"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা
"কয়েকদিন মাত্র তবু এখনো সেই স্বাধীনতার স্বাদ
এখনো ভোলা গেল না।
সেই যে ফাঁকা আকাশ ধুধু ময়দানে নীল নিশান
জীবনপণ ভালবাসার দাবি
অস্ত্রগার লুণ্ঠনের অগ্নিযুগে দামাল
কয়েক স্কোয়ার মাইল মাত্র কয়েকদিন অসম্ভব স্বরাজ ঘোষণায়
টেলিগ্রাফের লাইন কেটে ট্রেজারি লুট থানা চড়াও
সেই আমার ভালবাসার স্বাধীনতার নীল নিশানা
সেই আমার স্বাধীনতার ভালবাসার নীল নিশানা
কয়েকদিন মাত্র তবু এখনো সেই স্বাধীনতার স্বাদ
এখনো ভোলা গেল না।
ছিলাম ভালবাসার নীল পতাকা তলে স্বাধীন। "
................................................. তারাপদ রায়
পর্ব - ২
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন টালমাটাল।
একের পর এক আন্দোলনের আঘাতে ভীত ব্রিটিশ সরকার নানা কালাকানুন দিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন দমনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ১৯১৬ সালে প্রণয়ন করা হয় 'ভারতরক্ষা আইন'। এর আওতায় স্বাধীনতা আন্দোলনের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে আটক করা হয়। ১৯১৯ সালের ১৮ মার্চ ঘোষণা করা হয় 'রাউলাট আইন'। এই আইনের সাহায্যে শাসকরা বিনা-বিচারে আটক রাখার ক্ষমতা লাভ করে।
এর পরপরই ১৩ এপ্রিল ১৯১৯ সংঘটিত হয় কুখ্যাত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। এর প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত নেমে এলেন রাজপথে। ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ব্রিটিশের নাইট খেতাব।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। সমাজের চোখে নিরীহ এক স্কুল মাস্টার কিন্তু তখন গোপনে গোপনে প্রস্তুত হচ্ছেন ভবিষ্যতের বিপ্লবী সংগ্রামের জন্য।
স্কুলে পড়ার সময়ই সূর্যসেনের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে বিপ্লবীদের। বহরমপুর কলেজে পড়ার সময়ে তিনি যুক্ত হন যুগান্তর দলের সঙ্গে। চট্টগ্রামে ফিরে শিক্ষকতা বেছে নেন রাজনৈতিক জীবনের সুবিধার কথা চিন্তা করেই। ছাত্রদের সামনে তিনি তুলে ধরতেন স্বাধীনতার আহ্বান _ "তোমাদের বিদ্যার্জন, তোমাদের দৈনন্দিন জীবনধারণ, তোমাদের ভাবী জীবনের স্বপ্ন ও চিন্তার মধ্যে সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে একটি কথাকে কি প্রোজ্জ্বল করে রাখতে পারবে _ পরাধীনতার অভিশাপ থেকে, ইংরেজের পরাধীনতার পীড়ন থেকে এই দেশকে মুক্ত করাই তোমাদের ব্রত _ আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য? (সূর্যসেন স্মুতি : বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতিসংস্থা, কলকাতা)
ওই সময়ে চট্টগ্রামে 'চট্টগ্রাম বিপ্লবী দল' নামে একটি ক্ষুদ্র বিপ্লবী সংগঠন ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯) এ সংগঠনের দু'একজন ছাড়া আর সকলকেই ব্রিটশ সরকার কারাবন্দি করেছিল।
ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই তরুণ সূর্যসেনের কাঁধে বিপ্লবী আন্দোলন সংগঠিত করার দায়িত্ব এসে পড়ে। ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে ফিরেই মাস্টারদা স্থানীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে মিলে নতুন বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সে সময় বিপ্লবীদের সাংগঠনিক শক্তি মতাদর্শিক পার্থক্যের কারণে 'অনুশীলন' ও 'যুগান্তর' _ এই দুইভাগে বিভক্ত ছিল। তিনি এই দুই অংশের ভুল বোঝাবুঝি এবং মতপার্থক্য দূর করতে উদ্যোগী হলেন। বিপ্লবী দল গঠনের প্রথম ধাপে ওই সময় ৫ জনকে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এঁরা হলেন নগেন সেন (জুলুদা), অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী এবং সূর্যসেন নিজে। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই চারুবিকাশ দত্ত তাঁর অনুগামীদের নিয়ে নানা বিষয়ে বিতর্ক উত্থাপন করেন। সূর্যসেনের পরামর্শে এ নিয়ে দলের দ্বিতীয় সারির নেতা আফসার উদ্দিন, নির্মল সেন, প্রমোদ রঞ্জন চৌধুরী, নন্দ লাল সিংহ, অবনী ভট্টাচার্য এবং অনন্ত সিংহ-সহ ১১ জনের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয়। কিন্তু তাতেও সংগঠনের বিভক্তি রোধ করা যায় নি। তবে চারুবিকাশ দত্তেরা সংগঠন ছেড়ে যাওয়ায় তাঁদের প্রস্তুতিতে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি।
