আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অবিস্মরণীয় চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ এবং মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন -- শেষ পর্ব

"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা

শেষ পর্ব আজ থেকে শত বছর পূর্বে মাস্টারদা সূর্যসেন এবং তাঁর সহযোগিদের এ প্রচেষ্টা সম্পর্কে মূল্যায়ণ করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্নের উদয় হয়। কেন তাঁরা এ ধরনের আত্মঘাতি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন? এ কি নির্বুদ্ধিতা নাকি হঠকারীতা? এ কি কোনো বিচ্ছিন্ন আঞ্চলিক কর্মকাণ্ড? এখানে যা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে তাহল, ওই সময়ের জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) নামধারী দলটির দলটির আপসকামীতা, দোদুল্যমানতা এবং ভুল রাজনীতি। তাদের ভ্রান্ত এবং আপসকামী নীতির কারণে গণআন্দোলনের জোয়ার বার বার ব্যর্থতার চোরাবালিতে হারিয়ে গেছে। ১৯২৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা কংগ্রেসে েনতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর উত্থাপিত 'পূর্ণ স্বাধীনতার' প্রস্তাব নাকচ হয়ে গিয়ে পাস হল ইংরেজ শাসনাধীনে স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব।

এর মাত্র কয়েক বছর আগেই গান্ধীর ভূমিকায় ব্যর্থ হয়ে গেল অসহযোগ আন্দোলন। এর ফলে গোটা দেশের মধ্যে এমন মনোভাব চেপে বসে যে আন্দোলন করে কিছু হবে না, ব্রিটিশ শক্তি যদি নিজ ইচ্ছায় চলে না যায় তবে আর তাকে তাড়ানো যাবে না। জনমনে চেপে বসা এ হতাশা দূর করার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা দেখাতে চেয়েছিলেন যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অপরাজেয় নয়। এ ক্ষেত্রে তাদের অনুপ্রেরণা ছিল ব্রিটিশ-শাসিত আয়ারল্যান্ডের ইস্টার সানডে বিদ্রোহ। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু নজরুলের ভাষায় --'মোরা আপনি মরে মরার দেশে আনব বরাভয়' -- এই ছিল বিপ্লবীদের মনোভাব।

এ পটভূমিতেই একটি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখল এবং স্বাধীন জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে বিপ্লবী দল ও শক্তিগুলি সংগঠিত হয়। প্রথমে মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব এবং বাংলায় একযোগে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইংরেজদের সশস্ত্র ঘাঁটিগুলো দখল করে সারা ভারতকে মুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু মুরারিপুকুর ষড়যন্ত্র মামলায় অসংখ্য বিপ্লবী নেতা-কর্মী গ্রেফতার হন এবং বিপ্লবীদের বহু গোপন আস্তানা পুলিশের দখলে চলে যায়। বিপ্লবীদের পরস্পরের মধ্যেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপরও চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা পূর্বোক্ত পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন।

আর এ কারণেই মাস্টারদা তাঁর দলের নাম রেখেছিলেন 'ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি'। যুববিদ্রোহের ঘোষণাপত্রেও ভারতবর্ষ জুড়ে বিপ্লবী আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে গণেশ ঘোষ ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট বসুমতী পত্রিকায় লিখেছিলেন : "পরিকল্পনা হিসাবে ইহা স্থির হয় যে, সমগ্র মার্তৃভূমিকে শৃঙ্খলমুক্ত করা সম্ভব না হইলেও ভারতবর্ষের একটি ক্ষুদ্র অংশে সাম্রাজ্যবাদের শক্তি নিশ্চিহ্ন করিয়া তথায় স্বাধীন ভারতের স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে -- চট্টগ্রামকে স্বাধীন করিতে হইবে, চট্টগ্রামে স্বাধীন সরকার কায়েম করিতে হইবে। বিপ্লবী নেতারা ইহা জানিতেন যে, মুষ্টিমেয় যুবক যদি সশস্ত্র বিদ্রোহ করিয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সামরিরক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তাহা হইলে মৃত্যু অবধারিত, সমষ্টিগতভাবে সমগ্র দলের নিশ্চিহ্ন হইবার সম্ভাবনা সুনিশ্চিত। কিন্তু ইহার জন্য তাঁহারা প্রস্তুত ছিলেন।

তাঁহাদের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, পরাধীন জাতির অন্তর হইতে মুক্তির কামনা নিশ্চিহ্ন করা অসম্ভব। শৃঙ্খলিত জনসাধারণের মন হইতে বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা দূর করা অসম্ভব; শোষিত এবং নির্যাতিত জনগণের অন্তর হইতে স্বাভাবিক বিদ্রোহের ভাব চিরতরে দমন করা কখনই সম্ভব নয়। দীর্ঘ আলোচনা, গভীর চিন্তা এবং উপযুক্ত শিক্ষার ভিতর দিয়া নেতারা নিজেদের এবং দলের সকল কর্মীর মনকে সুনিশ্চিত আসন্ন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করিয়া তুলিয়াছিলেন। (সংবাদপত্রে উপমহাদেশের স্বাধীনতা, পূর্বোক্ত, পৃ : ৩৯৬) মাস্টারদার আরেক সহযোগী লোকনাথ বল চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের মূল্যায়ন করতে গিয়ে পরবর্তীকালে বলেছিলেন, "চট্টগ্রামের বিপ্লবী যোদ্ধাদের পেছনে ছিল না কোনো অনুকূল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, ছিল না বৈদেশিক শক্তির সক্রিয় সমর্থন। শুধুমাত্র নিজেদের শক্তির ওপর নির্ভর করে পরাধীন দেশের বুকে তারা জ্বালিয়েছিল স্বাধীনতার আলো, ভারতবর্ষের পূর্ব সীমান্তের চট্টগ্রাম শহরকে পরাক্রান্ত বৈদেশিক শক্তির কবল থেকে থেকে মুক্ত করে বিজয়দর্পে উড়িয়েছিল স্বাধীনতার জয়পতাকা।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তিমূল পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের দুর্জয় আঘাতে, -- সমস্ত ভারতবর্ষ হল স্তম্ভিত -- স্বাধীনতাকামী তরুণ-তরুণীদের বুকের রক্তে লাগল প্রলয় দোলা। দু'শ বছরের গোলামীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বীর যোদ্ধারা শুরু করল রক্তাক্ত অভিযান। বাংলার ও ভারতের দিকে দিকে জ্বলে উঠল বিদ্রোহের আগুন। " (চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন : চারুবিকাশ দত্ত, কলকাতা) মহামতি ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস বলেছিলেন, "An well contested battle, even if defeated, it will have the same moral effect as the easily won victory. " অর্থাৎ একটি সুসংগঠিত ও সর্বস্ব-পণ-করা যুদ্ধে পরাজয় ঘটলেও চেতনার জগতে তার প্রভাব বিজয়ী হওয়া যুদ্ধের মতোই। চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের এ কথাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

