আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইরাকী বন্দীর আত্মকথা (৩য় পর্ব )

Right is right, even if everyone is against it; and wrong is wrong, even if everyone is for it

সুপ্রিয় পাঠক, 'ইরাকী বন্দীর আত্মকথা' শীর্ষক ধারাবাহিক এ আলোচনায় মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত এক ইরাকীর কারাজীবনের চাঞ্চল্যকর ঘটনাবলী শুনছিলেন তারি নিজস্ব জবানীতে ৷ গত পর্বে আপনারা নির্যাতনের সর্বশেষ বর্ণনায় শুনেছেন যে, বহু অনুরোধের পরও কারারক্ষীরা তাকে একটু পানি খেতে দেয়নি, টয়লেটে যেতে চাইলে তারা দুর্গন্ধময় একটা পাত্র এনে দিয়েছিল ৷ মধ্যরাতের নিস্তব্ধতার মাঝে ইরাকী বন্ধী তার মাথার ব্যাগটা খুলে ফেলেছিল ৷ এরপর যা ঘটলো তা আরো বীভত্সা ৷ মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, পরদিন সকাল বেলা আমাকে মাটির নীচের একটি ভয়ানক স্থানে নিয়ে যায়৷ সেখানে তিনটি লোক আমাকে জেরা করে ৷ তাদের মধ্যে দুজন খুব স্বাচ্ছন্দ্যে বা অনর্গলভাবে আরবী ভাষায় কথা বলছিল ৷ কিন্তু ওদের হিব্রু টান থেকে আমি বুঝতে পেরেছি যে, ওরা ইসরাইলি ৷ তারা আরবীতে কি নির্দেশ দিয়েছিল তা আমি খুব সহজেই বুঝতে পেরেছিলাম৷ তাদের তৃতীয় জন ছিল যেমনি শক্তিশালী দেহের অধিকারী, তেমনি কুত্সিঝত এবং হিংস্র ৷ তাকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল যে, সে তাদের অনুগত লোক এবং নির্যাতনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ইরাকী ঐ বন্দী বললেন, হ্যাঁ, আমার অনুমান ঠিকই হয়েছিল ৷ সে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় দ্বিধাহীনভাবে , বেশ দক্ষতার সাথে আমার ওপর নির্যাতন চালায় ৷ এতো নির্বিকারভাবে সে নির্যাতন চালাচ্ছিল যেন সে ঝাড়ু দেয়া বা কাঠ কাটার মতো কোনো স্বাভাবিক কাজ করছে ৷ লোকটা অনায়াসে আমার পা দুটো তার হাতে তুলে নেয় ৷ এরপর আমাকে উপরে তুলে সেখানে জমিয়ে রাখা যন্ত্রপাতির মধ্যে আমাকে ঝুলিয়ে দেয় ৷ ওপরে ঝোলানোর পর সে নির্দয়ভাবে চাবুক দিয়ে আমার ওপর আঘাত করতে থাকে ৷ ঝোলানো অবস্থায় আমার মাথা ও কাঁধ ছিলো নীচের দিকে এবং পা দুটো ছিল ওপরের দিকে ৷ ব্যথা ও যন্ত্রণায় আমি মারাত্মক কষ্ট পাচ্ছিলাম ৷ মারের চোটে আমি চিত্কাোর করে উঠতাম ৷ ওরা যে আমার কাছ থেকে কি জানতে চাইতো তা আমি জানতাম না ৷ সত্যি বলতে কি ঐ ভয়াবহ অবস্থায় ওরা যে ব্যাপারেই জানতে চাইতো, আমি সে ব্যাপারেই তথ্য দিতে প্রস্তুত ছিলাম৷ কিন্তু ঐ জালেমগুলো আমাকে এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করছিল যেসব বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না ৷ ওরা জিজ্ঞাসা করছিল,"বিস্ফোরকগুলো কোথায়? অস্ত্রগুলো কোথায়? কোন্ কোন্ অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রেখেছিস? বিস্ফোরকগুলোর চাবি বা ডিটোনেটরগুলো কোথায়? মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত ঐ ইরাকী বন্দী আরো বলছিলেন, কুত্সিনত ঐ ইসরাইলি লোকটা আমার পা দুটোর ওপর এক নাগাড়ে পেটাতে থাকে ৷ আর অন্য দুজন আমার কাঁধে, কাঁধের নীচে এবং নিতম্বে এমন ভীষণভাবে লাথি মেরেছিল যে প্রচন্ড ব্যথায় সর্বাঙ্গ টনটন করছিল দীর্ঘক্ষণ ধরে ওরা আমার ওপর এভাবে নির্যাতন চালিয়েছিল৷ আমার তখন শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল৷ কষ্টের জ্বালায় আমি আর্তনাদ করছিলাম৷ তখন মনে প্রাণে আশা করছিলাম যে ওদের লাথিগুলো আমার শরীরের সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে এসে পড়ুক, যাতে