ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা বাস-মিনিবাস, মনগড়া ভাড়া আদায়, যত্রতত্র হাততোলা স্টপেজ, রাস্তায় রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের মাত্রাহীন অত্যাচারসহ নানা কারণে নগর যাত্রীরা শিকার হচ্ছেন সীমাহীন দুর্ভোগের। আর সব দুর্ভোগ-ভোগান্তিকে ছাড়িয়ে গেছে নিয়ন্ত্রণহীন যানজটের ধকল। গণপরিবহন ব্যবহারকারী লাখ লাখ মানুষের নিত্য ভোগান্তি দূর করার কোনো উদ্যোগ নেই। পুরো নগর পরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে আছে। সৃষ্টি হয়েছে রীতিমতো লেজে-গোবরে অবস্থার।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে রাজধানীতে যানজটের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন বৃদ্ধি ও সড়ক-স্বল্পতা, অবৈধ পার্কিং, রাস্তা ও ফুটপাত দখল, অতিরিক্ত প্রাইভেট কার, যত্রতত্র রেলক্রসিং, অকার্যকর ও ত্রুটিপূর্ণ ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা, যেখানে-সেখানে কাউন্টার স্থাপন, ঢাকাকেন্দ্রিক সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও ট্রাফিক পুলিশের অপ্রতুলতা এবং ট্রাফিক আইন মেনে না চলার প্রবণতার কারণে রাজধানীতে যাতায়াত-ব্যবস্থা হুমকির মুখে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় প্রতিদিন কর্মস্থলে যাতায়াতকারী মানুষকে। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার একটি সরকারি অফিসে কাজ করেন নূর মোহাম্মদ। তিনি যাতায়াত ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, 'আমি প্রায়ই টিকাটুলী থেকে হেঁটে কর্মস্থলে যেতে বাধ্য হই। কারণ গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থেকেও পাই না। গাড়িতে প্রচণ্ড ভিড়। এক গাড়িতে তিন গাড়ির লোক তোলা হয় গাদাগাদি করে। আবার ফার্মগেট পর্যন্ত যেতে ২০ মিনিটের রাস্তায় লাগে দেড় ঘণ্টা। লোকাল বাসে আপনি বসার জায়গা তো দূরে থাক, দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত পাবেন না।'
রাজধানীর বেহাল সড়কে দুর্ভোগে যাত্রী-পথচারীরা। ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) দক্ষিণের ৩০০ কিলোমিটার রাস্তাই খানাখন্দে ভরা। ভাঙাচোরা রাস্তার কারণে যাত্রীদের পড়তে হচ্ছে দীর্ঘ যানজটে। ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণের অধীনে ৬৯০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৩০০ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থাই খারাপ। খানাখন্দে ভরা এসব রাস্তা যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র পল্টনের রবিন টাওয়ারের সামনের রাস্তা, যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান সড়ক, গুলিস্তান-চানখাঁর পুল সড়ক, নবাবপুর রোড, স্বামীবাগ-দয়াগঞ্জ সড়ক, জুরাইন মাদরাসা রোড, সায়েদাবাদ জনপথ সড়ক, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, শ্যামপুর, কদমতলী, চকবাজার, কোতোয়ালিসহ রাজধানীর বেশির ভাগ থানার রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই নাজুক। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি হলে রাস্তায় পানি জমে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ অবস্থার। কাদা-পানির মাখামাখিতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় পথচারীদের। ফলে যানবাহন চলাচলে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট। ৩০ মিনিটের রাস্তা পার হতে লেগে যায় এক থেকে দুই ঘণ্টা। ডিসিসি দক্ষিণের প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম জানান, সিটি করপোরেশনের রাস্তাগুলো দুটি কারণে স্থায়িত্ব পায় না। এক. বর্ষার