আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইরাকী বন্দীর আত্মকথা (২য় পর্ব )

Right is right, even if everyone is against it; and wrong is wrong, even if everyone is for it

সুপ্রিয় পাঠক, ''ইরাকী বন্দীর আত্মকথা'' শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি ৷ গত পর্বে নির্যাতিত ঐ ইরাকী নাগরিকের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পেরেছিলাম, দখলদার মার্কিন সেনারা বিনা অপরাধে ইরাকের এই ব্যবসায়ীর বাড়ীতে হানা দিয়ে কীভাবে বাড়ীটিতে নির্বিচার গুলি বর্ষণ করে এবং নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ৷ মার্কিন সেনারা এই নিরীহ ইরাকী নাগরিককে ব্যাপক মারধর করে ৷ এমনকি অস্ত্র তাক করে তার স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করে ৷ এরপর তারা এ ইরাকী ব্যবসায়ীকে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তার হাত ও চোখ বেঁধে ট্রাকে তোলে ৷ এক পর্যায়ে মার্কিন সেনারা তার মাথায় প্রবল আঘাত করলে তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়েন ৷ এরপরের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, জ্ঞান ফেরার পর আমি বুঝতে পারছিলাম না ট্রাকটি কোথায় এসেছে ৷ আমরা কি এখনও বাগদাদে আছি, না বাগদাদ ত্যাগ করেছি ? আমার মাথা কালো মোটা কাপড়ে বাঁধা থাকায় আমার জন্যে সব কিছুই অন্ধকার হয়ে পড়ে ৷ আমার হাত দুটো পেছনে ঘোরানো অবস্থায় শক্ত রশি দিয়ে বাঁধা থাকায় সেগুলো বোধ শক্তিহীন হয়ে পড়ে ৷ আমি ঠান্ডা বা গরম কোনোটাই অনুভব করতে পারছিলাম না ৷ আমি অজ্ঞান থাকা অবস্থায়ও আমার হাতগুলো হয়তো আমার শরীরের নীচেই পড়েছিল ৷ অথবা (রশিতে শক্তভাবে বাঁধা থাকায়) হাত দুটোয় রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ৷ যাই হোক, আমি আমার ঘাড়ে তাপ অনুভব করে বুঝতে পারলাম , আরেকটি নতুন দিন শুরু হয়েছে ৷ ওরা যখন আমাকে ট্রাক থেকে নীচে ছুঁড়ে ফেললো, তখন আমি সূর্যের তাপ অনুভব করলাম ৷ এরপর উঠে দাঁড়ালাম ৷ সূর্যের আলো কোন্ দিক থেকে আসছে তাও বুঝতে পারলাম ৷ অনুভব করলাম যে, এখন বেলা দুপুর ৷ বুঝলাম , আমি বারো ঘন্টারও বেশী সময় ধরে অজ্ঞান ছিলাম৷ র্নিযাতিত ঐ ইরাকী নাগরিক আরো বলছিলেন, মার্কিন সেনারা আমার পেন্ট ভেদ করে আমার নিতম্বে ইনজেকশান দিয়েছিল ৷ ইনজেকশানের ব্যথায় আমি ভীষণ অশস্তি বোধ করছিলাম ৷ তবে এ সময় মানুষিক দুর্বলতা এবং আতঙ্কের কথা আমার ব্যথা ও অস্বস্তি ম্লান হয়ে পড়েছিল ৷ যাই হোক, সেই উত্তপ্ত আবহাওয়ায় আধ ঘন্টারও বেশী সময় ধরে অপেক্ষা করার পর, তারা আমাকে একটা করিডোরের মতো স্থানে নিয়ে