বিপ্লবীদের সর্বস্ব-পণ-করা এই যুদ্ধ, পরাজয় সত্ত্বেও, চেতনায় দুয়ারে ধাক্কা দিতে পেরেছিল। ওই ইতিহাস, আজকের দিনেও, শাসকশ্রেনীর অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসন আর শোষণ-লুটপাটের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত হতে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রেরণা জোগায়। আর ঠিক এ কারণেই, আমাদের শাসকশ্রেণী স্বাধীনতা সংগ্রামের এইসব ইতিহাস মুছে দিতে চায়, ভুলিয়ে দিতে চায়। ইতিহাসের ওই বিশেষ অধ্যায়ের প্রতি শাসকশ্রেণী এবং তাদের স্বার্থবাহী মহলের নির্বিকার ঔদাসীন্য অজ্ঞতা থেকে নয়, বরং শ্রেণী চিন্তা এবং স্বার্থ থেকে উদ্ভূত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এ দেশকে দু'শ বছর শাসন-শোষণ করেছে, এ কথাটা যত আওড়ানো হয়, ওই দু'শ বছর ধরে দেশের প্রান্তে প্রান্তে কৃষক-তাঁতি-জেলে, ফকির-সন্ন্যাসী, সাঁওতাল-গারোসহ বিভিন্ন অংশের মানুষের বিদ্রোহ এবং প্রতিরোধের ইতিহাস ততটা আলোচিত হয় না।

এই বীর বিপ্লবীদের জীবন ও জীবনদানের ইতিহাস আমাদের স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে, আমাদের রেডিও-টেলিভিশনে, সংবাদপত্রগুলোর পাতায় খুঁজেও পাওয়া যায় না। পাঠ্যপুস্তকে বিপ্লবীদের সম্পর্কে যে দু'চার কথা লেখা হয় সেখানে তাদের এখনো 'সন্ত্রাসবাদী' হিসাবে অভিহিত করা হয়। অথচ আমরা জানি, বিপ্লবীদের ডাকাত-সন্ত্রাসী বলত ইংরেজ শাসকরা। কারণ বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড তাদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। ফলে এই বিপ্লবীদের সম্পর্কে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতে পারলেই ছিল তাদের সুবিধা।

সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে দেশকে স্বাধীন করার যে প্রত্যয় নিয়ে মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, তারকেশ্বর দস্তিদার, ক্ষুদিরাম প্রমুখ বিপ্লবীরা জীবন দিয়ে গেছেন, তাদের স্বপ্ন-সাধনার একটি অংশমাত্র সফল হয়েছে। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ বিদায় নিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পরাজিত করেছি পাকিস্তানী শাসকদেরও। যুববিদ্রোহের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে পরাধীনতার শৃঙ্খল আমরা ভেঙেছি, কিন্তু শোষণের শৃঙ্খল এখনো ভাঙতে পারিনি। গ্যাস-কয়লা-বন্দরসহ আমাদের জাতীয় সম্পদ এখনো সাম্রাজ্যবাদের থাবা থেকে নিরাপদ করতে পারিনি।

আমাদের রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও সংস্থাগুলোর খবরদারি প্রবলরূপ ধারণ করেছে। এ সংগ্রামে বিজয়ের জন্য আবার যৌবন-জোয়ারের প্রয়োজন। প্রয়োজন উন্নত আদর্শের ভিত্তিতে দেশপ্রেম ও মনুষ্যত্বের জাগরণ। মাস্টারদার জীবন ও কর্ম এবং চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের চেতনা এ জাগরণে সহায়ক হতে পারে। অবিস্মরণীয় চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ এবং মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন -- পর্ব - ১ পর্ব - ১ অবিস্মরণীয় চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ এবং মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন -- পর্ব - ২ পর্ব - ২ অবিস্মরণীয় চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ এবং মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন -- পর্ব - ৩ পর্ব - ৩ অবিস্মরণীয় চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ এবং মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন -- পর্ব - ৪ পর্ব - ৪ অবিস্মরণীয় চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ এবং মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন -- পর্ব - ৫ পর্ব - ৫ অবিস্মরণীয় চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ এবং মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন -- পর্ব - ৬ পর্ব - ৬ অবিস্মরণীয় চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ এবং মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন -- পর্ব - ৭ পর্ব - ৭ অবিস্মরণীয় চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ এবং মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন -- পর্ব - ৮ পর্ব - ৮


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.