"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা
পর্ব - ৮
মাস্টারদা সূর্যসেনের শেষ বাণী
(চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসির ৫ ঘণ্টা পূর্বে লেখা)
আমার শেষ বাণী _ আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে।
এই ত সাধনার সময়। বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এই ত সময়। ফেলে আসা দিনগুলোকে স্মরণ করার এই ত সময়।
কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমরা ভাই-বোনেরা তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্রহীন আমার এই জীবনের একঘেঁয়েমিকে ভেঙে দেয়।
উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে।
লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা বন্ধুরা _ এগিয়ে চল, এগিয়ে চল _ কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না।
সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশীর্বাদ করুন।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোনও দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলখা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যেসব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো।
"আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে _ এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে। "
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক
বন্দেমাতরম
মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি হয়ে গেল। কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন।
ভারতের স্বাধীনতা তাঁরা দেখে যেতে পারেন নি। এক অর্থে তাঁদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ। আসলে কি তাই?
মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রামে ইংরেজ সৈন্যদের কিছু সময়ের জন্য হলেও পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। তারা অস্ত্রাগারও লুণ্ঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের সে প্রচেষ্টা যতটা নিজেদের প্রস্তুতির কারণে ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়েছে, তার চেয়ে বড় কারণ ছিল সারা ভারতব্যাপী একযোগে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের অনুপস্থিতি।
একই সাথে কংগ্রেসের তৎকালীণ আপসকামী বুর্জোয়া নেতৃত্বের ভূমিকাও কম নয়।
আপাত বিচারে সূর্যসেনের স্বাধীনতার সাধনা ও প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলেও এই অভ্যুত্থান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে হতবিহ্বল ও পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল। ১৮ এপ্রিলের ঘটনার পর তিন-চার দিনের জন্য চট্টগ্রাম শহর এবং আশেপাশের অঞ্চলের ওপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৮ এপ্রিল যুববিদ্রোহ বা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনাকে "ভারতের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে সাহসিকতাপূর্ণ কাজ" হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এ অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে গোটা ভারতেই বিপ্লবী সংগ্রামের এক ঝড় ডেকে আনে।
১৯৩৩-৩৪ সালের সরকারি রিপোর্টেও এর স্বীকৃতি মেলে। তদানীন্তন কলকাতা পুলিশের প্রধান কুখ্যাত চার্লস টেগার্ট ১৯৩৪ সালে অবসর নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার সময় তেহরান বিমানবন্দরে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, "Chittagong’ is the mastermind of Bengal revolutionary activities." _ অর্থাৎ চট্টগ্রামই বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। (সূর্যসেন স্মৃতি : বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতিসংস্থা, কলকাতা)
নিজেদের সীমিত শক্তিকে সম্বল করে দেশকে স্বাধীন করার যে দুঃসাধ্য ও দুর্লঙ্ঘ্য কাজে তাঁরা নেমেছিলেন, তাতে সফল হবেন এ ধারণা মাস্টারদা পোষণ করতেন না। যে দেশবাসীর মুক্তির জন্য নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করছেন, তাদের কারো কারো অসহযোগিতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা প্রতি পদে তাঁদের কাজ আরও দুরূহ করে তুলেছিল। তিনি নিজেও ধরা পড়েছিলেন স্বদেশী এবং স্বধর্মাবলম্বী এক মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়।
তারপরও, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও, ব্যর্থতার জন্য তিনি দেশবাসীকে দায়ী করেন নি অথবা নিজেদের পক্ষে কোনো সাফাই গান নি। নিজেদের ব্যর্থতার কারণ হিসাসে মাস্টারদা মনে করতেন, "Want of realisation of our goal!" _ অর্থাৎ লক্ষ্য সম্পর্কে যথার্থ উপলব্ধির ঘাটতিই তাঁদের ব্যর্থতার মূল কারণ। (সূর্যসেনের স্বপ্ন ও সাধনা : অনন্ত সিংহ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।