মৃত্যু এসে আমার সমস্ত দুঃখ ও বেদনার অবসান ঘটাতে পারে ৷ কিন্তু আমি কি চাইছিলাম তা ঐ বেজন্মা বদমায়েশগুলো বুঝে ফেলে ৷ ওরা তাই এরপর থেকে শুধু আমার হাঁটু ও পায়ে আঘাত করতে থাকে৷ আমার পা'গুলো কিভাবে তখনও টিকেছিল তা ভেবে অবাক হচ্ছিলাম ৷ কোন্ দিক থেকে ওরা লাথি মারছে, তা সনাক্ত করে আমি আমার মাথাকে সেদিকে এগিয়ে দিচ্ছিলাম ৷ কিন্তু পেশাদার এবং অভিজ্ঞ ইসরাইলি নির্যাতনকারীরা এবারও আমার উদ্দেশ্য বুঝে ফেলে! এবার ওরা নির্যাতন বন্ধ করলো এবং আমাকে দৌড় দিতে বাধ্য করলো ৷ ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, আমার পা'গুলো অবশ হয়ে পড়েছিল ৷ এতোটা অচেতন যে আমার পায়ে জুতো আছে না কি নেই, খালি পায়ে দৌড়াচ্ছি না স্পঞ্জ আছে তাও বুঝতে পারছিলাম না ৷ এরপর ইসরাইলি নির্যাতকরা আবার আমাকে আমার কারাকক্ষে নিয়ে গেলো ৷ আর কোনো প্রশ্ন করলো না ৷ এবার ওরা আমার মাথা ঢেকে রাখা কালো অভিশপ্ত ব্যাগটা নিয়ে চলে যায় ৷ আমার চোখগুলো অবসন্ন ও ঘোলাটে হয়ে পড়ায় কিছুই ঠিকমত দেখতে পারছিলাম না ৷ আমি চোখগুলোকে বন্ধ করলাম এবং কান্না শুরু করে দুঃখের বোঝা হাল্কা করার চেষ্টা করলাম ৷ কিন্তু কারারক্ষী এমন বিকট চিত্কারর দিয়ে আমাকে ধমক দিলো যে আমি কান্না থামাতে বাধ্য হলাম৷ কিছুক্ষণ পর একজন বেঁটে আমেরিকান সেনা আমার কক্ষে আসলো ৷ তাকে দেখে দয়ালু মনে হলো৷ সে তার দিয়ে বাঁধা আমার হাত দুটোর কাছে এল এবং তারটা কেটে দিল৷ এরপর ঐ মার্কিন সেনা বিদ্রুপের হাঁসি হেঁসে কি যেন বলে চলে গেলো ৷ মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, এবার আমার নজর পড়লো নিজের পা দুটোর দিকে ৷ এই প্রথমবারের মতো আমি আমার ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত পা'গুলো দেখলাম৷ পা'গুলো ফুলে যেন ফুটবলে পরিণত হয়েছে৷ প্রথমে আমি ভাবলাম আমার পায়ের পাতার কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই৷ সেখানে কোনো চামড়া, গোশত এমনকি কোনো হাঁড়ও নেই বলে মনে হলো৷ কিন্তু নির্যাতকরা ছিল এতো দক্ষ যে, আমার ক্ষত স্থানগুলো খুব গভীর না হলেও সেগুলো খুবই ফুলে উঠেছিল এবং যন্ত্রণা দিচ্ছিল ৷ আমার মনে হলো, খুব শিগগিরই পায়ের ক্ষতগুলো ভালো হয়ে যাবে ,এটা ভাবতেই আমার মনোবল বেড়ে গেলো৷ কিন্তু এরপরই আমার মধ্যে আবার চরম হতাশাবোধ সৃষ্টি হলো৷ আমি আমার পরিবার ও আমার বন্দীত্বের কারণ এবং এ সংক্রান্ত পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম৷ আমি যতই এ নিয়ে ভাবতে লাগলাম ততই নিজের ও পরিবারের সদস্যদের বন্দীত্বের কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না৷ ফলে আমি মনে মনে আরো ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে উঠলাম৷ কিন্তু হায়! এখানে এ নিয়ে আলোচনা করার মতোও কেউ নেই! ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, মার্কিন সেনারা যেভাবে আমার পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতার করেছে এবং যে ভয়াবহভাবে ইসরাইলি নির্যাতকের মাধ্যমে আমার ওপর নির্যাতন চালিয়েছে তাতে আমার ভয় বেড়ে যায়৷ আমি ভাবতে লাগলাম, ওরা কি চায়? ওরা জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনের সময় ফালতু বা অর্থহীন প্রশ্ন করছিল এবং আমার উত্তর শোনার জন্যে ওদের মধ্যে কোনো আগ্রহ ছিল না৷ আর এ থেকে আমি বুঝতে পারলাম এসব প্রশ্ন তাদের জন্যে মোটেও জরুরী ছিল না৷ মার্কিন সেনারা যেভাবে আমাকে শারীরিক কষ্ট দিচ্ছিল ঠিক সেভাবেই আমাকে জ্বালাতনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করছিল৷ অর্থাত্‍ এসব বাহ্যিক আচরণের পেছনে মার্কিনীদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল৷ কিন্তু কি সে উদ্দেশ্য? তারা দুই দফায় আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং দুই বার আমার ওপর ভয়ানক নির্যাতন চালিয়েছে৷ কিন্তু মার্কিন সেনারা আমার কাছে কি চাচ্ছে তা তখনও আমি বুঝতে পারিনি৷ ওদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমি জানলাম যে, ওরা আমার নাম, পেশা এবং আমার পরিবার সম্পর্কেও সব কিছু জানে৷ এমনকি ওরা আমার এবং আমার আত্মীয় স্বজনদের নৈতিক গুণগুলো সম্পর্কেও অবহিত! কতগুলো গুরুত্বহীন বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্যে ওরা ওদের এতো শ্রম ও সময় নষ্ট করছে দেখে আমি অবাক হলাম৷ মার্কিন সেনাদের হাতে নির্যাতিত ঐ ইরাকী বন্দী বলছিলেন, মার্কিন সেনা ও তাদের ইসরাইলি নির্যাতকরা জানতো আমি ৩৮ বছর বয়স্ক একজন ব্যবসায়ী এবং আমি সুঠাম দেহের অধিকারী একজন সৌখিন ক্রিড়াবিদ৷ একজন বিনয়ী ও সুবিবেচক মানুষ হিসেবেও আমার খ্যাতি রয়েছে৷ আর এ কারণে অনেক মানুষের সাথে আমার যোগাযোগ আছে৷ মার্কিন সেনা ও তাদের ইসরাইলি সহযোগীরা নিশ্চয়ই এটাও জানতো যে রাজনীতিতে আমার কোনো আগ্রহ নেই৷ এমনকি আমি সাদ্দামের শাসনামলে কিংবা ইরাকে মার্কিন সেনাদের হামলার পরও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কখনো জড়িত হইনি৷ তারা এটাও জানতো আমি একজন সংসারী মানুষ এবং আমি আমার পরিবারের চাহিদা ও স্বপ্নগুলো পূরণের জন্যে জীবন বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত৷ এ কারণে ওরা যখন আমাকে নির্যাতন কক্ষের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তারা একটি বিশেষ কক্ষের সামনে দিয়ে আমাকে খুব ধীর গতিতে এগুতে দিচ্ছিল, যাতে আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের ফরিয়াদ এবং কান্নার শব্দ শুনতে পাই৷ ওদের কান্না ও আহাজারির শব্দ আমাকে এতোটা উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কিত করেছিল যে এর তুলনায় অন্য যে কোনো ধরনের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন আমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়েছে ৷ ঐ ইরাকী বন্দী আরো বলছিলেন, আমার নির্যাতকরা আমার হাত ও চোখ না বেঁধেই আমার ওপর চাবুকের কষাঘাত করে যাচ্ছিল ৷ ফালতু প্রশ্ন না করার আবেদন জানানো সত্ত্বেও তারা আমাকে অর্থহীন প্রশ্ন করা অব্যাহত রাখে, যদিও তারা নিজেরাই জানতো যে আমার কাছে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই ৷ একদিন মার্কিন ও ইসরাইলি নির্যাতকরা আমার মাথা ও মুখে বেল্ট দিয়ে আঘাত করছিল ৷ হঠাত্‍ ওদের বেল্ট আমার চোখে আঘাত হানে এবং সেখান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে ৷ আমার জামা চোখের পানিতে সিক্ত ও রক্তে রঞ্জিত হলো ৷ কিন্তু আমি এতো শোচনীয় অবস্থায় ছিলাম যে অন্ধত্বের ব্যাপারেও চিন্তিত হইনি ৷ সেদিন সন্ধ্যায়ও যখন আমার চোখ থেকে রক্তপাত বন্ধ হচ্ছিল না তখন আমাকে একটা অস্থায়ী হাসপাতালে নেয়া হয়৷ আমার ডান চোখের আইবল বা অক্ষিগোলক নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেটা অপসারণের জন্যে তারা হাসপাতালে আমার চিকিত্সাগ শুরু করে এবং আমার ওপর নির্যাতন বন্ধ করে ৷ আমাকে অন্ধ করার অনুশোচনায়, নাকি আমি তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তারা আমার চিকিত্সাম করেছিল বুঝে উঠতে পারিনি! #

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.