আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাস্টারদা সূর্য সেন

ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সাথিদের উদ্দেশে সূর্য সেন লিখে গেলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার এটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো। সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত। ’তাঁর লাশ বস্তাবন্দী করে দূরসমুদ্রে ফেলে দিয়ে এল।

বাংলার মাটিতে কোথাও যেন তাঁর চিহ্ন না থাকে। কিন্তু বিপ্লবী আত্মার যে মৃত্যু নেই। সূর্য সেন এ দেশের নির্যাতিত মানুষের হূদয়ে তাই আজও অমর। তাঁর দেখানো পথে বছরের পর বছর অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এ দেশের মানুষ। শিক্ষকতা করার কারণে তিনি `মাস্টারদা` হিসেবে পরিচিত হন।

পুলিশ রেকর্ড ও সরকারি নথিপত্র ঘেঁটে এবং সাবেক বিপ্লবীদের বিশদ সাক্ষাৎকার নিয়ে গবেষিকা মানিনী চ্যাটার্জি চট্টগ্রাম বিদ্রোহের ওপর চমৎকার একটা বই লিখেছেন, যে বইয়ে সেই ঘটনা ও স্বাধীনতাবিপ্লবীদের এক প্রাঞ্জল ও অন্তরঙ্গ ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। সুখপাঠ্য এই বইয়ের নাম ডু অ্যান্ড ডাই: দ্য চিটাগং আপরাইজিং ১৯৩০-১৯৩৪। প্রায় সাড়ে তিন শ পৃষ্ঠার বইটি প্রথম প্রকাশ করে পেঙ্গুইন এবং পরে পিকাডর প্রকাশনী। টেনিসনের কবিতা আবৃত্তি করতে পছন্দ করতেন এসব তরুণ বিপ্লবী। বইটির নাম ডু অর ডাই নয়, ডু অ্যান্ড ডাই।

কাজটি করো এবং মৃত্যুবরণ করো । মাত্র ৬৪ জন বাঙালি তরুণ-তরুণী যা করলেন, ইংরেজ অফিসাররা কোনো দিন তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। পরিশ্রমী গবেষণায় ডু অ্যান্ড ডাইয়ের মতো সুলিখিত একটি বই, যা নতুন প্রজন্মকে দেবে গভীর দেশপ্রেমের দীক্ষা। সূর্যকুমার সেন ডাকনাম কালু যিনি মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তাঁর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ তাঁর নামে একটি করে আবাসিক হল এর নামকরন করা হয়।

তাঁর পিতার নাম রাজমনি সেন এবং মাতার নাম শশী বালা সেন। রাজমনি সেনের দুই ছেলে আর চার মেয়ে। সূর্য সেন তাঁদের পরিবারের চতুর্থ সন্তান। শৈশবে পিতা মাতাকে হারানো সূর্য সেন কাকা গৌরমনি সেনের কাছে মানুষ হয়েছেন। পাহাড়ে যুদ্ধজয়ের পর মাস্টারদা ইংরেজদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

মাস্টারদার নির্দেশে প্রথম গেরিলা আক্রমণে ব্রিটিশের দালাল পুলিশ অফিসার আসানুল্লাহকে হত্যা করে ১৯ বছরের টগবগে যুবক হরিপদ ভট্টাচার্য যে বীরত্ব দেখিয়েছেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফ. এ. পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করে তিনি একই কলেজে বিএ-তে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু তৃতীয় বর্ষের কোন এক সাময়িক পরীক্ষায় ভুলক্রমে টেবিলে পাঠ্যবই রাখার কারণে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিতাড়িত হন। তিনি চট্টগ্রামের কানুনগোপাড়ার নগেন্দ্রনাথ দত্তের ষোল বছরের কন্যা পুষ্প দত্তকে বিয়ে করেন। বিবাহের তৃতীয় দিনে হিন্দুদের মধ্যে যে ফুলশয্যার প্রথা প্রচলিত আছে, সেদিন তিনি তাঁর বৌদিকে বলেন, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন স্ত্রীর সংগে সহবাসে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য।

তাই তিনি সেদিনই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে আসেন এবং তারপর স্ত্রীর সাথে আর কোনদিন দেখা করেন নি। মাস্টারদা যখন রত্নগিরি জেলে আটক, তখন তাঁর স্ত্রীর কঠিন টাইফয়েড রোগ হয়। দেওয়ানবাজারের যে বাসা থেকে মাস্টারদা পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর স্ত্রী সেখানে তখন মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। বহু দরখাস্তের পর মাস্টারদাকে যখন পুলিশ পাহারায় রত্নগিরি জেল থেকে ছুটিতে চট্টগ্রাম আনা হয় মূমুর্ষু স্ত্রীকে দেখার জন্য, তাঁর স্ত্রীর আয়ু তখন সম্পূর্ণ নিঃশেষিত। ১৯১৬ সালে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে সূর্য সেন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হন।

বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি এই কলেজ়ে তিনি অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে আসেন। তিনি যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। সূর্য সেনকে তিনি বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। ১৯২০ সালে গান্ধীজী- কর্তৃক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে অনেক বিপ্লবী এই আন্দোলনে যোগ দেন। সূর্য সেন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিলেন।

রেলওয়ে ডাকাতি মামলা শুরু হয় সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তীকে নিয়ে। ১৯২৮ সালের শেষভাগে সূর্য সেন ও গণেশ ঘোষ জেল থেকে ছাড়া পান। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামেরনকে গুলি করে সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন কিন্তু নির্মল সেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। প্রীতিলতা সূর্য সেন-এর নির্দেশে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। হামলায় ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়েছিল।

গুলিতে আহত প্রীতিলতা দৈহিকভাবে অত্যাচারিত হওয়ার চাইতে থেকে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিলেন। তিনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ১৯৩৩ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী রাতে সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেনকে প্রথমে জেলা গোয়েন্দা সদর দপ্তরে, পরে কোর্ট হয়ে চট্টগ্রাম জেলে নেয়া হয়। সূর্য সেন গ্রেপ্তার হবার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল “চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন সম্পর্কে ফেরারী সূর্য সেনকে গত রাতে পটিয়া হইতে ৫ মাইল দূরে গৈরলা নামক স্থানে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে।

শেষ দিনগুলোতে জেলে থাকার সময় তাঁর একদিন গান শোনার খুব ইচ্ছা হল। সেই সময় জেলের অন্য এক সেলে ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। রাত ১১টা/১২টার দিকে কল্পনা দত্ত তাঁকে চিৎকার করে বলেন “এই বিনোদ, এই বিনোদ, দরজার কাছে আয়। মাষ্টারদা গান শুনতে চেয়েছেন”। বিনোদ বিহারী গান জানতেন না।

তবুও সূর্য সেনের জন্য রবিঠাকুরের “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে” গানটা গেয়ে শোনালেন। তার বিচারের সময় তার বিরুদ্ধে কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারলেও বিচারক তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন। ১৯৩৪ সালের ১২-ই জানুয়ারী চট্টগ্রাম জেলে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালিকে কেউ চিরকাল দাবিয়ে রাখতে পারেনি। আমরা বিস্মৃত হইনি, বঙ্গবন্ধুর অজেয় সতর্ক-ধ্বনি, ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’।

কেননা আমরা সূর্যসেনের উত্তরসূরী, আমরা তিতুমীরের বংশধর, আমরা জাতিপিতা বঙ্গবন্ধুর অজেয় মুক্তিযোদ্ধা। আমরা সশস্ত্র সুন্দর। আমাদের প্রতেকের বুকে-মুখে অবিনাশী সশস্ত্র শব্দবাহিনী। ( তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেট ) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.