বয়সে এবং অভিজ্ঞতায় নবীন হওয়া সত্ত্বেও ধীশক্তি ও উদ্যমের কারণে ক্রমে সূর্যসেন এই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের নেতৃত্বে আসীন হন।
সূর্যসেন শারীরিকভাবে ততটা সবল প্রকৃতির ছিলেন না। বরং তাঁর শীর্ণ, রুগ্ন ও দুর্বল শরীর নিয়ে দলের সদস্যদের মধ্যে কৌতুক চলতো যে এ শরীর নিয়ে তিনি পুলিশী তৎপরতা মোকাবেলা করবেন কীভাবে? এ সম্পর্কে মাস্টারদার অন্যতম সহযোদ্ধা গণেশ ঘোষ লিখেছেন, "তিনি আদৌ সুশ্রী ছিলেন না বা সুপুরুষ ছিলেন না, কিন্তু অন্যন্য সাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সকলের নিকট হইতেই তিনি শ্রদ্ধা ভালবাসা অর্জন করিয়া লইতেন। তিনি দলের নেতা ছিলেন; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, দলের প্রত্যেকটি যুবক তাঁহাকে ব্যক্তিগতভাবে নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু বলিয়া মনে করিত। সাহসী, ধৈর্য্যশীল, সহিষ্ণু, প্রত্যুতপন্নমতি ও দূরদর্শিতা দিয়াই সূর্যসেন তাঁহার দৈহিক দুর্বলতার ক্ষতিপূরণ করিয়া লইতেন।
" (বসুমতী, ১৫ আগস্ট ১৯৪৭; উদ্ধৃত : সংবাদপত্রে উপমহাদেশের স্বাধীনতা, আতোয়ার রহমান, বাংলা একাডেমী, পৃ:৩৯৮)
এরই মধ্যে ১৯১৯ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সূর্যসেনের দাদা-বৌদি মিলে তাঁর বিয়ের আয়োজন করেন। পাত্রী চট্টগ্রামের কানুনগো পাড়ার নগেন্দ্রনাথ দত্তের কন্যা পুষ্পকুন্তলা দেবী। বিয়ে না করার কথা দাদা-বৌদিকে জানিয়ে দেন সূর্যসেন। কিন্তু কোনো আবেদনই তারা শুনলেন না। জ্যাঠাতুতো দাদা চন্দ্রনাথ সেন এবং বৌদি বিরাজমোহিনী সেন সূর্যসেনের কাছে পিতা-মাতার সমতুল্য।
তাই তাদের মনে আঘাত করতে না পেরে, অন্যের কাছে তাদের যাতে অপমানিত হতে না হয় সে-কথা ভেবে বিয়েতে রাজী হলেন। বিয়ের আসরে বসেই সূর্যসেন খবর পান, এক চিঠির জবাবে কলকাতা থেকে তাঁর সহযোগিরা চিঠি লিখে নতুন করে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। সাথে সাথে তারা এটাও বলেছেন যে সূর্যসেনকেই এ সংগঠনের দায়িত্ব নিতে হবে। এ খবর শুনে বিয়ের আসরে উপস্থিত সংগঠনের কর্মীরা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, "এই বিয়ে করা কি আপনার পক্ষে ঠিক হবে?" সে সময় বিপ্লবীদের ব্রহ্মচর্য পালন করতে হত। নারী সংস্পর্শও তাদের জন্য হারাম ছিল।
তাই সূর্যসেন দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেন। বিয়ে না করে চলে গেলে পাত্রী লগ্নভ্রষ্টাই শুধু হবে না, অপমানিত হবে, সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। কোথাও মেয়েটির ঠাঁই হবে না। একটি মেয়েকে এভাবে সমাজের চোখে হেয় ও অপমানিত করার কথা তিনি কিছুতেই ভাবতে পারলেন না। বিয়ে হয়ে গেল।
এ ঘটনা স্মরণ করে মাস্টারদা পরে বলেছিলেন, "যখন বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাব, তার কিছুক্ষণ আগে আমাকে এই সংবাদটি দিল। আমার ক্ষুব্ধ জিজ্ঞাসা ছিল, বিয়ের একদিন পূর্বে কেন আমি এই সংবাদ পেলাম না। " (অনন্ত সিংহ : সূর্যসেনের স্বপ্ন ও সাধনা; পৃ:৪৬)
বিয়ের রাত্রেই পুষ্পকুন্তলা দেবীর কাছে নিজের জীবনের লক্ষ্য এবং ব্রহ্মচর্য পালনের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে ক্ষমা চাইলেন সূর্যসেন। সে রাতেই চলে গেলেন বাড়ি ছেড়ে, আত্মনিয়োগ করলেন বিপ্লবী আন্দোলনে। কিন্তু এ ঘটনা মাস্টারদার জীবনে গভীর রেখাপাত করেছিল।
.................................................. চলবে ..........................................
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।