সময় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকা, দুই. সড়ক দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল। তিনি বলেন, রাজউক যখন বাসাবাড়ি বানানোর অনুমতি দেয় তখন ড্রেনেজের ওপর গুরুত্ব দেয় না। দেখা যায় ছোট ছোট খাল ভরাট করে তৈরি হচ্ছে বড় বড় বাড়ি। অথচ বাড়ির সামনে প্রয়োজনীয় রাস্তা আছে কি না এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো কি না সে ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাই সড়কগুলোর স্থায়িত্ব বেশি থাকে না। তিনি আরও বলেন, 'সিটি করপোরেশন দক্ষিণের অধীনে ৬৯০ কিলোমিটার রাস্তা হলেও কোনো বছরই সম্পূর্ণ রাস্তা সংস্কার সম্ভব হয় না। আমাদের যে বাজেট থাকে এর মধ্যেই কাজ শেষ করতে হয়। ফলে ভোগান্তিও দূর হয় আংশিক। বাকিটা বহাল থাকে যথাযথ।' বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের বলেন, পথচারীদের নিরাপত্তা দেওয়া সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। কিন্তু তারা তা যথাযথ পালন করছেন না। ঢাকা শহরের একটি বড় অংশের মানুষ হেঁটে চলাচল করলেও নগর পরিকল্পনায় পথচারীরা বরাবরই থাকছেন উপেক্ষিত। গত বছর ৭ মার্চ হাইকোর্ট পথচারীদের নিরাপত্তায় ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল চালানো বন্ধসহ কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু অনেক চালক তা মানছেন না। আইন মানতে তাদের বাধ্য করার ব্যাপারেও ট্রাফিক বিভাগের উদ্যোগ নেই। এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের তৎপরতা কমে যেতেই সিএনজি অটোরিকশা চালকেরা আগের নিয়মে ফিরেছেন। যেমন খুশি ভাড়া নিচ্ছেন, মর্জিমাফিক গন্তব্যে যাচ্ছেন বা যাচ্ছেন না। এ অনিয়মই এখন নিয়ম। কিন্তু তাতে ভোগান্তির একশেষ হচ্ছেন যাত্রীরা। সিএনজি চালকদের অভিযোগ ছিল, খরচ অনুযায়ী ভাড়া কম। অভিযোগ ছিল, মালিকেরা বেশি জমা নেন। দুটি অভিযোগেরই সুরাহা করার চেষ্টা হয়েছিল ওই চুক্তিতে। এখন কোনো মালিক যদি বেশি জমা রাখেন, তাহলে তার রুট পারমিট বাতিল হওয়ার কথা। চালক যদি বেশি ভাড়া দাবি করেন, বাতিল হওয়ার কথা তারও লাইসেন্স। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই হয়নি। বেড়েছে শুধু যাত্রীদের হয়রানি আর অর্থের অপচয়। মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ট্রাফিক) বলেন, মূল সড়ককে তিন ভাগে ভাগ করে প্রতিটি গাড়িকে নিজ নিজ লাইনে যাওয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া দড়ি, বাঁশ ও লোহার রড দিয়েও সড়ক বিভক্ত করা হয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী ট্রাফিক নেই। আট শতাধিক সার্জেন্টের স্থলে আছে ৪২৫ জন। টিআই ৮০ জনের স্থলে ৪৫ জন। ঢাকার চারটি ট্রাফিক জোনে ৭০টি পয়েন্টে ২০ শতাংশ সিগনাল বাতি অকেজো হয়ে আছে। সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি কনস্টেবলের স্থলে রয়েছে তিন হাজার ১৯৮ জন।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গুলশান থেকে সদরঘাট যাতায়াতকারী বন্ধু পরিবহন নামে এক ধরনের মিনি যানবাহন চলাচল করে থাকে। সাড়ে তিন শতাধিক গাড়ি চললেও এর মধ্যে মাত্র ১৫টির কাগজপত্র ঠিক আছে। বাকি কোনো গাড়ির কাগজপত্র নেই। চালকদের নেই কোনো লাইসেন্স। এ রুটে বন্ধু পরিবহনগুলোই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সব ধরনের ঝক্কি-ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে বন্ধু পরিবহনের মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে সাড়ে পাঁচ লক্ষাধিক টাকা দেওয়া হয় ট্রাফিক বখরা। এসব কারণে যাত্রী ভোগান্তি দূর হয় না কখনোই।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।