এডিট করুন
এখন ০ নাম্বারটা। পরে ১ নাম্বারটা।
এখন আমি রেলষ্টেশনে। কিশালয় আর ইমরুলের অপেক্ষা করছি। ওরা আমার দুই বন্ধু।
আমরা তিনজন প্রথম বছর একসাথে ছিলাম। তাই একজনের উপর আরেকজনের মায়া পড়ে গেছে। বহুদিন কাগজে কলমে বাংলা লিখিনা। প্রায় তিন বছর হল বাংলা লিখিনি। হাতে জড়তা ধরে গেছে।
সামান্য ব্যাথা করছে। এইমাত্র কিশালয় আসল।
ওর সাথে কথা বললাম। ও আগামী মাসের দশ তারিখের দিকে দেশে যাবে। কিছুক্ষণ পর ইমরুল এল।
আমরা তিনজন কথা বার্তা বললাম, আলাপ করলাম। অতঃপর আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসছে। আমি ১৫ নং ওয়াগনে সিট পেয়েছি। একেবারে শেষ ওয়াগন।
দুই বন্ধুর সাথে কোলাকুলি করে ওয়াগনে ঢুকে গেলাম। ওরা তখনো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওয়াগনের জানালা থেকে ওদের লক্ষ্য করে হাত নাড়ছি। ওরা আমাকে দেখতে পায়নি। আমি পকেট থেকে মোবাইল বের করে ইমরুলকে ফোন দিলাম।
বললাম তোদের সামনে ওয়াগনের যে জানালাটা আছে সেটার দিকে তাকিয়ে দেখ। ওরা দেখল। আমি হাত নাড়ছি, ওরাও হাত নাড়ছে। মোবাইলে আবার বিদায় বললাম। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।
আমি হাত নাড়ছি, ওরাও হাত নাড়ছে। ট্রেন দূরে চলে যেতে লাগল আমাকে নিয়ে ওদের কাছ থেকে। ওরা শেষ পর্যন্ত হাত নেড়ে বিদায় নিল। আমি আমার সিটে এসে বসলাম। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।
আমার পাশের সিটে একজন রুশ বসেছে। আমি বাংলায় লিখছি আর সে চেয়ে চেয়ে দেখছে। তার কাছে অদ্ভুত লাগছে আমার লেখা। আমার বাংলা হাতের লেখা স্মরণকালের জঘন্য রুপ নিয়েছে।
এখন গ্রীষ্মকাল।
সেইন্ট পিটার্সবার্গের আকাশে প্রায় রাত বারোটা পর্যন্ত সূর্য থাকে। ধীরে ধীরে সূর্যের অবস্থানকাল আরো বাড়বে। একসময় প্রায় ২৪ ঘন্টা দিন হবে। রাত নয়টা চল্লিশ বাজে প্রায়। কিন্তু এখনও বিকেলের মত আলো চারপাশে।
ট্রেনের জানালা দিয়ে আলো আসছে। রেল লাইনের দুপাশ ধরে ঘন সবুজ বন। প্রচুর গাছ। কিন্তু একটানা দেখতে দেখতে ক্লান্ত লাগে। কারণ কোন বৈচিত্র নেই।
সব গাছ একরকম। মনে হচ্ছে ঘন বনের ভেতর দিয়ে রেল লাইন তৈরী করা হয়েছে।
একঘেয়ে প্রকৃতি দেখতে আর ভাল লাগছে না। আগামীকাল সকাল ৪.৩০ এ ট্রেন মস্কো পৌছবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ট্রেনের কর্মীরা মাঝে মাঝে এসে ওয়াগনের মাঝখান দিয়ে হেটে যাচ্ছে আর বলছে, “কেউ কি প্লাস কার্তায় যাবেন”? আমাদের ওয়াগনটায় বসে ভ্রমণ করতে হয়। আর প্লাস কার্তায় গেলে শুয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া যায়। এর জন্য এখন কেউ অতিরিক্ত কিছু টাকা দিলে তাকে প্লাস কার্তার সুবিধা মানে শুয়ে যাওয়া যায় এমন কোন ওয়াগনে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। এইমাত্র আবার একজন এসে “চা বা কফি লাগবে নাকি” বলে হেটে গেল। আমার প্লাস কার্তা বা চা-কফি কোনটারই দরকার নেই।
বসে যাওয়াতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করছি।
