশবিক কায়দায় ও নৃশংস পন্থায় নির্যাতিত হচ্ছিলেন, তার আরো কিছু লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা আপনাদের জন্যে উপস্থাপন করবো ৷ ইরাকি ঐ বন্দীর আত্মকথা থেকে জানা যায়, তার ওপর নির্যাতনকারী মার্কিন ও ইসরাইলি সেনারা বিভিন্ন তুচ্ছ অজুহাত দেখিয়ে মানসিক ও শারীরিক ভাবে নির্যাতন চালাতো ৷ শারীরিক নির্যাতনের কারণে ঐ ইরাকী বন্দীর পায়ে দুবার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে ৷ একবার ঐ ইরাকী বন্দীর কাছে একটি টুথপিক আকারের ছোট তার এবং একটা ছোট কাপড়ের টুকরা দেখে মার্কিন ও ইহুদিবাদী সেনারা তাকে এমন অপমানজনকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে, যেন তিনি মার্কিনীদের কোনো কিছু চুরি করেছেন! তারা এ ইরাকী বন্দীকে তথ্য গোপনের জন্যে অভিযুক্ত করে এবং এ অপরাধে তাকে উলঙ্গ করে রাখে৷ উলঙ্গ অবস্থায় তাকে হলের মধ্যে হাঁটতে হয়েছে এ অবস্থায় মার্কিন পুরুষ ও মহিলা কারারক্ষী বা নির্যাতকারীরা তাকে ঠাট্রা বিদ্রুপ করেছে ৷ পরে ঐ ইরাকী বন্দীর কক্ষে আরো অনেক ইরাকী বন্দীকে ঠাসাঠাসি অবস্থায় রাখা হয়, যদিও সেখানে তাদের জন্যে কোনো রকমে বসার স্থান সংগ্রহ করাও ছিল কষ্টকর ৷ এই বন্দীদেরকে বাথরুমে একসাথে গোসল করতে হয় ৷ এমনকি এসব বন্দীদেরকে পরষ্পরের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্যে চাপ দেয়া হয় ৷ বাধ্য হয়ে কোনো কোনো বন্দী, মার্কিন সেনাদের পক্ষ হয়ে গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োজিত হয় ৷ নতুন ইরাকী বন্দীদের কেউ কেউ ঐ ব্যবসায়ী ইরাকী বন্দীকে জানায় যে, মার্কিন সেনাদের নির্যাতনের কঠোরতা থেকে রক্ষা পাবার জন্যে, তারা মার্কিন সেনা কমান্ডের আওতায় ইরাকের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি পাকিস্তান, সৌদি আরব, চেচনিয়া ও আফ্রিকায় দূধর্ষ সন্ত্রাসী অভিযানে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছেন ৷ এসব সন্ত্রাসী হামলা ভালোভাবে সম্পন্ন করতে না পারলে তাদেরকে পুণরায় কারাগারে এনে, মার্কিন সেনারা আগের চেয়েও জঘণ্য পন্থায় নির্যাতন চালায় বলে এই কারাবন্দীরা জানিয়েছে ৷ তারা আরো জানায়, তাদের কাছ থেকে সব ধরনের তথ্য জানার জন্যে মার্কিন সেনারা তথাকথিত মিথ্যা নির্ণয় যন্ত্র নামের একটি ভয়ংকর নিপীড়ক যন্ত্র ব্যবহার করে থাকে৷ এমনকি এ জন্যে তারা বন্দীদেরকে নিদ্রাহীন করে রাখাসহ তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের বিশেষ ইঞ্জেকশানও প্রয়োগ করে৷ মার্কিন সেনারা কথিত মিথ্যা নির্ণয় যন্ত্রের মাধ্যমে ইরাকী বন্দীদের মস্তিষ্কের ওপর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছে৷ তাদেরকে পরীক্ষাগারের ইঁদুরের মতো ব্যবহার করেছে বলেও অনেক বন্দী সন্দেহ প্রকাশ করেছেন৷ ইরাকী বন্দীরা তাদের পরস্পরের কথাবার্তা থেকে মাঝে মধ্যে জানতে পারে যে, আজ কারাগারের অমুক কক্ষে একজন বন্দী মার্কিন সেনাদের নির্যাতনে নিহত হয়েছে, অথবা