গেলো এবং এরপর তারা আমাকে একটা সেলে নিয়ে যায় ৷ ঐ সেলে আমি কোনো রকমে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ি ৷ একদিকে প্রচন্ড তৃষ্ণা ,অন্যদিকে টয়লেটে যাবার তাড়া দুটোই আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল ৷ কিন্তু কেউই আমার কথা শুনছিল না বা শুনিলেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছিল না ৷ দুই তিন ঘন্টা পর আমি এক ব্যক্তিকে অত্যন্ত সাবলীলভাবে আরবী বলতে শুনলাম ৷ এই ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার অবস্থা ভালো তো? তোমার কি কিছু লাগবে?" উত্তরে আমার কী প্রয়োজন তা তাকে জানালাম ৷ সে আবার প্রশ্ন করলো, "তারা কি তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে?" "তারা কি তোমাকে মারধোর করেনি?" আমি বললাম, আমি ভীষণ তৃষ্ণার্ত, প্রায় ২০ ঘন্টা পর্যন্ত পানি, খেতে পারিনি ৷ এবং আমাকে শিগগিরই টয়লেটে যেতে হবে ৷ আগে আমাকে টয়লেটে যেতে দাও ,তারপর অন্য কথা ৷ এরপর লোকটি কারারক্ষীর কাছে ইংরেজীতে কী যেন বলে হাসলো ৷ তারপর চলে গেলো ৷ রক্ষীরা আমাকে টয়লেটে নিয়ে গেলো ৷ একমাত্র টয়লেটে নিয়েই তারা আমার হাতের বাঁধ খুলে দেয়৷ এরপর দরজা খুলে দিয়ে ওরা চলে গেলো৷ আমার অবশ হয়ে পড়া হাত নাড়াতে খুব কষ্ট হচ্ছিল৷ তবুও আমি মাথায় লাগানো ব্যাগের বাঁধন ঢিলে করে ব্যাগটা খুলে ফেললাম ৷ করিডোরটা বেশ দীর্ঘ ছিল ৷ করিডোরের সিলিংয়ে লাগানো ছিল খুব কম আলোর একটা বাতি ৷ ঐ আলোতে দেখতে পেলাম দুটো টয়লেট এবং হাত মুখ ধোয়ার একটা বেসিন ৷ আমি কি আগে পানি পান করবো, না আগে টয়লেটে যাব তা নিয়ে দ্বিধান্বিত হলাম ৷ শেষ পর্যন্ত দুই ঢোক পানি খেয়ে আমি টয়লেটের দিকে ছুটলাম ৷ টয়লেট সেরে ইরাকী ঐ বন্দী আরো বলছিলেন, আমি আমার হাত ও মুখ ধুয়ে নেই ৷ এরপর আমি অনেক পানি পান করলাম ৷ কী পরিমাণ পানি যে পান করেছিলাম তা আমার মনে নেই ৷ এরপর বিশালদেহী এক রক্ষী এসে ইংরেজীতে কী যেন বললো, আমি হুবহু অর্থ না বুঝলেও তার ইঙ্গিত ও অঙ্গভঙ্গি থেকে বুঝলাম, আবার ঐ অস্বস্তিকর মোটা কাপড়ের ব্যাগটা দিয়ে আমার মাথা ঢেকে রাখতে হবে ৷ সেলে ফিরে যাবার পথে আমি কিছু লোকের কাশি ও হাঁটার শব্দ শুনতে পেলাম ৷ আমি এটাও বুঝতে পারলাম যে, এখানে আরো কারা- প্রকোষ্ঠ রয়েছে এবং কারাবন্দীরা আমাকে দেখেছে অথবা আমার হাঁটার শব্দ তারা শুনতে পেয়েছে ৷ কারারক্ষী আবার আমাকে সেলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল এবং সেলের ঢেউ টিনের মতো লোহার দরজাটা বন্ধ করে দিলো ৷ আমার হাতগুলো মুক্ত থাকায় হাত ও দাঁত ব্যবহার করে আমি মাথার কালো রংয়ের ব্যাগের যে অংশটা নাকের সামনে