আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইরাকী বন্দীর আত্মকথা ( ১ম পর্ব )

Right is right, even if everyone is against it; and wrong is wrong, even if everyone is for it

মার্কিন পাশবিকতার শিকার এক নিরীহ ইরাকী নাগরিক তার মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন, আমি জানতে পেরেছিলাম, দখলদার মার্কিন সেনারা আমার বাড়ীর কাছেই বিভিন্ন বাড়ী ঘরে তল্লাশী চালাচ্ছে, নিরীহ লোকজনকে পাইকারী হারে গ্রেফতার করছে, অনেককে হত্যা করছে ৷ আমার বাড়ীটার অবস্থান একটা সংকীর্ণ গলির মাঝখানে৷ আমি জানতাম এ মহল্লার কেউ কেউ সশস্ত্র এবং তাঁরা আগ্রাসীদের ওপর হামলার জন্যে ওঁত্‍ পেতে আছে৷ এদের একজনকে আমি ভালোভাবেই চিনতাম ৷ সে ছিল আগ্রাসন বিরোধী যোদ্ধা৷ সে নিজেই বলতো, আমি দুজন দখলদার সেনাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছি৷ কিন্তু আমি একজন সাধারণ ব্যবসায়ী ৷ আমি মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দিতে অস্বীকার করেছিলাম৷ তাই আশা করছিলাম যে আমেরিকানরা হয়তো আমাকে ধরবে না ৷ আমার সন্তানরা খুবই ছোট হওয়ায় তারা যুদ্ধ করার উপযুক্ত ছিল না ৷ আমার বারো বছর বয়সের এবং ৬ বছর বয়সের সদ্য স্কুলগামী কন্যা আমেরিকানদের জন্যে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখতো না৷ আমার তৃতীয় সন্তানের বয়স মাত্র চার বছর ৷ আমার স্ত্রীও ছিল যুবতী ৷ তাই নিজেকে সামলে নেয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা তার ছিল না ৷ মার্কিনীরা গণহত্যা শুরু করেছে এটা শুনেই সে ভেঙ্গে পড়বে আমি এ আশঙ্কা করছিলাম ৷ ঐ নিরীহ ইরাকী নাগরিক বলছিলেন, গোলাগুলি শুনেই আমার স্ত্রী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো ৷ এমনকি সে অস্ত্র শস্ত্রের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারতো না ৷ একদিন যুবক বয়সী আমাদের এক আত্মীয় তার অতিরিক্ত কিছু অস্ত্র লুকানোর জন্য আমাদের বাসায় আশ্রয় নিলে আমার স্ত্রী ভয়ে কাঁপতে শুরু করে ৷ এমনকি সে ঐ অস্ত্রগুলোর দিকে তাকাতেও চায়নি ৷ তাই, আমি অস্ত্রগুলো আমার বাসায় গোপন করতে দিলাম না ৷ প্রথমতঃ আমার স্ত্রী ভীত সন্ত্রস্ত থাকুক তা আমি চাইনি ৷ দ্বিতীয়তঃ আমি নিজেও এ ধরনের বিপদের মধ্যে জড়াতে চাচ্ছিলাম না ৷ যুবকটি আমাদের ঘরে আশ্রয় নেয়ায় মার্কিন সেনারাও আমাদের বাড়ীতে চলে এলো৷ ঐ নিরীহ ইরাকী নাগরিক বলছিলেন, আমাদের পরিবারের কেউ কখনো মার্কিন সেনাদের দেখেনি ৷ আমরা কখনও ভাবিনি যে আমাদের বাড়ীর ওপর মার্কিন সেনাদের হামলা এতো ধ্বংসাত্মক ও ভয়াবহ হবে ৷ সেই ভয়াল রাতে দখলদার মার্কিন সেনারা লাথি মেরে আমাদের বাড়ীর প্রধান গেইট ভেঙ্গে ফেলে এবং পুরোপুরি যুদ্ধ করার ভঙ্গি নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে ৷ অগ্রবর্তি মার্কিন সেনাদের কভার দেয়ার জন্যে কেউ কেউ মেঝেতে বসে সাবমেশিনগানের গুলি ছুঁড়তে থাকে এবং এরপর তারা তাদের প্রথম গ্রুপের পথ নিরাপদ করার জন্যে হাঁটু গেড়ে বসে গুলি চালাতে থাকে ৷ এরপর ওরা উঠান পেরিয়ে বারান্দায় পৌঁছে ৷ আমি ও আমার স্ত্রী বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে ঘরের এক কোনে জড়সড় হয়ে থাকলাম যাতে গোলাগুলীতে আহত না হই কিংবা ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো গায়ে এসে না পড়ে৷ কাঁচের টুকরোগুলো এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছিল ৷ গুলি চালানো অব্যাহত রেখে তারা ঠিক যেভাবে প্রধান ফটক বা গেইট ভেঙ্গেছিল, সেই একই পদ্ধতিতে আমাদের কক্ষের দরজাও ভেঙ্গে ফেললো ৷ প্রথমে দুজন মার্কিন সেনা ভেতরে ঢুকলো ৷ এরপর আরো তিনজন তাদের সাথে যোগ দিল ৷ আমি নিশ্চিত যে তারা আমাদের ঠিকই দেখেছিল ৷ এ অবস্থায় মার্কিন সেনাদের একজন একটি বিশেষ সংকেত দিল ৷ সাথে সাথে অন্য সেনারা নির্বিচার গুলি চালাতে শুরু করলো ৷ গুলিতে বাড়ীর দেয়ালগুলোসহ দরজা এবং রান্নাঘরের আসবাবপত্রসহ আরো অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গেল ৷ রেফ্রিজারেটর, ওভেন, টেবিল ও চেয়ারগুলোকে চেনার উপায় রইলো না ৷ সাব মেশিনগান দিয়ে তারা যে কী পরিমান কতো গুলি ছুঁড়েছিল তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে ৷ ওদের গুলিতে দেয়ালের প্রায় সমস্ত প্লাষ্টার ঝরে পড়েছিল৷ মার্কিন সেনাদের পাশবিকতার শিকার ইরাকের ঐ নিরীহ নাগরিক বলছিলেন, এরপর চারদিকেই কবরস্থানের নিস্তব্ধতার মতো হঠাত্‍ এক ভয়ানক নীরবতা নেমে এল ৷ মনে হলো, কেউ যেন যুদ্ধ বিরতির নির্দেশ দিয়েছেন ৷ আমি এবং আমার পরিবার এত নীরব ছিলাম যে, আমরা বোধ হয় তখন নিঃশ্বাসও নেই নি ৷ ঐ ইরাকী নাগরিক আরো বলেছেন, যে মার্কিন সেনাটি গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল, সে যেন হঠাত্‍ হতভম্ব হয়ে পড়লো ৷ সে এমন একটা ভাব দেখালো যেন সে এইমাত্র আমাদের দেখতে পেয়েছে ৷ সে আমাদের দিকে ছুটে এলো ৷ প্রথমে সাবমেশিনগানের পাইপ দিয়ে এবং পরে রাইফেল দিয়ে আঘাত করে আমাদের কি যেন বললো, বুঝে উঠতে পারলাম না ৷ কয়েকটা তীব্র আঘাত পাওয়ার পর আমরা বুঝতে পারি যে তারা আমাদেরকে হাত উঁচু করে বেরিয়ে আসতে বলছে ৷ আমার স্ত্রী নিজেকে সামলাতে পারায় আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম ৷ কারণ, আমি ভেবেছিলাম ঐ অবস্থায় সে নিশ্চই অজ্ঞান হয়ে পড়বে ৷ সে আমার পিছে পিছে বেডরুম থেকে সন্তানদের নিয়ে বের হল৷ একজন মার্কিন সেনা দরজার পেছনে দাঁড়িয়েছিল ৷ তাদের দুজন বারান্দায় অবস্থান নেয় আর মূল গেইটের কাছে ছিল চারজন মার্কিন সেনা ৷ এরপর ওদের কমান্ডারের নির্দেশে আমার মাথায় মোটা