বন শেষ হয়েছে। এখন রেল লাইনের দু’পাশে ইতিস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু বাড়ী দেখা যাচ্ছে। এই বাড়ীগুলো একতলা। এগুলো প্রকৃতপক্ষে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য তৈরী।
এই বাড়ীগুলোকে “দাচা” বলা হয়। “দাচা” মানে কুঁড়েঘর। সাধারণত কাঠ দিয়ে তৈরী হয় বাড়ীগুলো। “দাচা” এলাকা শেষ হয়ে গেছে। এখন আবার ঘন বন আর মাঝে মাঝে খোলা মাঠ রেল লাইনের দুপাশ দখল করে বসেছে।
হঠাৎ হঠাৎ কিছু ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক কেন্দ্রের মত স্থাপনা দেখা যাচ্ছে।
একঘেয়েভাবে বনের সব গাছ একই প্রজাতির। সাদা বাকল ও সবুজ পাতা বিশিষ্ট এই গাছগুলো। নাম জানি না। হঠাৎ হঠাৎ বন রেল লাইনের পাশের কিছু জায়গা ছেড়ে দিয়েছে আর সেখানে দাচা দেখা যাচ্ছে।
বৈচিত্র্যহীনতার কারনে একঘেয়েমীতে ভুগছি।
ঘুম ঘুম লাগছে। হাই তুলছি বার বার। আজ সারাদিন তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। একটা আইসক্রীম খেয়েছি শুধু।
খেতে ইচ্ছে করছে না। ঘুমুব কিনা ভাবছি। আমার পাশে সিটের যাত্রী বই খুলে বসেছে। বই পড়ছে। ভুল করে সাথে বই আনা হয় নি।
তাই সময় কাটানোর জন্য লিখছি। কিন্তু ভাল লাগছে না। ট্রেন ছাড়ার সময় পরিচিত অনেক বাঙ্গালীকে ফোন দিয়েছিলাম। সবার কাছ থেকে দোয়া আর বিদায় নিলাম। মোবাইলের নেটওয়ার্ক এখনও পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু ফোন করার মত মানুষ নেই। কিছুক্ষণ পর সিগনাল পাওয়া যাবে না। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব সবার থেকে। আপাতত জানালা দিয়ে চেয়ে থাকা অথবা ঘুমানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই। গান শোনা যেত কিন্তু হেডফোন মেইন লাগেজে ঢুকিয়ে রেখেছি।
এখন আর বের করা সম্ভব নয়। আরও কিছু বেকুবের মত কাজ করেছি। এর শাস্তি এখন একঘেয়ে সময় কাটানো ছাড়া আর কিছু করার নেই। আপাতত লেখা বন্ধ।
ঘুমুবার চেষ্টা করলাম অনেক কিন্তু পারলাম না।
ঘুম এসে এসে ছুটে যায়। যাত্রাপথে আমার সাধারণত ঘুম হয় না। আমার পাশের সিটের সহযাত্রী ইতিমধ্যে ঘুম দিয়ে দিয়েছে। ট্রেন এইমাত্র “ভলগোয়ে” নামক সেইন্ট পিটার্সবার্গ আর মস্কোর মধ্যবর্তী এক ষ্টেশনে এসে পৌছল।
যাত্রীদের মধ্যে যারা একা একা যাত্রা করছে তাদের অনেকেই ঘুমিয়ে।
কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। ঐদিকে যারা জোড়া কপোত-কপোতী হিসেবে যাত্রা করছে তারা তাদের যাত্রা যতটা পারে উপভোগ্য করে তুলছে। তাদের আনন্দ, হৈ চৈ এর কারনে সামনের বা পিছনের সিটের অনেক যাত্রীর ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কোন উচ্চবাচ্য করছে না। হয়তো তাদের মনে পড়ে যাচ্ছে নিজেদের সেই সঙ্গীময়, আনন্দময় যাত্রার কথা।
ওয়াগনের ভিতর খুবই হালকা আলো জ্বলছে। প্রায় অন্ধকার বললেই চলে। কিন্তু এর মধ্যেই আমার লিখতে ভাল লাগছে। লেখার গতি বাড়ছে। জড়তা কেটে যাচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।