ছিল তাতে একটা ছিদ্র করলাম, যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে নিঃশ্বাস নেয়া যায় ৷ যখনই আমি কারা রক্ষীর পায়ের আওয়াজ শুনতাম , তখনই আমি ব্যাগ ঘুরিয়ে নিতাম যাতে ছিদ্রটা মাথার পেছনের চুলের কারণে বোঝা না যায় ৷ এরপর ওরা আমার সেলে একটা গামলা বা পাত্র রাখলো বলে মনে হলো ৷ আমার মনে হলো সেগুলো খাবার ৷ কিন্তু নিশ্চিত হবার জন্যে আমি আমার মাথা ঢেকে রাখা ব্যাগটা আবার খুললাম এবং দেখলাম সেখানে আসলেই খাবার রয়েছে ৷ খাবার দেখে আমার ক্ষিদে যেন অসহনী রকম বেড়ে গেল ৷ ঐ খাদ্য খাবার জন্যে আমি মাথার ব্যাগটা পুরোপুরি খুলে ফেলতে দ্বিধা করতাম না, কিন্তু কারারক্ষীরা আমায় বুঝিয়ে দিলো যে মাথায় ব্যাগ রেখেই অন্ধের মতো খেতে হবে ৷ অর্থাত্‍ মাথার ব্যাগ খোলা নিষিদ্ধ! অবশ্য কিছুক্ষণ পর এক প্রহরী এসে পুরো মাথা ঢেকে রাখা ঐ কালো মোটা কাপড়ের ব্যাগটির সামনের দিক থেকে আমার মুখ বরাবর একটা আধুলি বা পয়সার সমান পরিমান অংশ (ব্যাগ থেকে) কেটে নিল৷এরপর ওরা আমার হাতে খাবারের বাটি দিয়ে কিছু কথা বলে চলে গেল৷ সরাসরি তাদের কথার অর্থ বুঝলাম না ৷ কিন্তু ধরে নিলাম যে, মাথার ব্যাগ না খোলার ব্যাপারে ওরা আমাকে সাবধান করে দিয়েছে ৷ মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত ঐ ইরাকী নাগরিক আরো বলছিলেন, আমি ওই ছিদ্র দিয়ে খাবারের দিকে তাকালাম ৷ মনে হলো খুব মজাদার খাবার৷ কিন্তু খেতে গিয়ে খাবারটা কিছুটা লবনাক্ত মনে হলো ৷ আমি পানি দেয়ার জন্যে কারারক্ষীদের ডেকে পানি খেতে চাই- এমন ইশারা বা অঙ্গভঙ্গি করে তাদের বুঝালাম ৷ কিন্তু কারারক্ষী বা প্রহরীদের কথা শুনে , বিশেষ করে তাদের বিদ্রুপের ভঙ্গি দেখে বুঝলাম ওরা আমাকে পানি পান করতে দেবে না ৷ আমি কিছুক্ষণ আমার পরিবারের কথা ভাবলাম ৷ তাদের ব্যাপারে ভয়ানকভাবে উদ্বিগ্ন ছিলাম ৷ আমাকে একটু পানি দিতে ওদের আবার অনুরোধ করলাম এবং আবার টয়লেটে যেতে চাইলাম ৷ ওরা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো যে , আমাকে পানি দেয়া হবে না ৷ অবশ্য ওরা আমাকে নোংরা ও দূর্গন্ধময় পট বা পাত্র দিল যাতে আমি প্রাকৃতিক কর্ম সম্পন্ন করতে পারি৷ এরপর মধ্যরাতের নীরব নিস্তব্ধতার মাঝে আমি আমার ঢেকে রাখা মাথার ব্যাগটা খুলে ফেললাম ৷ সুপ্রিয় পাঠক মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত একজন নিরীহ ইরাকীর অভিজ্ঞতার কথা শুনলেন ৷ আগামী পর্বে ঐ ইরাকী বন্দীর ওপর মার্কিন সেনাদের লোমহর্ষক নির্যাতনের আরো কিছু ঘটনা আপনাদের মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করবো ৷ #

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.