কাপড় বা ক্যানভাসের ব্যাগ পরানো হলো ৷ এভাবে ওরা আমার চোখ বেঁধে ফেললো, এর প্রয়োজন ছিল না যদিও ৷ কারণ আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে তাকিয়ে থাকলেও ওদেরকে চিনতে পারতাম না ৷ কেননা, ওদের সবার মাথায় ছিল হেলমেট, চোখে ছিল কালো চশমা এবং পরনে ছিল খুব পুরু পোশাক আর নিশ্চই বুলেট প্রুফ জ্যাকেটও ছিল৷ ওরা যখন খুব রুক্ষ্ম ও কর্কশ ভঙ্গীতে আমাদের তাড়িয়ে নিচ্ছিল তখনই বুঝতে পেরেছিলাম মার্কিন সেনারা আমাদের বন্দী করতে চাইছে ৷ ঐ নিরীহ ইরাকী নাগরিক আরো বলছিলেন, যখন আমরা উঠানে আসলাম তখন পরিস্থিতি আরো খারাপ হলো ৷ মার্কিন সেনাদের লাথি আর রাইফেলের উপুর্যপরি আঘাত খেতে খেতে আমরা একটু একটু করে এগুচ্ছিলাম ৷ কিন্তু চোখ বাঁধা অবস্থায় একসময় মনোযোগ হারিয়ে ফেললাম ৷ ফলে ওরা যেদিকে যেতে বললো সেদিকে না যাওয়ায় আরো তীব্র লাথি-গুতো ও ধমক খেতে হলো ৷ আমার স্ত্রী শান্তভাবে কাঁদছিল, আমার বড় মেয়েও প্রায় নীরবে কাঁদছিল ৷ কিন্তু আমি স্পষ্টভাবে আমার ছোট্র দুই শিশুর ভয়ার্ত কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম ৷ গলির মাঝখান পর্যন্ত যাবার পর আমি আর আমার সন্তানদের কান্না শুনতে পেলাম না ৷ আমি ভাবছিলাম যে তারাও আমার পিছে পিছে আসছে৷ কিন্তু কিছু সময় পার হবার পর বুঝলাম, আমার চার বছরের ছেলেটির কান্নার শব্দ দূর থেকে ভেসে আসছে ৷ আমি যেই একটু থেমে তাদের কন্ঠস্বর শোনার চেষ্টা করলাম, অমনি মার্কিন সেনারা আবার নির্দয়ভাবে আমাকে পেটাতে লাগলো ৷ বাড়ী থেকে বের হবার পর থেকেই দখলদার মার্কিন সেনারা উচ্চ স্বরে কিছু না বলার চেষ্টা করছিল ৷ তবুও তাদের কথা বার্তা শুনে আমি বুঝলাম যে আমরা গলির শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি ৷ ঐ নিরীহ ইরাকী নাগরিক আরো বলছিলেন, আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা ধাতব বেড়া বা সেরকম কিছুতে ধাক্কা খেলাম ৷ স্পর্শ করে বুঝলাম যে আমি একটা সামরিক ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়েছি ৷ দখলদার সেনারা আমাকে ট্রাকের ওপর উঠতে বাধ্য করলো ৷ আমি যখন ঊঠছিলাম তখন ওরা আমাকে নিচু হবার জন্যে ঘাড়ে চাপ দিলো ৷ আর তাতে আমি বুঝলাম ট্রাকের ছাদ রয়েছে এবং আমার মাথা ট্রাকের ছাদে যাতে না লাগে সে জন্যেই হয়তো ওরা আমার ঘাড়ে চাপ দিয়েছে ৷ কিন্তু যখন চারটি শক্তিশালী হাত আমার ঘাড়ে প্রবল চাপ দিল, তখন বুঝলাম যে ওরা আমাকে হাঁটু গেড়ে বসতে বলছে৷ ঐ চারটি হাত আমার হাত দুটিকে পেছনে টেনে ঘুরিয়ে নিল এবং খুব ধারালো তার বা রশি দিয়ে আমার হাত দুটো বেঁধে ফেললো ৷ হঠাত্‍ আমার মাথার পেছনের দিকে একটা প্রচন্ড আঘাত করা হলো ৷ আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম ৷ #

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.