আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অবিস্মরণীয় চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ এবং মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন (৭)

"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা

পর্ব - ৭ জেলে বন্দি বিপ্লবীদের মুক্ত করার প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হল। মাস্টারদা এবং তাঁর সহযোগীরা নতুন পরিকল্পনা করতে লাগলেন। ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে শহীদ বিপ্লবীগণ (ছবি - ১) কিশোর হরিগোপাল বল (টেগরা) এবং মতি কানুনগো (ছবি -২) নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেন, বিধু ভট্টাচার্য (ছবি -৩) প্রভাস বল, শশাঙ্ক দত্ত, নির্মল লালা (ছবি - ৪) জিতেন দাশ, মধু দত্ত, পুলিনবিকাশ ঘোষ ১৯৩২ সালের ১৩ জুন। পটিয়ার ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে বিপ্লবীরা মিলিত হলেন এক গোপন বৈঠকে।

সেখানে আচম্বিতে হানা দিল ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের নেতৃত্বে একদল ইংরেজ সিপাহী। তারা বাড়িটি ঘিরে ফেলল। ব্রিটিশ সৈনদের ঠেকিয়ে রাখার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হলেন নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন (ভোলা)। ক্যাপ্টেন ক্যামেরনও নিহত হলেন বিপ্লবীদের হাতে। এরপর মাস্টারদা পরিকল্পনা করলেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের।

এ অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হল প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে আক্রমণ করা হল ইউরোপীয়ান ক্লাব। সফল আক্রমণ শেষে ফেরার পথে এক ইংরেজ অফিসারের গুলিতে প্রীতিলতা আহত হলেন। ধরা না দেবার প্রত্যয়ে সঙ্গে রাখা সায়ানাইড বিষ পান করে তিনি আত্মাহুতি দিলেন। ভারতের মুক্তিসংগ্রামের প্রথম নারী শহীদের নাম প্রীতিলতা।

যুববিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার মাস্টারদার মাথার দাম ঘোষণা করেছিল ১০ হাজার টাকা। ধলঘাটের যুদ্ধের পর তাঁর মাথার দাম বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়। ওই সময়টাতে পুলিশী তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই মাস্টারদাকে চট্টগ্রাম থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু মাস্টারদা ছিলেন অনঢ়; বিপ্লবী আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য তিনি চট্টগ্রামেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় তিনটি বছর তিনি চট্টগ্রামের আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামে আত্মগোপন করে থেকেছেন।

তাঁকে ধরতে বিভিন্ন সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনী সে-সব গ্রামে একের পর এক অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই মাস্টারদা উপস্থিত বুদ্ধি, কৌশল ও সাহসের সাথে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কয়েকবার তো মাস্টারদা নিশ্চিত গ্রেফতারের হাত এড়িয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তাঁর নামে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে বহু কৌতুকপ্রদ গল্প এবং জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল। প্রীতিলতার আত্মদানের ৪ মাস পর মাস্টারদা গ্রেফতার হলেন।

১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে ১০ মাইল দূরে পটিয়া থানার গৈরিলা গ্রামের ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ব্রজেন সেন, কল্পনা দত্ত ও মনি দত্ত। নেত্র সেন নামের এক বিশ্বাসঘাতক এ খবর পৌঁছে দিল পুলিশের কাছে। খবর পেয়ে পুলিশ সামরিক সেনাসহ বাড়িটি ঘিরে ফেলে। সেখান থেকে পালাতে গিয়ে ছোট-খাট এক লড়াই চালিয়ে অবশেষে গ্রেফতার হন মাস্টারদা ও ব্রজেন সেন।

কল্পনা দত্ত ও মনি দত্ত পুলিশের বেষ্টনী ভেদ করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। গ্রেফতারের পর মাস্টারদা ও ব্রজেন সেনের ওপর চালানো হয় বর্বর অত্যাচার। হাত-পা শিকলে বেঁধে মাস্টারদাকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামে। ২০ ফেব্রুয়ারি তাঁদের জেলে পাঠানো হল। ওদিকে তারকেশ্বর দস্তিদার, কল্পনা দত্ত এবং শচীন্দ্র দাস প্রমুখ ১৯ মে তারিখে গ্রেফতার হলেন আনোয়ারা থানার গহিরা গ্রামের পূর্ণ তালুকদারের বাড়ি থেকে।

এ সময় বিপ্লবীদের সঙ্গে ব্রিটিশ সেনাদের সংঘর্ষে বিপ্লবী মনোরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং গৃহস্বামী পূর্ণ তালুকদার শহীদ হলেন। মাস্টারদা সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তের বিচারের উদ্দেশ্যে তিন সদস্যের বিচারকের সমন্বয়ে এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা প্রহসনের বিচার সাজিয়ে মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির হুকুম জারি করে। কল্পনা দত্ত-কে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ফাঁসির সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি দিবাগত রাতে।

সে রাতেই মহাপ্রাণ বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন এবং তাঁর সহকর্মী তারকেশ্বর দস্তিদার নিঃশঙ্কচিত্তে ব্রিটিশের ফাঁসির রজ্জুতে জীবন বিসর্জন দিলেন। যদিও অনেকেরই ধারণা, পুলিশী অত্যাচারেই তাঁদের মৃত্যু হয়েছিল। গ্রেফতারের পর থেকে ফাঁসি কার্যকর করার দিন পর্যন্ত এক বছর সময় ধরে তাঁদের ওপর চালানো হয়েছে নির্মম অত্যাচার। বর্বর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দুই বীরের মৃতদেহকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে। ফাঁসির পর মাস্টারদার মৃতদেহ কি করা হয়েছে সে সম্পর্কে সঠিক কোনো জবাব কেউ দিতে পারেনি।

কারো কারো ধারণা, 'দি রিনাউন' নামক একটি যুদ্ধ জাহাজে করে তাঁর লাশ বঙ্গোপসাগরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। সূর্যসেনের মৃতদেহকে বাংলার মাটিতে সমাহিত হতে দেওয়ারও সাহস হয়নি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির। এখানে বলে রাখা ভাল, মাস্টারদার ফাঁসির দিনেই বিপ্লবীরা আরেকটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। সেটি বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেনের।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.