আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খোকাবাবু চতুর্বিংশ মূল : আন্তোঁয়া দ্যোঁ সা এক্সউপেরী



আমার উড়োজাহাজটির যান্ত্রিক ত্রুটি জনিত কারণে এই মরুভূমিতে আমার আজ অষ্টম দিন। খোকার বড়ি বেচার গল্প শুনতে শুনতে বোতলের শেষ জলটুকু পান করলাম। আর বললাম: হুম! তোমার অভিজ্ঞতা মজার বটে। কিন্তু আমার যন্ত্রটি এখনো মেরামত হয়নি। এদিকে পানীয় জলও শেষ।

খুবই তৃপ্ত হতাম যদি পায়চারী করতে করতে এই মরুতে একটা কুয়োর সন্ধান মিলত। খোকা: শেয়াল বন্ধুটা বলছিল... দুষ্ট কোথাকার! এখন শেয়াল পন্ডিতের কথা রাখ। খোকা: কেন? কারণ তৃষ্ণায় আমরা অচিরেই মরব। কিন্তু খোকা আমার কথা বুঝলনা। বলল: একজন বন্ধু পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার, যদি তার জন্য প্রাণও দিতে হয়।

সে দিক থেকে আমি খুব ভাগ্যবান কারণ: একটা শেয়ালকে বন্ধু হিসাবে পেয়েছিলাম। খোকা আসন্ন বিপদের কথা বুঝতেই পারছেনা। আমার মনে হয়, তার কোন ক্ষুধা তৃষ্ণা নাই। এতটুকু আলোই তার বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে মনে হয় আমার চিন্তাটা সে ধরতে পেরেছে।

খোকা: তেষ্টা আমারও পেয়েছে। চল কুয়োর সন্ধানে বেড়িয়ে পরি। আমি নিরাশার আলস্যে মগ্ন। দিগন্ত বিস্তৃত বালুকাময় মরুর বুকে জলের কুয়ো খুজতে যাওয়ার কোন মানে আছে? বসে থেকেই বা লাভ কি! তাই হাঁটতে শুরু করলাম। নিরবে ঘন্টার পর ঘন্টা হাটছি।

দিনের শেষে রাতের অন্ধকার চরা চর কালো চাঁদরে ঢেকে দিল। আকাশে তারারা ঝলমল করে জ্বলছে। যেন কোন স্বপ্ন পূরী। তৃষ্ণার জ্বালায় আমার একটু জ্বর এল। আর খোকার কথা গুলো মনে দোল খাচ্ছিল।

তোমারও তেষ্টা পেয়ছে? জিজ্ঞেস করলাম। আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে সে খুব সহজ ভাবে বলল: জল হৃদয়কে প্রসারিত করে। বুঝতে পারলামনা তবুও চুপ করেই রইলাম। কারণ খোকাকে প্রশ্ন করা উচিৎ নয় সেটা ভাল করেই জানতাম। ক্লান্তিতে খোকা বসে পরল।

আমিও তার পাশে বসলাম। তার পর কিছুক্ষন চুপ করে থেকে খোকাই বলল: তারাগুলি খুব সুন্দর, তার কারণ: তারা এমন একটি ফুলের কথা মনে করিয়ে দেয়, যা দেখা যায় না। হ্যাঁ নিশ্চই! বলে নিরবে চাঁদের আলোয় ঝলমলে বালির ঢেউ গুলি দেখতে লাগলাম। খোকা বলল: মরুভূমি খুব সুন্দর। সত্যিই।

আমি মরুভূমি খুব পছন্দ করি। একটা বালির ঢিবিতে বসলে, যতদূর দৃষ্টি যায় কিছুই দেখার নেই। কোন কিছুর সারাশব্দ নেই। সেটাই যেন কিছু বলা, কিছু শোনা কিছু দেখা। যা আর কোথাও নেই।

খোকা বলল: মরুর সৌন্দর্য্যের কারণ হচ্ছে সে তার বুকে কোথাও একটা কুয়ো লুকিয়ে রাখে। কি আশ্চর্য্য! বালির ঝিকিমিকি টা যেন কিছুটা বোধগম্য হয়ে এল। ছোট বেলায় আমরা যখন একটা পুড়োনো বাড়িতে থাকতাম, লোকে বলত, সে বাড়িটাতে নাকি কোথাও একটা গুপ্তধন লুক্কায়িত ছিল। যার সন্ধান কেউ যানতো না, হয়ত কেউ কখনো খুজেও দেখেনি। হৃদয়ের গভীরে একটা গুপ্তধন ধারণ করে আছে বলেই হয়ত আমাদের বাড়িটা এত মূল্যবান মনে হত।

ঠিক তাই, খোকাকে বললাম: আমাদের পুড়োনো বাড়িটা, আকাশের তারা অথবা এই মরুভূমি যাই বলো, এদের সৌন্দর্য্যের মূল কারণ হচ্ছে, এদের চোখ দিয়ে দেখা যায় না। খোকা বলল: আমার শুনতে ভাল লাগছে। তুমি আমার শেয়াল বন্ধুটির সঙ্গে একমত পোষণ করছ। খোকাটা কখন ঘুমিয়ে পরেছে! উদ্বেলিত হৃদয়ে তাকে কোলে নিয়ে ফিরছিলাম। মনে হচ্ছিল অতি অল্পেই আঘাত পেতে পারে এমন একটা শিশুকে আগলে রাখছি।

এর চেয়ে ক্ষন ভঙ্গুর পৃথিবীতে আর আছে বলে ভাবতে পারলাম না। চাঁদের আলোতে তার নিষ্পাপ মুখ, বন্ধ চোখ আর হাওয়ায় উড়ানো চুল গুলি দেখে মনে হল, যা দেখছি তা শুধু একটা খাঁচা। ভেতরের আসল মানুষটা চোখ দিয়ে দেখা যায় না। তার অর্ধ উম্মুক্ত মুখ এমন ভাবে ঠোট গুলো মেলে রেখেছে, যেন সে তৃপ্তিতে হাসছে। আমর কাছে এই ঘুমন্ত খোকাকে এত ভাল লাগার কারণ মনে হয় তার প্রিয় ফুলটি।

ফুলটির প্রতি তার বিশ্বস্ত প্রেম, তাকে এত উজ্জীবিত রাখে, যেন সব সময় একটি প্রদীপের আলোয় তার মুখ উদ্ভাসিত থাকে। এমনকি যখন সে ঘুমোয় তখনো সেই দীপ্তি ম্লান হয় না। এখন তাকে আরো ক্ষণভঙ্গুর মনে হয়। আলো দেয় যে বাতি তাকে অতি সন্তর্পনে রক্ষা করতে হয়। কারণ সামান্য হাওয়ার ঝাপটায় তারা নিভে যেতে পারে।

এভাবে যেতে যেতে রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে ভোরের সূর্য্য যখন চরাচর আলোর পরশে উদ্ভাসিত করছিল, তখনই কুয়োটা চোখে পরল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.