চরম সমন্বয়হীনতায় নামকাওয়াস্তে চলছে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম। মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআই এবং খাদ্য ও পানীয় পরীক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত জনস্বাস্থ্য ল্যাবরেটরি পরিণত হয়েছে ন্যুব্জ প্রতিষ্ঠানে। প্রয়োজনীয় লোকবল তো নেই-ই, যারা আছেন তাদেরও অধিকাংশের নেই আধুনিক প্রশিক্ষণ। মাঠপর্যায়ে তদারককারী স্যানেটারি ইন্সপেক্টরদের তৎপরতাও সীমিত। ফলে ফরমালিন মেশানোসহ খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা রূপ নিয়েছে ভয়াবহতায়। পরিস্থিতি সামলাতে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ এসেছে। কিন্তু সুপারিশগুলো দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়নের উদ্যোগ না থাকায় ভেজাল থামানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই।
খাদ্যপণ্যে ভেজাল বন্ধের মূল দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)। এ ছাড়া ঢাকা সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগেরও বড় ভূমিকা থাকার কথা। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, স্বাস্থ্য অধিদফতর, জেলা প্রশাসন, র্যাব, পুলিশসহ ছয় মন্ত্রণালয়ের ১০টি বিভাগের প্রতি রয়েছে ভেজাল রোধে বিশেষ নির্দেশনা। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় বলতে কিছু নেই। যে কারণে মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট বা ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে লাখ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হলেও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না ভেজালমুক্ত খাদ্যপণ্য।
ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলার নেতৃত্বাধীন ভ্রাম্যমাণ আদালত একসময় তুমুল সাড়া ফেললেও এখনকার আদালতগুলো তা পারছেন না। রোকনের সেই আদালতের প্রতি গণমাধ্যমেরও আগ্রহ ছিল। সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভেজাল পানীয় ও খাদ্য পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সেখানে ভেজাল পণ্য উদ্ধার করে পরীক্ষা-সংক্রান্ত জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উদ্ধার করা পণ্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পার্সেলযোগে কেন্দ্রীয় ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। কিন্তু রুটিনকাজের ভিড়ে এতে লেগে যায় বেশ কয়েক মাস। অন্যদিকে দীর্ঘদিন পর পণ্যের মান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই সম্পন্ন হয়ে যায় নিম্নমানের ওই সামগ্রীর বিক্রি। বিশেষজ্ঞরা এসব বিবেচনায় বিভাগীয় শহরগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে ল্যাবরেটরি স্থাপনের তাগিদ দিয়েছেন। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক খাদ্যায়ন সংস্থার সদস্য। অথচ তাদের নীতিমালা কার্যকরের ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ নেই। খাদ্যসামগ্রী আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রেও 'বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ও খাদ্য আইনের' প্রয়োগ হয় না বললেই চলে। সারা দেশের খাদ্য ও পানীয় পরীক্ষার জন্য একটি মাত্র ল্যাবরেটরির অস্তিত্ব আছে। সেন্ট্রাল ল্যাবরেটরি হিসেবে চিহ্নিত 'জনস্বাস্থ্য ল্যাবরেটরি'র অবস্থান রাজধানীর মহাখালীতে। প্রতি বছর এখানে প্রায় আট হাজার নমুনা পরীক্ষার জন্য এলেও কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে লোকবল মাত্র ২৫ জন। কিছুদিন আগে ল্যাবরেটরির নতুন ভবন ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। কিন্তু তা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। ফলে ল্যাবরেটরির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশবাসী।