মার্কিন সেনাদের নৃশংস নির্যাতনে অমুক বন্দীর সাথে বসবাসকারী এক বন্দীর শিরদাঁড়া ভেঙ্গে গেছে অথবা একজন মার্কিন নির্যাতক তার সহর্কর্মীদের বলছেন যে, ওমুকের লাশ সমাহিত কর৷ মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত ঐ ইরাকী বন্দী জানান, এরপর আমাকে দীর্ঘ দিন ধরে একটি নির্জন সেলে রাখা হয় ৷ এবার তারা এ নির্যাতন কক্ষে আমার চোখ বেঁধে রাখে এবং আমার স্ত্রী ও বড় কন্যাকে সেখানে নিয়ে আসে৷ আমার স্ত্রী ও কন্যা আমাকে কিছু সান্ত্বনাদায়ক কথা বলে৷ আমি সন্ত্রাসী নই- এটা প্রমাণিত হলে মার্কিন সেনারা আমার গোটা পরিবারকে বৃটেনে পাঠাবে -এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলেও তারা জানায় ৷ এরপর মার্কিন সেনারা পুনরায় আমার স্ত্রী ও কন্যাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয় ৷ তারপর পুণরায় আমার ওপর নির্যাতন শুরু করে৷ এ সময় মার্কিন ও ইসরাইলি নির্যাতনকারীরা আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখের নীচে পিন ঢুকিয়ে দেয়৷ ফলে আমার হাত রক্তাক্ত হয়ে পড়ে৷ নির্যাতনকারীরা রক্ত বন্ধ করার ও কোনো চেষ্টা করেনি, বরং নখ থেকে রক্ত প্রবাহ কমে আসা শুরু হলে, নখের নীচে বিদ্ধ করা পিনটা অত্যন্ত জোর দিয়ে আবার নাড়াচাড়া করতো৷ এতেও তারা সন্তুষ্ট ছিল না ৷ তারা লাইটার জ্বালিয়ে ঐ পিনটাকে গরম করতো ৷ এ সময় আমি যেভাবে আর্তনাদ করতাম, তা খুব দূর থেকেও শোনা যেত৷ ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, তারা ঐ পিন সরিয়ে নেয়ার পরও আমার মাথা, কাঁধ, শিরদাঁড়া এবং পায়ে অসহনীয় ব্যথা অনুভব করছিলাম ৷ আমি অনেক পরেও ঐ যন্ত্রণার কারণে কান্না থামাতে পারিনি ৷ মার্কিন ও ইসরাইলি নির্যাতকরা এরপর আমাকে একটি হাসপাতালের মতো স্থানে নিয়ে যায় ৷ সেখানে তারা আমাকে একটি রুমে নিয়ে, বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি ইলেকট্রোড স্থাপন করে ৷ সেখানে আমি- তার, মনিটর, মিটার, সূচক প্রভৃতি দেখলাম৷ আমি ভাবলাম ওরা হয়তো বৈদ্যুতিক শক দিয়ে আমাকে মেরে ফেলবে৷ আর তা যদি করে, তাহলে ভালোই হয় বলে আমি মনে মনে ভাবলাম ৷ কারণ, এতে আমি সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব ৷ কিন্তু না, মার্কিন ও ইসরাইলি নির্যাতকরা বললো- দখলদার মার্কিন কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, আমি তাদের সাথে সহযোগিতা করতে সক্ষম এবং আমি যদি তাদের সাথে সহযোগিতা না করি তাহলে তারা তাদের হাতে বন্দী আমার সন্তানও স্ত্রীর নখের ওপর নির্যাতন করাসহ অন্যান্য নির্যাতন করবে, এমনকি তাদের হত্যাও করবে৷ একথা শোনার পরপরই আমি পুণরায় আমার নখে ব্যথা অনুভব করলাম ৷ এ যন্ত্রটা কেন আমাকে হত্যা করলো না তা ভেবে যন্ত্রটার ওপর অভিশাপ দিলাম ৷ স্ত্রী ও সন্তানদের বিপদের ভয়ে ভীত হয়ে পড়া ইরাকের ঐ বন্দী আরো জানান, আমি মার্কিন ও ইসরাইলি নির্যাতনকারী বা গোয়েন্দাদের সাথে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতার অঙ্গীকার করি৷ ওরা আমার মতো আরো কয়েকজন ইরাকী বন্দীকে জানায় যে আমাদেরকে সন্ত্রাসী দলগুলোতে অনুপ্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে এবং আল কায়দার সন্ত্রাসীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে, অথবা আলকায়দার সমমানের সন্ত্রাসী দল গঠন করে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সন্ত্রাসী অভিযান চালাতে হবে৷ মার্কিন নির্যাতনকারী এবং তাদের ইসরাইলি অনুচররা চাইতো আমরা যেন বলি যে, আমরা গুলি চালানো, বোমা ফাটানো, গুপ্ত হত্যা, গোয়েন্দাবৃত্তি ও মার্কিন বিরোধী গ্রুপগুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করার মতো কাজ করতে আগ্রহী৷ এ অবস্থায় আমি এসব কাজে অংশ নিতে আগ্রহী বলে মার্কিন নির্যাতক ও তাদের ইসরাইলি সহযোগীদের জানালাম৷ কারণ, আমি ভেবেছিলাম একমাত্র এভাবেই আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের রক্ষা করতে পারবো ৷ আমার সাথে থাকা অন্য ইরাকী বন্দীদের মধ্যে মাত্র অল্প কয়েক জন এ ধরনের কাজে অংশ নেয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করে ৷ আসলে তাদের এ আচরণ ছিল তোষামোদ মাত্র ৷ ঐ ইরাকী কারাবন্দী আরো বলছিলেন, মার্কিনীদের পরিচালিত ''নীতি-কথা ও প্রশিক্ষণের ক্লাস'' ধীরে ধীরে প্রায় পনেরো জন ইরাকীর ক্লাসে পরিণত হলো ৷ ক্লাসে আমাদেরকে কাগজ কলম দেয়া হতো৷ ইরাকের অন্যান্য কারাগারে মার্কিন সেনাদের হাতে বন্দী হওয়া অনেক ইরাকীও এ ক্লাসে আমার সাথে অংশ নেয় ৷ এ বন্দীদের আনা হয়েছিল তাস ফোরাত, আল রাসাফি, উম্মে ক্বাসদু প্রভৃতি জেলখানা থেকে ৷ ওদের কাছ থেকেই আমি প্রথম বারের মতো জানতে পারি যে, আমি কন্দুর নামক কারাগারের বন্দী৷ আমার সহপাঠি কারাবন্দীরা তালিল, আবু গারিব এবং আসালাহিয়া কারাগার ও বৌগা বন্দী শিবিরের অবস্থাও জানালো৷ ইরাকের এসব কারাগারে বন্দীদের ওপর মার্কিন সেনাদের নৃশংস ও বর্বোরোচিত নির্যাতনের ঘটনা মধ্যযুগের কারাগারগুলোর ঘটনাকেও হার মানায়৷ একজন কারাবন্দী জানান যে, মার্কিন সেনারা তাকে উলঙ্গ করে সারা দিন ধরে তার পিঠে সওয়ার হতো এবং এ অবস্থায় তার গায়ে লাথি মেরে তাকে দ্রুত গতিতে দৌড়াতে বাধ্য করতো৷ একজন মহিলা মার্কিন সেনাও এ কাজে অংশ নিয়েছে বলে ঐ বন্দী জানান৷ অন্য একজন ইরাকী বন্দী জানায়, একজন মার্কিন মহিলা সেনা তার গলায় কুকুরের বেল্ট ও শিকল বেঁধে তাকে টেনে বেড়াতো ৷ ঐ মার্কিন মহিলা সেনাটির হাতের লাঠি দিয়ে তার অথাত্‍ বন্দী ইরাকীর নগ্ন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে আঘাত করতো৷ এতো নিম্ন রুচির মানুষও যে বিশ্বে আছে তা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন বলে ঐ বন্দী মন্তব্য করেন ৷ এভাবে মার্কিন সেনাদের মাধ্যমে চরম অপদস্ত, হতাশ ও ব্যক্তিত্বশূন্য হয়ে আমরা অর্থাত্‍ ইরাকী বন্দীরা তাদের একনিষ্ঠ অনুগত দাস বা ভৃত্যে পরিণত হয়েছিলাম ৷ #

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.