বিশেষ প্রকল্প নেওয়ার সুপারিশ
কৃষিতথ্য সার্ভিসের পর্যবেক্ষণমূলক সুপারিশমালায় বলা হয়েছে, রাজধানীতে ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলার মতো সাহসী কর্মকর্তাকে প্রধান সমন্বয়কারী করে কমপক্ষে পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন জরুরি। এর মাধ্যমে সপ্তাহে দুই দিন করে ভেজালবিরোধী অভিযান চালালে এক বছরের মধ্যে পরিস্থিতি সহনশীল পর্যায়ে নেমে আসবে। একই সঙ্গে বিভাগীয় শহরে অন্তত দুটি এবং জেলা শহরে একটি করে আদালত পরিচালনা করা উচিত। আর উপজেলাগুলোতে নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনারদের (ভূমি) তত্ত্বাবধানে আদালত তৎপর হলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে অথবা বিদেশি সাহায্যপুষ্ট 'ভেজাল নিয়ন্ত্রণ অভিযান' শীর্ষক বিশেষ প্রকল্প গ্রহণেরও সুপারিশ করা হয়েছে। এর আওতায় লজিস্টিক সাপোর্টসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জন্য বিশেষ ভাতা বা সম্মানীর ব্যবস্থা রাখারও সুপারিশ করা হয়েছে। ভেজালবিরোধী অভিযানে বিশেষ ভূমিকা রাখা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আল আমীন বলেন, 'জেল-জরিমানা ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ভেজাল নির্মূল করা যাবে না। ব্যবসায়ীদের মানবতাবোধ, সরকারের দায়িত্ববোধ ও ক্রেতাদের অধিকারবোধ জাগ্রত হলেই ভেজাল রোধ করা সম্ভব হবে। এ জন্য আলাদা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হতে পারে।' তিনি বলেন, 'ভ্রাম্যমাণ আদালতের আইনে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা দায়িত্ব পালন করছেন। আগের মতো তাদের আর সমন অথবা ওয়ারেন্ট দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়ার ক্ষমতাও নেই। আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার করার ক্ষমতা নেই। এফিডেভিট করার ক্ষমতা নেই। আমি মনে করি, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের এসব ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন।'
৭৯ ভাগ খাদ্যপণ্যই ভেজাল : মহাখালী পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের খাদ্য পরীক্ষাগারের তথ্যানুযায়ী দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল ও দেহের জন্য মারাত্দক ক্ষতিকর। সারা দেশ থেকে স্যানেটারি ইন্সপেক্টরদের পাঠানো খাদ্যদ্রব্যাদি পরীক্ষাকালে এ তথ্য বেরিয়ে আসে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) খাদ্য পরীক্ষাগারে পাওয়া তথ্য আরও ভয়ঙ্কর। ডিসিসির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানান, রাজধানীতে বাজারজাত হওয়া খাদ্যপণ্যের অন্তত ৭৯ ভাগই ভেজাল। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এক গবেষণা সূত্রে জানা যায়, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দেড় লাখ, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ।
এদিকে ক্রেতারা বাজার থেকে উচ্চমূল্যে খাবার কিনলেও তা খেয়ে আদৌ সুস্থ থাকবেন কি-না এ নিয়ে শঙ্কায় আছেন। বাজারে বিক্রি হওয়া মাছ, মাংস, দুধ, ফল, খাবার মসলা, সবজি, শিশুখাদ্য, প্যাকেট ও মিষ্টিজাত খাবার, কোমল পানীয়, আচারসহ প্রায় সব ধরনের খাবারেই এখন ভেজাল। ভেজালের ভিড়ে আসল পণ্যই হারিয়ে গেছে। লাভের আশায় কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী ও ভেজাল খাবার তৈরির সিন্ডিকেট দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে খাওয়ার অনুপযোগী ও অস্বাস্থ্যকর সব ভেজাল খাবার। এর মধ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে বিষাক্ত ফরমালিন, কেমিক্যাল, রং, সোডা, স্যাকারিন, মোম, ট্যালকম পাউডার, যানবাহনে ব্যবহৃত মবিল ইত্যাদি। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিষাক্ত ফরমালিন, যা মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক হিসেবে চিহ্নিত, তা বাজারের অধিকাংশ খাদ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই সংরক্ষণের জন্য বিক্রেতারা কাঁচা মাছে ফরমালিন ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া আম, কলা, খেজুর, পেঁপে, আনারস, মালটা, আপেল, আঙ্গুর এসব ফলেও ব্যবহৃত হচ্ছে ফরমালিন। শুধু মাছ ও ফলেই নয়, এখন ফরমালিন মেশানো হচ্ছে দুধেও। ফরমালিন খাদ্যে পরিপাক বাধাগ্রস্ত ও চোখের কর্নিয়ার ক্ষতি করে। এতে লিভারের এনজাইম নষ্ট ও কিডনির কোষ নেফ্রন ধ্বংস হয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা লাভের আশায় সঠিক ও বিশুদ্ধ খাদ্য উপাদানের পরিবর্তে শিশুখাদ্যে ব্যবহার করছেন বিষাক্ত কেমিক্যাল ও পচা ফল। এ তালিকায় রয়েছে নিম্নমানে রং, সোডা, স্যাকারিন, মোম, আটা-ময়দা, সুগন্ধি, ট্যালকম পাউডার, পচা বরই, তেঁতুল, আম, আমড়া, ঘন চিনি ইত্যাদি। ভালো কোম্পানির মোড়ক দেখে প্রতারিত হচ্ছেন অভিভাবকরাও। সন্তানের আবদার মেটাতে তারা অজান্তে কিনে দিচ্ছেন ভেজাল আইসক্রিম, জুস, চকোলেট ও আচারসহ বিভিন্ন শিশুখাদ্য। অধিক মুনাফার জন্য একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী মসলায় কাপড়ের বিষাক্ত রং, দুর্গন্ধযুক্ত পটকা মরিচের গুঁড়া (নিম্নমানের মরিচ), ধানের তুষ, ইট ও কাঠের গুঁড়া, মোটর ডাল ও সুজি ইত্যাদি মেশাচ্ছেন। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, ভেজাল মসলা কিনে ক্রেতারা শুধু প্রতারিতই হচ্ছেন না, এতে তৈরি হচ্ছে মারাত্দক স্বাস্থ্যঝুঁকি। কারণ ভেজাল মসলায় মেশানো ক্ষতিকর খাদ্যদ্রব্য ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। অনুসন্ধানে জানা যায়, ভেজাল মসলা উৎপাদনকারীরা গুঁড়া মরিচের সঙ্গে মেশাচ্ছেন ইটের গুঁড়া। হলুদে দেওয়া হচ্ছে মোটর ডাল, ধনিয়ায় স'মিলের কাঠের গুঁড়া আর পোস্তাদানায় সুজি। মসলার রং আকর্ষণীয় করতে মেশানো হচ্ছে বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল রং। রাজধানীর শ্যামবাজার, কারওয়ানবাজার, মৌলভীবাজার, টঙ্গী ও মিরপুর এলাকার বিভিন্ন পাইকারি মসলার বাজার এবং ভাঙানোর কারখানায় এসব ভেজাল মেশানো হচ্ছে। তবে হোটেল-রেস্তোরাঁয় ভেজাল মসলা মেশানোর হার বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. গোলাম মাওলা বলেন, মসলায় ব্যবহৃত কাপড়ের রং শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর কারণে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া এর মাধ্যমে মানবদেহে হেপাটাইটিস এবং কিডনি ও লিভারের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, চকবাজার, কেরানীগঞ্জ ও শনির আখড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ভেজাল শিশুখাদ্যের শত শত কারখানা গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন এসব কারখানায় কয়েক কোটি টাকার ভেজাল খাদ্য বিক্রি করা হচ্ছে। অন্যদিকে রাজধানীর শনির আখড়া, কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ভেজাল আইসক্রিম তৈরির অসংখ্য কারখানা। এ বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান বলেন, ভেজাল ও বাসি খাবার খাওয়ার ফলে প্রথমে শিশুরা ডায়রিয়া ও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে খাওয়ার ফলে শিশুদের লিভার, কিডনি ও ফুসফুসের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।